বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মোদির জিডিপি রঙ্গ
ও মানুষের যন্ত্রণা!
হিমাংশু সিংহ

অচিন্ত্য গুঁই। উত্তর কলকাতার ছোট দোকানদার। কয়েক পুরুষের জামা-কাপড়ের ব্যবসা। দুঃখ করে বলছিলেন, গতবছর পুজোর আগে যা মাল তুলেছিলাম, তা-ই এখনও পড়ে আছে। এমনকী, গত চৈত্রেও সেল তেমন জমেনি। সাহস করে এবছর পুজোয় তাই মহাজনের থেকে বেশি মাল আর তুলব না। আগের ধারই মেটাতে পারিনি। দু’জন হেল্পার ছিল, মাসের পর মাস বিক্রিবাটা না থাকায় অনেক দুঃখে তাদের বিদায় দিয়ে দিয়েছি। ছেলেটাকে নিয়ে নিজেই গতরে খেটে কোনওরকমে পেট চালাচ্ছি। গত মে ও জুন মাসে দূরবিন দিয়েও বাজারে লোক দেখা যেত না। রাস্তায় তাকালেই শুধু অ্যাম্বুলেন্সের বিকট শব্দের ভয়ার্ত দৌড়। জুলাই-আগস্টে পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও বলার মতো বিশেষ কিছুই নয়। ভরসা এখন এই সেপ্টেম্বরটা। পুজোর আগের মাস বলে কথা। অচিন্ত্যর কথায়, ‘গতবারের মতো না হয়, এই একটাই প্রার্থনা। ভাদ্র মাসটা আগে যাক। তবে একেবারে প্রয়োজন ছাড়া এবারও কেউ খরচ করতে রাজি নন। একটা অজানা আশঙ্কা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সবাইকে। সংক্রমণ একটু বাড়লেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে সবাই।’ 
বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের আগে এই হচ্ছে রাজ্যের এক অনামী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর হাল। আরও করুণ অবস্থা যাঁদের স্থায়ী দোকান নেই, রাস্তায় ডালা নিয়ে হকারি করেন তাঁদের। এবারও যে বাজারে ভিড় একদম হচ্ছে না তা নয়। গত ১৫ আগস্ট থেকে হাতিবাগান, গড়িয়াহাটের অধিকাংশ দোকান রবিবারও খোলা থাকছে। তবে যত মানুষ ইতিউতি ঘুরছে, কেনাকাটা তার তুলনায় অনেক কম। দেখার লোক বেশি, কেনার লোক কম! অনেকটা ঠিক বইমেলার মতো। শেষ ভিড় উপচে বাজার জমেছিল দু’বছর আগে, উনিশ সালে। তারপরই মহামারীর ধাক্কায় সব শেষ। এবারও দু’বছর আগের ৬০-৭০ শতাংশ বিক্রির আশাও দেখছেন না দোকানিরা। তবু সামনের পাঁচসপ্তাহ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ছোট কারবারিদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ঘুরে দাঁড়ানোর অগ্নিপরীক্ষা। অস্তিত্বরক্ষার লড়াই। যদি করোনাকে পিছনে ফেলে ভয়ভীতি দূর করে মানুষ আবার পুরনো ছন্দে ফিরতে পারেন, একমাত্র তাহলেই অভিশপ্ত সময় কিছুটা কাটিয়ে ওঠার ক্ষীণ আলো অন্তত দেখা যাবে, এমনই আশায় বুক বাঁধছেন সবাই। 
