বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

সংবাদপত্রের উপর আবার আঘাত
হিমাংশু সিংহ

‘গঙ্গা ঝুট নেহি বোলতে’। গঙ্গা কখনও মিথ্যে বলে না। দৈনিক ভাস্করের সম্পাদক ওম গৌড়ের এই প্রতিবেদনটি ঝড় তুলেছিল গোটা দেশে। দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতা, গঙ্গায় সারি সারি লাশের ভেসে যাওয়া, অক্সিজেনের সঙ্কট এবং সর্বোপরি একটা বেডের জন্য এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে ছোটাছুটির জীবন্ত ছবি নিজের কলমে এঁকেছিলেন সম্পাদক ওম গৌড়। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর লেখা সমাদৃত হয় বিদেশেও। মার্কিন মুলুকের বিশ্বখ্যাত সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমসও প্রতিবেদনটি মর্যাদা সহকারে ছাপে গত ১৭ জুন। ‘The ganges is returning the dead, it does not lie’ এই আক্রমণাত্মক শিরোনামে। সঙ্গে লাশ ভেসে যাওয়ার পাতাজোড়া ছবি। প্রকাশিত হতেই আমেরিকাজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। অস্বস্তি বাড়ে মোদি সরকারের।
সরকারের গাফিলতি এবং ত্রুটি বিচ্যুতিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার স্পর্ধাকে কোনওদিনই ক্ষমতার অধীশ্বররা সহ্য করতে পারেন না। যুগ যুগ ধরে ইতিহাস সেই শিক্ষাই দিয়ে আসছে। এবারও তার খুব একটা অন্যথা হল না। ঢেউ একটু স্তিমিত হতেই নেমে এল পাল্টা আঘাত। সেই সঙ্গে সতর্ক করে দেওয়া হল অবাধ্য অন্যদেরও। নরেন্দ্র মোদির জমানায় সংবাদমাধ্যমকে সবক শেখানোর ঘটনা কিন্তু এই প্রথম নয়। আগেও হয়েছে। কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশ থেকে ত্রিপুরার সাংবাদিক সুদীপ দত্ত ভৌমিককে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়েছে। কাশ্মীরের একাধিক সাংবাদিকের নামে মামলা হয়েছে কালা কানুন ইউএপিএ-তে। দ্য ওয়্যারের সম্পাদক সিদ্ধার্থ বরদারাজনের নামে একাধিক এফআইআর পর্যন্ত হয়েছে। জেলেও পোরা হয়েছে কয়েকজনকে। তবে উত্তরপ্রদেশের ভোটের ঠিক আগে হিন্দি বলয়ের জনপ্রিয় পত্রিকা গোষ্ঠীর একাধিক অফিস ও সম্পাদকের বাড়িতে আয়কর হানা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এবং তা ঘটল কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ হাড়ে কাঁপন লাগানোর কয়েক মাসের মধ্যেই। সত্যকে নির্মমভাবে তুলে ধরার মাসুল দিতে হল দৈনিক ভাস্কর সংবাদপত্র গোষ্ঠীকে। আয়কর অভিযানের নামে পত্রিকার ৩০টি অফিস, মালিক ও সম্পাদকের বাড়িতে চলল টানা তল্লাশি। সরকার যদিও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, এই আয়কর অভিযানের সঙ্গে প্রকাশিত খবর কিংবা সংবাদপত্রটির সম্পাদকীয় নীতির কোনও যোগ নেই। তবু দেশের মানুষ থেকে শুরু করে তামাম বিরোধী দল গত বৃহস্পতিবার থেকেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। নেতানেত্রীরা একযোগে বলতে শুরু করেছেন, এই হানাদারি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর নির্মম আঘাত ছাড়া আর কী? ঘুরপথে একটু সমঝে দেওয়া!
