বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, দায় কার?
মৃণালকান্তি দাস

জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা পুত্র সঞ্জয় গান্ধী অতি-সাংবিধানিক ক্ষমতা ভোগ করেছেন। তাঁর নির্দেশে, পরিবার পরিকল্পনার নামে ১৯৭৫-৭৭ সালে কুড়ি মাসে এক কোটিরও বেশি মানুষকে নাসবন্দি (বন্ধ্যাত্বকরণ) করা হয়েছিল। সেদিন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আইন আনার বন্দোবস্ত করতে সংবিধান সংশোধন করে পরিবার পরিকল্পনাকে সংবিধানের যৌথ তালিকায় আনা হয়েছিল। যাতে কেন্দ্র এই বিষয়ে আইন আনতে পারে। সঞ্জয় গান্ধীর সেই যুগ থেকে দুনিয়া আজ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। সঞ্জয় গান্ধীর পরে মোরারজি দেশাই থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ি, মনমোহন সিং সরকারের আমলেও কেন্দ্র স্বেচ্ছায় পরিবার পরিকল্পনার নীতিতেই ভরসা রেখেছে। বাজপেয়ি সরকারের আমলে বেঙ্কটাচেলিয়া কমিশন আইনের সুপারিশ করলেও তা হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু ইউনিসেফের একটা রিপোর্ট সেই আলোচনাকে ফের ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। সম্প্রতি ইউনিসেফের সেই রিপোর্ট জানিয়েছিল, ২০১৯-এর প্রথম দিনে এই গ্রহে জনসংখ্যা বেড়েছে ৩ লক্ষ ৯৫ হাজার ৭২, আর ভারত সবার শীর্ষে উঠে প্রায় ৭০ হাজার সদ্যোজাতকে স্বাগত জানিয়েছে। চীনের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটি ৪৪ হাজার ৯৪০। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হিসেব বলছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই পয়লা নম্বরে চলে আসবে ভারত। অথচ, ১৯৫২ সালে গঠিত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভারতই প্রথম দেশ, যে পরিবার পরিকল্পনার বিষয়টিকে ‘জাতীয় নীতি’ হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
ভয়ঙ্কর এই তথ্যে দুনিয়ার কাছে মুখ লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল নয়াদিল্লি। সেই বছরই স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পরিবার পরিকল্পনাকে ‘দেশপ্রেম’-এর সঙ্গে জুড়েছিলেন। ছোট পরিবার সুখী পরিবারের পুরনো মন্ত্র শুনিয়েছিলেন। তারপর থেকেই ভারতীয় জনতা পার্টির বিবিধ নেতানেত্রীর বয়ানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের আহ্বান ধ্বনিত হচ্ছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কর্ণধার মোহন ভাগবত সঙ্ঘের বৈঠকে জানিয়েছেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণই তাঁদের পরবর্তী কর্মসূচি।
বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে শুরু হয়েছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কড়া আইন আনার তোড়জোড়। জানুয়ারি ২০২১ থেকে অসমে চালু হয়েছে দুই সন্তান নীতি। রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের উক্ত তারিখ থেকে এক বা একাধিক বিবাহ সূত্রে দুইয়ের বেশি সন্তান হলেই চাকরি চলে যাবে। এবং যাদের এখনও চাকরিতে নিযুক্তি হয়নি, তাদের কারও একইভাবে দুইয়ের অধিক সন্তান থাকলে রাজ্য সরকারের কোনও পদে আবেদন করার যোগ্যতা আর থাকবে না। এমনই কড়া আইন এনে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি দুই সন্তানের নীতি কার্যকরী করতে চাইছে। উত্তরপ্রদেশ, কর্ণাটকেও। বিরোধীদের দাবি, ভারতের বর্তমান শাসকরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নব উদ্যমে যা শুরু করেছেন তাতে অশিক্ষা এবং অভিসন্ধি— দুইই প্রকট।