এই কারবারিরা জিডিপি বোঝেন না। জিএসটিও অধিকাংশের কাছেই জটিল ধাঁধা ছাড়া কিছুই নয়। অর্থনীতির জটিল পরিসংখ্যান, ওঠাপড়া, তত্ত্বের কচকচানি ওঁদের কাছে অর্থহীন বাকোয়াস—স্রেফ একটা সংখ্যামাত্র। তবু প্রায় আধমরা বাজারে সিংহভাগ  জনগণের সামনে হঠাৎ একটা সংখ্যা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কেন্দ্রের সরকার। ২০.১। শরীরের তাপমাত্রা নয়, রক্তচাপ নয়, রক্তে সুগারের পরিমাপও নয়, গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট সংক্ষেপে জিডিপি। এককথায় দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্যের সূচক। আর ওই একটা সংখ্যা দেখিয়েই উল্লাসে মেতেছে শাসক শিবির। কাড়া-নাকাড়া ঢোল কত্তাল নিয়ে একে অপরের পিঠ চাপড়াতে ব্যস্ত। এমনও বলা হচ্ছে, জিডিপি আগের বছর ছিল -২৪, আর এখন বেড়ে হয়েছে +২০.১, তাহলে বৃদ্ধি নাকি সব মিলিয়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ। আর এইখানেই লোককে বোকা বানানোর সব রসদ মজুত। যদি উনিশ সালের জিডিপির বেস ১০০ ধরা হয়, তাহলে গতবছর তা কমে হয়েছিল ৭৬ (সঙ্কোচন শতকরা প্রায় ২৪ শতাংশ)। এখন ওই ছোট বেসের উপর ২০.১ শতাংশ বৃদ্ধির অর্থ তা বেড়ে হয়েছে মাত্র ৯১.২ (৭৬ এর উপর ২০.১ শতাংশ)। অর্থাৎ এখনও উনিশ সালের সেই বেস লাইন (১০০) থেকে প্রায় ৯ শতাংশ কম। সেই দিক দিয়ে দু’বছর আগের তুলনায় এখনও ‘নেগেটিভ‘ই রয়েছে জিডিপি। কিন্তু পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচে, সংখ্যাতত্ত্বের জাগলারিতে কেমন ছোট বেসের ধোঁকা দিয়ে দেশের জনগণকে বোকা বানানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা চলছে। আর তা করেছেন সরকারের লোমহর্ষক ডিগ্রিধারী অর্থনীতির পণ্ডিতরা। আর আমরা মানে আমজনতা, পাঁচ পাবলিক তাই গোগ্রাসে গিলছি। কঙ্কাল শরীর নিয়েই হাততালি দিচ্ছি। উদ্বাহু হচ্ছি। গোয়েবলসের এই কেরামতি আরএসএসের ভক্তকুলের বড্ড চেনা খেলা। স্যানিটাইজার দিয়ে যত্নে মুছে সড়কের ধারে বড় বড় চোঙ লাগিয়ে সাফল্যের সাতকাহন দু’বেলা উচ্চগ্রামে বলতে থাকো। বারবার বলো। সকাল সন্ধে বাজারে রাস্তায় ভরা স্টেশনে সর্বত্র হাঁকো। তাহলেই অর্ধসত্যটা মানুষ আস্তে আস্তে মেনে নেবে। চোঙা ফুঁকতে ফুঁকতেই আদতে যেটা হয়নি তাই প্রতিষ্ঠিত সত্য হয়ে যাবে সূর্যের আলোয়। তারপর কলাটা মুলোটা আর সিবিআই জুজু দেখিয়ে বিরোধী ঐক্য ভাঙো। কিনে নাও বিরোধী নেতানেত্রীদের। তাহলেই চব্বিশের ভোটে জিতে ক্ষমতার কুর্সিতে ফিরে আসার পথ ষোলোআনা সাফ। এমন সাফল্য, অর্থনীতির এমন চোখ জুড়নো ঘুরে দাঁড়ানো নাকি কোনও সরকার কোনওকালে অর্জন করতে পারেনি। তাই দু’হাত জোড় করে মোদিজির গুণ গাও। আর ভুলিয়ে দাও পুরনো সব ক্ষত আর যন্ত্রণা। তাহলেই কেল্লা ফতে! দেশে তো আর পাঁচটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেই! বুক চিতিয়ে কে রুখবে গেরুয়া বাহিনীর এই আগ্রাসী মিথ্যে প্রচার। বাংলার জননেত্রীর মতো সুবিশাল প্রতিরোধের পাহাড় হয়ে কে মোকাবিলা করবে মোদি-অমিত শাহের প্রচারসর্বস্ব ঢক্কা নিনাদের।
