বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

একুশে জুলাইয়ের
লড়াই শেষ হয়ে যায়নি
সন্দীপন বিশ্বাস

বাংলার ইতিহাসে একুশে জুলাই এক প্রতিবাদের দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। অত্যাচারী সিপিএম শাসকের বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালে একুশে জুলাই অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার গণতন্ত্রকামী মানুষ জ্যোতি বসুর সরকারের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যেভাবে দিনের পর দিন গণতন্ত্রকে হত্যা করে নির্বাচনের নামে প্রহসন চালাচ্ছিল সেই সরকার, তার বিরুদ্ধে সেদিন প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন সারা বাংলার মানুষ।
যদিও সেদিন সেই লড়াই হয়েছিল যুব কংগ্রেসের ব্যানারে, তবুও সেই লড়াই ছিল মমতার একক লড়াই। সেদিন কংগ্রেসের ভিতরে বহু মানুষ, যাঁরা তলে তলে জ্যোতিবাবুদের প্রসাদ ভোগ করতেন, তাঁরা সেদিন আন্দোলনে শামিল হননি। বরং এই আন্দোলন বন্ধ করতে অনেক কলকাঠি নেড়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। আজও অনেক কংগ্রেস নেতা সিপিএমের পালে হাওয়া দিয়ে তাঁদের সঙ্গে গলায় গলায় ভাব জমিয়ে পারস্পরিক অস্তিত্ব বজায় রাখার জোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। শহিদের রক্তের মূল্যের থেকেও স্বার্থভিত্তিক বাঁটোয়ারা তাঁদের কাছে অনেক বেশি মূল্যবান। সেই দুরভিসন্ধিমূলক জোটকে এবারের নির্বাচনে মানুষ আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন।  
সেদিন সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের সেই সাঁড়াশি আন্দোলনে দিশাহারা হয়ে পড়েছিল জ্যেতিবাবুর সরকার। মুহুর্মুহু খবর আসছে, রেড রোড, ব্রেবোর্ন রোড, মেয়ো রোড, কার্জন পার্ক, ধর্মতলা দিয়ে থেকে হাজার হাজার মানুষ এগিয়ে আসছেন। তাঁরা টি বোর্ড পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছেন। কাণ্ডারী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই আন্দোলনে সেদিন শামিল ছিলেন সৌগত রায়, মদন মিত্র, পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। সেই আন্দোলনের খবর সেকেন্ডে সেকেন্ডে পৌঁছে  যেতে লাগল মহাকরণে। প্রমাদ গুনলেন জ্যোতিবাবু। সব অগণতান্ত্রিক শাসক ভয়ে ভীত হয়ে যেভাবে বাহুবল প্রয়োগ করে, রাষ্ট্রীয় গুন্ডামিকে অবলম্বন করে আন্দোলনের মোকাবিলা করে, কমিউনিস্ট শাসক জ্যোতিবাবুও তার বাইরে গেলেন না। তিনি শাসনযন্ত্রের ভিতকে অটুট রাখতে ভরসা করলেন তাঁর পুলিস বাহিনীর উপর। পুলিস আর তখন পুলিস রইল না। অস্ত্র হাতে সরকারের সিলমোহর মারা এক গুন্ডাবাহিনীতে পরিণত হল। চারিদিকে গুলির পর গুলি চলল, মাঠে নেমে পুলিসের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী বেধড়ক লাঠি চালাল। মহাকরণের আশপাশে শহরের কংক্রিকেটর পথ রক্তে ভিজে গেল। মুখ থুবড়ে পড়ে