বিজেপি নেতা, আইনজীবী অশ্বিনী উপাধ্যায় সুপ্রিম কোর্টে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইনের দাবিতে মামলা করেছিলেন। সেই মামলাতেই মোদি সরকার জানিয়েছিল, সরকার পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে কোনও রকম জোরাজুরির বিরুদ্ধে। সরকারি তথ্য বলছে, এমনিতেই দেশে জন্মহার কমছে। অধিকাংশ দম্পতিই এখন দু’টির বেশি সন্তান নিতে চান না। দেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি একেবারেই মানুষের ইচ্ছের উপরে নির্ভরশীল। স্বামী-স্ত্রী পরিবারের সদস্যের সংখ্যা ঠিক করেন। সেখানে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। সরকারি অবস্থান এমন হলেও বিজেপি যেভাবে উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে ফের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিতর্ক বাঁধাতে চাইছে, তাতে বিরোধী শিবির নিশ্চিত, এর লক্ষ্য হল মেরুকরণ। বিজেপির আসল উদ্দেশ্য হল, নির্দিষ্ট একটি ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অভিযোগ তোলা। ‘ওদের তো চারটে বৌ, ডজন দুয়েক বাচ্চা প্রতি ঘরে’—এই কথাগুলি আমাদের মুখের লব্জ। এগুলোর চেয়ে বেশি মিথ্যে কথা আর নেই, আর বিজেপি ভরসা করে আছে অনেকদিন ধরে একটু একটু করে বানানো এই পোক্ত মিথ্যাচারের উপরেই। বিজেপির যুক্তি, সন্তান দু’টির বেশি হওয়ার অর্থ দেশের জনসংখ্যার লাগামহীন বৃদ্ধি। কড়া হাতে এর মোকাবিলা না করলে সমস্ত ন্যাচারাল রিসোর্স কম পড়বে। সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যাবে না পাওনা সুযোগসুবিধা। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সাম্যাবস্থার জন্য এই আইন খুব জরুরি। নাহলে কোনও বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়েই যাবে, আর সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে অন্যান্য সম্প্রদায়গুলি। সংখ্যালঘুকে সমস্ত রকম চাপে রেখে সংখ্যাগুরুর সমর্থন এককাট্টা করার যে পন্থা বর্তমান শাসকরা একমনে অনুসরণ করে চলেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে এই সব হিসেবনিকেশের অন্তরালে নিহিত অভিসন্ধিটি আর অন্তরালে থাকে না।
জনগণনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুসলিমদের জনসংখ্যা বাড়ছে ঠিকই। কিন্তু স্বাধীনতার পরে ষাট বা সত্তরের দশকে যে হারে মুসলিমদের জনসংখ্যা বাড়ত, এখন আর সে হারে বাড়ছে না বলেই জনগণনার হিসেব। দেশে দশ বছর অন্তর যে জনগণনা হয়, তার পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি দশ বছরে মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধাপে ধাপে কমে আসছে। যদিও আরএসএস কোনও রাখঢাক না করেই জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য মুসলিমদের দায়ী করে এসেছে। সঙ্ঘ পরিবারের নেতাদের আশঙ্কা, এ দেশে হিন্দুরা একসময় সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন। আরএসএসের দাবি, ১৯৫১ সালে মুসলিম ছাড়া বাকি ধর্মের মানুষরা ছিলেন জনসংখ্যার ৮৮ শতাংশ। ২০১১-এ তা ৮৩.৮ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু এই আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন দেশে জনগণনার ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জেনারেল ও সেন্সাস কমিশনারের কর্তারাই। আরএসএস বলছে, ১৯৫১ থেকে ২০১১— দেশের মোট জনসংখ্যায় মুসলিমদের হার ৯.৮ শতাংশ থেকে ১৪.২৩ শতাংশে পৌঁছেছে। কিন্তু জনগণনার হিসেব বলছে, ২০০১-র তুলনায় ২০১১-তে মুসলিমদের সংখ্যা ২৪.৬ শতাংশ বেড়েছে। যেখানে তার আগের দশকে, অর্থাৎ ১৯৯১-র তুলনায় ২০০১-তে মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ছিল ২৯.৫ শতাংশ। আগের দশকগুলিতে সেই হার ৩০ শতাংশের বেশি। হিন্দু-খ্রিস্টানদের মতো মুসলিমদের মধ্যেও শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়ায় জন্মের হার কমতে শুরু করেছে। অথচ, ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে ভারতের শাসকরা ষাটের দশকের দাঁড়িপাল্লায় হিন্দু এবং মুসলিমের জন্মহার মাপছেন। আসলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও লক্ষ্য বিভাজন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে ফের মেরুকরণও উস্কে দিচ্ছেন তাঁরা।