সত্যকে নির্ভয়ে প্রকাশ করতে গিয়ে শাসকের রক্তচক্ষুর মুখোমুখি হওয়ার উদাহরণ স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে ভূরি ভূরি রয়েছে। সত্যকে যাঁরাই দিনের আলোয় প্রকাশ করার সাহস দেখিয়েছেন তাঁদের উপরই নেমে এসেছে শাস্তির খাঁড়া। সেই ইন্দিরা জমানার জরুরি অবস্থার সময় থেকেই তার ব্যতিক্রম হয়নি। বর্তমান পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ সম্পাদক বরুণ সেনগুপ্তকে বিগত শতকের সাতের দশকে তৎকালীন শাসক কংগ্রেস তথা ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে নির্ভীকভাবে লেখার জন্য প্রায় ৬ মাস জেল খাটতে হয়েছিল কালা কানুন মিসায়। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ঘোরানো হয়েছিল এ জেল থেকে অন্য জেলে। সেই সময় এত মিডিয়া ছিল না। কাগজের সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা। শাসকের অন্যায় ও অনাচারের সঙ্গে তবু আপস করেননি কালজয়ী বরুণ সেনগুপ্তরা। শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই জরুরি অবস্থার সময় থেকে দীর্ঘ বামফ্রন্ট আমল, তাঁর কলম অন্যায় দেখলেই গর্জে উঠেছে অসামান্য দক্ষতায়। 
আসলে ধুরন্ধর শাসক মাত্রেই জানে দেশের মানুষের স্মৃতি অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। তাই গত এপ্রিল মাসে যা ছিল দুঃস্বপ্ন, এখন সংক্রমণ কমায় তা অনেকটাই ম্লান। সেই অক্সিজেন আর রেমডিসিভিরের হাহাকার একটু যেন ফিকে। তাই সে সময় যারা বাড়াবাড়ি রকমভাবে সরকারের ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেছে, সুযোগ বুঝে তাদের একটু সবক শেখানোর এই তোড়জোড়।
কী দেখেছিলাম গত এপ্রিল ও মে মাসে। ১৭ এপ্রিল। খোদ রাজধানীর বুকে চোখের সামনে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক বিনয় শ্রীবাস্তবকে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছিল পুত্র হর্ষিত। হাসপাতালে অনেক চেষ্টা করেও মেলেনি শয্যা, পাওয়া যায়নি অক্সিজেন। বাড়িতেই অক্সিজেন স্যাচুরেশন তখন কমতে কমতে ৩১। গত ২৩ এপ্রিল জয়পুর গোল্ডেন হসপিটালে অক্সিজেনের অভাবে একসঙ্গে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল সোশ্যাল মিডিয়ায় ওই খবরে ঝড় উঠেছিল। প্রায় পিঠোপিঠি দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালে একসঙ্গে ২৪ জনের মৃত্যুর কথাও কেউ কি সহজে ভুলতে পারে! সেই ধাক্কা কাটতে না কাটতেই নেমে এল আবার আঘাত। দিল্লির নামজাদা বাত্রা হাসপাতালে গত ১ মে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে প্রাণ হারালেন ১২ জন। কোভিডে তাঁদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমছিল। কিন্তু নেই অক্সিজেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও মেলেনি একটাও সিলিন্ডার। ওই হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপার এস সি এল গুপ্তর বয়ান অনুযায়ী বার বার ফোন করেও সেই রাতে অক্সিজেন মেলেনি। আসেনি ট্যাঙ্কার। ক্রমশ অক্সিজেন স্যাচুরেশন তলানিতে নেমে চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন ১২ জন গুরুতর কোভিড রোগী। একই কথা বলেছেন জয়পুর গোল্ডেন হাসপাতালের ডঃ ডি কে বালুজা। তাঁর বক্তব্য, গোটা রাত অপেক্ষা করেও সরকারি অক্সিজেন হাসপাতালের গেটে পৌঁছয়নি। সাতঘণ্টা অপেক্ষার পর মিলেছিল মাত্র ১ হাজার লিটার। ততক্ষণে শ্বাসকষ্টে গুরুতর অসুস্থরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। 
