বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

ইংরেজির আগলমুক্ত
মাতৃভাষায় বৃত্তিমূলক শিক্ষা
এম বেঙ্কাইয়া নাইডু 

প্রতিটি বড় পরিবর্তন বৈপ্লবিক পদক্ষেপের মাধ্যমেই শুরু হয়। নতুন শিক্ষাবর্ষে ৮টি রাজ্যে ১৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কয়েকটি শাখায় আঞ্চলিক ভাষায় পঠনপাঠনের উদ্যোগ শুরু হয়েছে। দেশের শিক্ষার মানচিত্রে এ এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। ভবিষ্যতে  ছাত্রছাত্রীদের সাফল্য এর উপর অনেকাংশে নির্ভর করবে।  
জাতীয় শিক্ষানীতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এআইসিটিই ১১টি ভাষায় বি-টেক পাঠ্যক্রম শুরু করার অনুমতি দিয়েছে। ফলে ছাত্রছাত্রীরা বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, গুজরাতি, মালয়ালম, অসমিয়া, পাঞ্জাবি এবং ওড়িয়া ভাষায় বি-টেক পড়তে পারবে। 
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতীয় শিক্ষানীতির প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময় মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। ফলে দরিদ্র, গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নতুন আস্থা গড়ে উঠবে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রাথমিক স্তর থেকে প্রধানমন্ত্রী মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি বিদ্যাপ্রবেশ কর্মসূচিরও সূচনা করেন। গুরুত্বপূর্ণ এই সিদ্ধান্তগুলিকে স্বাগত জানানো উচিত। কারণ মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের স্বপ্ন দেখা অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। এআইসিটিই ফেব্রুয়ারিতে ৮৩ হাজার ছাত্রছাত্রীর উপর একটি সমীক্ষা করে। তাতে দেখা যায়, প্রায় ৪৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী মাতৃভাষায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আগ্রহী। এর মধ্য দিয়ে কারিগরি শিক্ষার চাহিদার গুরুত্ব বোঝা যায়।  
২০২০ জাতীয় শিক্ষানীতির প্রগতিশীল ও সুদূরপ্রসারী উদ্যোগের মাধ্যমে প্রাথমিক স্তরে ছাত্রছাত্রীদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। ফলে শিশুদের শিক্ষালাভে সুবিধা হবে এবং তাদের মানসিক বিকাশ ঘটবে।    
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যারা শৈশবে মাতৃভাষায় পড়াশোনা করেছে, অন্য ভাষায় শিক্ষাপ্রাপ্তদের থেকে তারা পরে এগিয়ে থাকে। ইউনেস্কোসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের উপর গুরুত্ব দেয়। কারণ এর মাধ্যমে আত্মসম্মানবোধ, আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে এবং শিশুর সার্বিক বিকাশ ঘটে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু শিক্ষাবিদ এবং অভিভাবক এখনও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদানের পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। ফলে তাঁদের শিশুরা স্কুলে মাতৃভাষাকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা হিসেবে শেখা শুরু করে।     
এই প্রসঙ্গে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সি ভি রমনের বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করতেন ‘আমাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান পড়ানো উচিত। নয়তো বিজ্ঞান উচ্চশিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। সর্বসাধারণের জন্য বিজ্ঞানশিক্ষার সুযোগ তৈরি হবে না।’ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার যথেষ্ট প্রসার ঘটেছে। বর্তমানে ভারতে ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি, আইন এবং কলা বিভাগের বিভিন্ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের পঠনপাঠন হয়। অথচ আমরা আমাদের নিজেদের লোকেদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছি। বছরের পর বছর ধরে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির সুযোগ থেকে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী বঞ্চিত হচ্ছে। গুটিকয়েক ইংরেজি মাধ্যমের বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সেই সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে কারিগরি বা বৃত্তিমূলক পাঠ্যক্রমে আমাদের নিজেদের ভাষাগুলি বঞ্চিত হচ্ছে। সারা বিশ্বের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালে স্পষ্ট হয় যে আমরা ভুল জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম। জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত বেশিরভাগ দেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষায় পড়ানো হয়। 
এশীয় দেশগুলির মধ্যে কোরিয়ার প্রায় ৭০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় কোরিয়ান ভাষায়। অথচ কোরিয়ার জনসাধারণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোরীয় অভিভাবকদের মধ্যে সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর ঝোঁক বৃদ্ধিতে ছাত্রছাত্রীদের কোরিয়ান ভাষায় দক্ষতা হ্রাস পায়। তাই সরকার ২০১৮ সালে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি পঠনপাঠন নিষিদ্ধ করে।     