কিন্তু এই সাফল্যের ছিটেফোঁটাও তো গরিবের কুটিরে প্রদীপ হয়ে জ্বলে না। তাহলে সাধারণের লাভ? গরিবের আধপেটা খাওয়া শরীর কি তৃপ্তি পাবে নির্মলা সীতারামনদের এই হঠাৎ আহ্লাদের অভিঘাতে। কিংবা লকডাউনে কাজ হারানো শ্রমিকের সংসারে দুর্দশা ঘুচবে? আজও অস্বাভাবিক মন্দায় যারা প্রতিমুহূর্তে কাজ হারানোর আশঙ্কা করছেন। সেই পাঁচবছর আগে নভেম্বরের এক হাল্কা শীতের রাতে প্রধানমন্ত্রীর নোট বাতিলের পর থেকে বাজার আর তো তেমন ঘুরে দাঁড়ায়নি। গত দু’বছরে করোনা আর লকডাউন ছোট মাঝারি বড় কোনও ব্যবসায়ীকে ছাড়েনি। কেউ মৃত, কেউ অর্ধমৃত। কোনওরকমে বেঁচে আছেন বাকিরা।
যদি সরকারের দাবি মতো অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েই থাকে তাহলে জুলাই মাসের তুলনায় আগস্টে জিএসটি আদায় চারহাজার কোটি টাকা কমে গেল কেন। জুলাইতে কেন্দ্রের জিএসটি আদায় ছিল ১ লক্ষ ১৬ হাজার কোটি টাকা। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১ লক্ষ ১২ হাজার কোটি টাকা। কেন সেন্টার ফর মনিটরিং অব ইন্ডিয়ান ইকনমির পরিসংখ্যান বলছে, শুধু আগস্টেই ফের ১৫ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এর দায় কার? জিএসটি আদায় কমলে, মানুষ কর্মহীন হলে এবং রান্নার গ্যাসের দাম একধাক্কায় ৯০০ টাকা পেরিয়ে যাওয়া কীসের ইঙ্গিত দেয়। সবল, সুস্থ উদ্দাম অর্থনীতির? 
২০১৪ সালে মোদিজি যখন পবিত্র সংসদ ভবনের চৌকাঠে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে গণতন্ত্রের মন্দিরে প্রবেশ করেছিলেন তখন জনগণের সামনে রিপোর্ট কার্ড তুলে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। তখন গ্যাসের দাম ছিল ৪০০ টাকা। আজ সাতবছরে তা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে গিয়েছে। পেট্রল ডিজেল ১০০ টাকা ছাড়িয়ে দ্রুত পরবর্তী মাইলফলক ছোঁয়ার অপেক্ষায়। কোন জিনিসটার দাম বাড়েনি বলুন তো? আচ্ছে দিনের সব আয়োজন যেন সম্পূর্ণ সাত বছরেই। ভাবটা এমন, বাকি তিন বছর অযোধ্যার মন্দিরের দিকে তাকিয়েই জনগণের সব জ্বালা যে জুড়িয়ে যাবে। ধর্ম আর মুখের মিষ্টি কথায় জনগণেশকে বশ করার মন্ত্র বিলক্ষণ জানেন গুজরাতি প্রধানমন্ত্রী। তাই এসবে মোটেই আমল দিতে একেবারে রাজি নন তিনি। তাই এত অনটনের মধ্যেও বিরোধী ঐক্যকে আর একবার চুরমার করে কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের ছক সাজাচ্ছেন তিনি। কিন্তু তা বলে পরিসংখ্যান নিয়েও মিথ্যাচার? গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের অর্থনীতির মডেলে সাধারণ মানুষই শেষ কথা। কর্পোরেট কর্তারা নন। তাই মানুষকে স্বস্তি না দিয়ে, তাঁর যন্ত্রণার উপশম না করে গালভরা পরিসংখ্যান কখনও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠি হতে পারে না। মোদিজি ও তাঁর পারিষদরা যত তাড়াতাড়ি এই সারসত্যটা বুঝতে পারবেন, ততই মঙ্গল।

5th     September,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