অথচ আজ জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে তাঁর বিবৃতিতে এমন ভয়ঙ্কর তথ্য পেশ করেছেন যাতে চমকে উঠেছে গোটা দেশ। মন্ত্রীর বক্তব্য, কোনও রাজ্যই অক্সিজেনের অভাবে রোগী মৃত্যুর তথ্য কেন্দ্রকে পাঠায়নি। তাই সরকারের কাছে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর একটিও তথ্য নেই। বলিহারি দেশ! সংসদ ও সরকারের মন্ত্রীকে সম্মান জানিয়েই বলি, শুধু একটা পরিসংখ্যান দিয়ে সত্যকে কোনওদিন চেপে রাখা যায়? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেথ সার্টিফিকেটে কখনও অক্সিজেন না পেয়ে রোগীর মৃত্যু হয়েছে, একথা লেখা থাকবে না। থাকতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই কার্ডিয়াক ফেলিওরের কথাই লেখা আছে। তাই বলে তো আর প্রকৃত সত্যকে মুছে ফেলা যায় না। অথচ সেই সুযোগেই  কলঙ্ককে বেমালুম ঢেকে দেওয়ার কাজ চলেছে নিখুঁতভাবে। এক্ষেত্রে অজুহাতও তৈরি, রাজ্য কোনও তথ্য দেয়নি, আমাদের কী করার আছে!  
দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় কেন্দ্রের সরকার যে আগে থাকতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি, অক্সিজেনের অভাবে যে কয়েকশো মানুষ অসহায়ভাবে তিলে তিলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তা দিনের আলোর মতোই সত্য। সরকারি খাতায় তার উল্লেখ থাকুক আর নাই থাকুক তা ঘোর বাস্তব। সরকারের বাধ্য বশংবদ কোনও সাংবাদিকও সেই সত্য এড়িয়ে যেতে পারবেন না। আর কে না জানে গত মে মাসে পরপর ওই ঘটনায় কেন্দ্রের মোদি সরকারও কম বিব্রত হয়নি। তড়িঘড়ি তাই জরুরি বৈঠক ডেকে দেশের ১৫০০টি হাসপাতালে দ্রুত অক্সিজেন প্লান্ট গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদি দেশে অক্সিজেনের কোনও অভাব নাই ঘটে থাকে তাহলে হঠাৎ এত বড় আয়োজন কীসের? কীসের জন্য তৃতীয় ঢেউ সামলাতে মোদি সরকার ২৩ হাজার কোটি টাকা আগামী কয়েক মাসে অক্সিজেন, হাসপাতালের শয্যা আর আনুষঙ্গিক পরিকাঠামো তৈরিতে খরচ করার প্ল্যান করেছে। কীসের জন্য গত মে মাসে বিদেশ থেকে পর্যন্ত অক্সিজেন আনতে হয়েছে। কেন হঠাৎ অক্সিজেন অডিট, গত এপ্রিল ও মে মাস জুড়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন সরবরাহ সাময়িক বন্ধ করা হয়েছিল, এ প্রশ্ন উঠবেই। আর কোনও সংবাদপত্র নদীতে লাশের সারি, অক্সিজেনের অভাব, রেমডিসিভিরের কালোবাজারি নিয়ে কলম ধরলেই অফিসে ভয় দেখানো তল্লাশি অভিযান হবেই। সত্যের উদ্ঘাটন ও তার উল্টোদিকেই শাস্তির খাঁড়া, এই চিরকালীন দ্বন্দ্ব ও  টানাপোড়েনের আবর্তেই আদর্শ সাংবাদিকের জীবনপণ লড়াই। অধিকাংশই আপস করে নিলেও যুগে যুগে শিরদাঁড়া সোজা করে কেউ না কেউ ঠিক মাথা তুলবেই। যতই বাধা বিঘ্ন চাপ আঘাত আসুক সেই জীবন বাজি রাখা অনুসন্ধান থেকে সাংবাদিকরা কোনওদিন বিরত হন না। এবারও ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সেই অগ্নিপরীক্ষার জন্য প্রস্তুত।

25th     July,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