একইভাবে জাপানের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানি ভাষায় পঠনপাঠন চলে। চীনেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ম্যান্ডারিন ভাষায়। ইউরোপে ফ্রান্স এবং জার্মানি দেখিয়েছে কীভাবে মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে হয়। ফ্রান্স বিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে ‘শুধুমাত্র ফরাসি’ নীতি কঠোরভাবে মেনে চলে। জার্মানিতেও জার্মান ভাষায়। এমনকী উচ্চশিক্ষাতেও ৮০ শতাংশ স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমে পড়াশোনার মাধ্যম জার্মান।  
কানাডা শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিশা দেখিয়েছে। সে-দেশে ভাষাগত বৈচিত্রের কারণে ইংরেজি বেশিরভাগ রাজ্যের লেখাপড়ার প্রধান মাধ্যম। তবে ফরাসিভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ কিউবেক রাজ্যে স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ফরাসি ভাষায় পড়া যায়। এই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে ভারতের বেশিরভাগ বৃত্তিমূলক পাঠ্যক্রম ইংরেজিতে পড়ানোর বিষয়টি খুব হাস্যকর। বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি এবং আইন শিক্ষার ক্ষেত্রে তা যেন বাধ্যতামূলক ছিল। সৌভাগ্যবশত আমরা এখন আমাদের নিজেদের ভাষায় এই পাঠ্যক্রমগুলি শুরু করতে চলেছি। কীভাবে বেরিয়ে আসব আমরা? আমাদের শিক্ষার গুণমান বৃদ্ধি এবং আরও বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রী যাতে শিক্ষাব্যবস্থায় শামিল হতে পারে তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আমাদের ভাষাগুলিকে রক্ষা করার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতিতে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদান প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে। মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগটা তার পরেও প্রসারিত করতে হবে। পেশাদার পাঠ্যক্রমে ১৪টি কলেজে মাতৃভাষায় পঠনপাঠনের উদ্যোগ তাই প্রশংসনীয়। দেশজুড়ে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যাতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও শামিল করতে হবে। এর জন্য প্রথমে তাদের দুটি ভাষায় পড়ার সুযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হল উন্নতমানের পাঠ্যপুস্তকের অভাব। বৃত্তিমূলক শিক্ষায় এই সমস্যা আরও বেশি। তাই দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ চাই। ডিজিটাল যুগে প্রত্যন্ত অঞ্চলের পড়ুয়ারা যাতে মাতৃভাষায় পড়ার সুযোগ বেশি পায় তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবস্থাটি নতুন। এক্ষেত্রেও ইংরেজি এগিয়ে। তাই বেশিরভাগ পড়ুয়া এর সুফল পাচ্ছে না। তাই  প্রয়োজনীয় পরিবর্তনটা জরুরি।     
এই প্রসঙ্গে এআইসিটিই এবং মাদ্রাজ আইআইটির একটি উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। স্বয়ম প্রকল্পের পাঠ্যক্রমভুক্ত বিষয়বস্তু বাংলা, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মারাঠি, মালয়ালম এবং গুজরাতি ভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে। এতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়াদের সুবিধা হবে। সহজ হবে ভবিষ্যতে ইংরেজির প্রাধান্য থেকে বেরিয়ে আসা। আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্মুক্ত করার জন্য এই ধরনের প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোগগুলির সাহায্য নিতে হবে।    
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের অর্থ অন্য ভাষাকে বর্জন নয়। আমি বরং বলি, বেশি সংখ্যক ভাষা শিখতে হবে। কিন্তু মাতৃভাষার ভিত মজবুত থাকা প্রয়োজন। ‘মাতৃভাষা বনাম ইংরেজি’-র লড়াইয়ের পক্ষে আমি নই। চাই মাতৃভাষার সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষা। এ-যুগে বিভিন্ন ভাষার উপর দক্ষতা থাকলে অনেক বেশি সুযোগ পাওয়া সম্ভব। নিজের ভাষায় কথার বলার সময় অনেকে হীনমন্যতায় ভোগেন। এই মানসিকতা দূর হওয়া জরুরি। পরিশেষে বলব, একটি ভাষাকে অবহেলা করার অর্থ অমূল্য জ্ঞানভাণ্ডার থেকে নিজেদের বঞ্চিত করা। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মও তাদের সংস্কৃতির শিকড়, মূল্যবান সামাজিক ও ভাষাগত ঐতিহ্যের স্বাদ হারাবে। আশা করব, ভবিষ্যতে বিভিন্ন পাঠ্যক্রমে আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষার সুযোগ বাড়বে। ভারতের অপরিমেয় প্রতিভা রয়েছে। সেসব কাজে লাগাতে হবে। যুব সম্প্রদায় বিদেশি ভাষায় কথা বলতে পারে না বলে তাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাবে না, এই দৈন্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবেই তাদের উন্নতি হবে। এই প্রেক্ষাপটে ৮টি রাজ্যের ১৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আঞ্চলিক ভাষায় বিভিন্ন পাঠ্যক্রমে পঠনপাঠনের যে সুযোগ এনে দিয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।  
 লেখক ভারতের উপরাষ্ট্রপতি। মতামত ব্যক্তিগত

5th     August,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