নিশ্চল হয়ে গেল তেরোটি তাজা প্রাণ। সেই রক্তের ছিটে পরোক্ষে ছিটকে গিয়ে লেগেছিল মহাকরণের ঠান্ডা ঘরে বসে থাকা কমিউনিস্ট জ্যোতিবাবুর সাদা ধবধবে পোশাকে। এভাবেই একদিন ‘গণতন্ত্র রক্ষা’র নামে রাশিয়ায় স্তালিন হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছিলেন। স্তালিনের সেই স্বৈরাচার হিটলারকেও লজ্জা দেবে। একুশে জুলাইয়ের সেই কলঙ্কিত ইতিহাসকে জ্যোতিবাবুরা কোনওদিন মুছে ফেলতে পারবেন না। রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার সেদিন স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল। ভোটযন্ত্রকে কুক্ষিগত করে, মানুষের উপর অত্যাচার করে, গ্রামে গ্রামে বিরোধীদের ঘর জ্বালিয়ে, তাঁদের গ্রামছাড়া করে, মা ও স্ত্রীর সামানে স্বামী-পুত্রকে নির্বিচারে হত্যা করেছে সিপিএম। বিরোধীদের ভোট দেওয়ার জন্য নির্মমভাবে কেটে নেওয়া হয়েছিল ডানহাত। পশ্চিমবঙ্গের সব গ্রামে ছিলেন একজন করে অত্যাচারী মজিদ মাস্টার। আজ সূর্য, বিকাশ, সুজন, সেলিমদের মুখে গণতন্ত্রের কথা মানায় না। এ রাজ্যে তাঁদের অত্যাচারের কথা ভুলতে আরও দুই-তিন প্রজন্ম সময় লাগবে। আপাতত তাঁরা অর্ধশতাব্দী শীতঘুমে থাকুন।
একুশের লড়াইয়ে নিহত শহিদদের স্মরণ করতে প্রতি বছর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন মমতা। সেদিনের আন্দোলনের প্রয়োজন কি আজ ফুরিয়েছে? কেননা সেই আন্দোলনের পথ ধরেই দিনে দিনে সচেতন হয়েছেন মানুষ, নির্ভয় হয়েছেন মমতার নেতৃত্বে। রাজ্যে দশ বছর অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে মমতার নেতৃত্বে সরকার। মমতা আজ শুধু এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নন, তিনি দিদি হয়ে মায়ের মমতা দিয়ে সুখে দুঃখে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন অবিচল। 
সিপিএমের জমানা খতম হয়েছে বলেই কিন্তু একুশে জুলাইয়ের তাৎপর্য ও প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে, এটা ভাবলে চলবে না। সেই লড়াইয়ের প্রেক্ষিত আজ যেমন ভিন্নতর, তেমনই তার ক্ষেত্রও অনেক বেশি প্রসারিত। অন্ধ শাসকের প্রতিহিংসার আগুনে আজ এই রাজ্য ও দেশ আক্রান্ত। বিদ্বেষের রক্তচক্ষু, ধর্মান্ধতার বিষ নিশ্বাস, কুশাসনের নিষ্পেষণে দেশ আজ দিশাহারা। বর্তমানে দেশের মোদি সরকার এই দেশকে পিছন দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। মানুষকে ধর্মের তুলাদণ্ডে ওজন করে তার শ্রেণিবিভাগ করতে চাইছে। ধর্মের ভিত্তিতে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে মানুষের মধ্যে। কেননা তারা জানে, এভাবেই টিকে থাকতে হয়। 