জনগণনা বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, এ দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত পরিকাঠামো ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি বা নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি। শিক্ষার প্রকৃত প্রসার, ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জেহাদ এবং সঙ্কীর্ণ রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিরোধ করতে যা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের এক গবেষণায় জানা গিয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০১৬— এই আট বছরে এ দেশে জন্মরোধের সামগ্রী ব্যবহার কমেছে ৫২ শতাংশ, পাশাপাশি বন্ধ্যাত্বকরণ হ্রাস পেয়েছে ৭৩ শতাংশ। দেখা গিয়েছে, গত আট বছরে জন্মনিয়ন্ত্রণে এ দেশের মহিলারা উদ্যোগী হলেও পুরুষেরা এ বিষয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যান। একে ‘পৌরুষ হরণের চক্রান্ত’ বলেও চিহ্নিত করা হয়। এর প্রকৃত সমাধানে সর্ব স্তরে প্রয়োজন সক্রিয় উদ্যোগ বা গণ-সচেতনতা। অথচ বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে নেতা-মন্ত্রী-সহ ক্ষমতাশালী বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের তেমন উচ্চবাচ্য শোনা যায় না— যেমন ভাবে ভোটের স্বার্থে সব সমস্যার সমাধান করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে তাঁরা প্রবল ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
বিশেষজ্ঞদের কথায়, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ— এই ক্ষেত্রগুলিতে দুর্দশা, নিরক্ষরতা, ভয়াবহ বেকারি, দারিদ্র, অনুন্নয়ন— সবের সঙ্গেই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সম্পর্কটি গভীর। ইতিমধ্যে যে বিপুল জনসমষ্টি, বিশেষত অল্পবয়স্করা, শিক্ষা ও কাজের দুনিয়ায় প্রবেশ করেছে, তাদের এক বিরাট অংশের চাহিদা অপূর্ণ। শিক্ষার মান অনেকাংশেই ভয়াবহ, কর্মসংস্থানের চিত্র আতঙ্কজনক, যাঁদের কাজ আছে তাঁদেরও অধিকাংশেরই কাজের গুণমান অত্যন্ত খারাপ। এই সমস্যা মোকাবিলার উপায়, এক কথায়, শিক্ষার প্রসার, পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যের প্রসার, কর্মসংস্থানের প্রসার। অর্থাৎ, যথার্থ সর্বজনীন উন্নয়ন। সেই কাজটি সাধন করতে পারলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাকি কাজটুকুও আপনিই সম্পন্ন হবে, জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য কোনও অ-গণতান্ত্রিক জবরদস্তির নীতি ঘোষণা করার প্রয়োজন হয় না। এই কার্যকারণ সূত্রটি দুনিয়া জুড়ে প্রমাণিত। সংখ্যালঘু-সর্বস্ব ঠুলিটি চোখ থেকে সরিয়ে মোদিজি যদি একবার বাস্তবকে দেখতে পারেন, তবে তিনি সর্বাগ্রে মুখ্যমন্ত্রী যোগীকে উত্তরপ্রদেশের জনশিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের প্রসারে মন দিতে বলবেন, তা হলেই জন্মহার নিয়ন্ত্রিত হবে— হিন্দুরও, মুসলিমেরও, অন্যদেরও। দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে তাই-ই হয়েছে। এরজন্য চোখ রাঙানির প্রয়োজন পড়ে না!
তথ্য বলছে, ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ দু’টি রাজ্যে বাস করে। বিহার এবং উত্তরপ্রদেশ। এই দু’টি রাজ্যেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অত্যন্ত বেশি। পরিসংখ্যান বলছে, ‘ফার্টিলিটি রেট’ (প্রজননক্ষম বয়সে একজন নারী গড়ে যত সন্তানের জন্ম দেবেন বলে প্রত্যাশিত)-এ সবচেয়ে এগিয়ে বিহার। সে রাজ্যে এই হার সাড়ে ৩ শতাংশেরও বেশি। শুধু বিহার নয়, ২০১১-র জনসুমারির ভিত্তিতে উত্তরপ্রদেশ-সহ উত্তর ভারতের প্রতিটি রাজ্যই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে অনেক এগিয়ে ছিল। অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতের সবগুলি রাজ্যেই ‘ফার্টিলিটি রেট’ ২-এর কম। পশ্চিমবঙ্গেও তা ২-এর কম। অর্থাৎ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গ তুলনায় অনেকটাই সফল। ‘ফার্টিলিটি রেট’ সবচেয়ে কম পড়শি রাজ্য সিকিমে। মাত্র ১.৫।
দুনিয়ার অভিজ্ঞতা বলে, সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটলেই পরিবারের আয়তন স্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। জবরদস্তি জন্মনিয়ন্ত্রণের ফল শেষ পর্যন্ত ক্ষতিকর হতে বাধ্য, চীন তার সাক্ষ্য বহন করছে।

22nd     July,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