একুশে জুলাইয়ের তাৎপর্য আজ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। কেননা একুশে জুলাই মানে একটা তারিখ নয়। একুশে জুলাই মানে শুধু শহিদ স্মরণ নয়, একুশে জুলাই মানে শুধু বিশাল সভা  নয়, একুশে জুলাই মানে আরও একটা লড়াইয়ে ইশারা, একুশে জুলাই মানে আরও একটা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। একুশে জুলাই মানে ধর্মান্ধ, ব্যর্থ মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বজ্রমুষ্ঠি তুলে ‘দূর হটো’ বলার ব্রাহ্মমুহূর্ত। শাহিনবাগে যে আন্দোলন পুঞ্জীভূত হয়, সেই লড়াইয়ের সঙ্গে একুশে জুলাইয়ের আত্মিক যোগ রয়েছে। কৃষক আন্দোলন যখন মোদি সরকারের সিংহাসনকে নড়িয়ে দেয়, তার সঙ্গে একুশে জুলাইয়ের আত্মিক যোগ রয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে যখন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতা চ্যুত করা হয়, তখন মনে হয় এও এক একুশে জুলাইয়ের আন্দোলন। 
গত সাত বছর ধরে মোদিবাবুর একের পর এক ব্যর্থতা মানুষকে মৃত্যুর দরজা দেখিয়ে দিচ্ছে। মোদিজি যত কোণঠাসা হচ্ছেন, যত মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হচ্ছেন। যত তাঁর জনপ্রিয়তা কমছে, ততই তিনি স্বৈরাচারী হয়ে উঠছেন। 
১৯১৭ সালে বিপ্লবে জয়লাভের পর লেনিনও কিন্তু দেশ চালাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি ভয় পেতেন, হয়তো গোপনে তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হয়ে উঠবে। উঠেছিলও তাই। সেই বিদ্রোহকে দমন করতে লেনিন চেকা বাহিনী গঠন করেছিলেন। এদের কাজ ছিল, যাঁরাই লেনিন বা বলশেভিক বিরোধী, তাঁদেরই হত্যা কর। চেকা ছিল বলশেভিক পার্টির নিজস্ব গুপ্ত গুন্ডাবাহিনী। তারা কোনও আইনের তোয়াক্কা করত না। পৃথিবীর শাসকদের মধ্যে সব সময় পাল্টা বিপ্লবের আতঙ্ক কাজ করে। হিটলারের ভাবনার মধ্যে যেমন ছিল মৌলবাদ, লেনিনও ভাবনার সেই মৌলবাদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। লেনিন মনে করতেন, যাঁরাই তাঁর বিরোধী, তাঁরাই দেশদ্রোহী। তাঁরা রাশিয়ার উন্নতির পথে কাঁটা। তাঁদের শেষ করে দাও। মোদির ভাবনার মধ্যেও এই মৌলবাদ প্রকাশ পাচ্ছে, যাঁরা হিন্দু নন, যাঁরা বিজেপি নন, যাঁরা মোদির সমর্থক নন, তাঁরাই দেশদ্রোহী। মোদি গুরুঠাকুরের ভাবনার উপর সংশয় প্রকাশ করা চলবে না। প্রশ্নহীন আনুগত্যেই তাঁর দিলখুশ। বাংলাদেশে যেমন বহু মুক্তচিন্তার মানুষ মুসলিম মৌলবাদের হিংসার বলি হয়েছেন। আমাদের দেশেও বহু মুক্তচিন্তার মানুষ গৈরিক মৌলবাদের বলি হয়েছেন। তার শেষতম দৃষ্টান্ত স্ট্যান স্বামী। মোদি সরকারের এনআরসি ভাবনা, সিএএ ভাবনা, কৃষক বিরোধী আইন তৈরির ভাবনা, বড়লোকদের আরও বড়লোক করে দেওয়ার ভাবনা সেই মৌলবাদকেই ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করে চলেছে। গেরুয়া ভাবনার শিকার আজ রবীন্দ্রনাথ থেকে  রাধাকৃষ্ণন পর্যন্ত। সবরকম মুক্ত ভাবনার মানুষকে আড়াল করে কুশিক্ষার পাঠ দেওয়ার ব্যবস্থা করছে বিজেপি সরকার। যে শিক্ষা অন্ধ ভক্তিবাদ শেখাবে, যে শিক্ষা মাথা নত করে দাসত্ব করার মানসিকতা গড়ে তুলবে, সেই শিক্ষার জোয়ারে আজ দেশকে ভাসাতে চাইছে গেরুয়া মৌলবাদ। তাদেরও নিজস্ব ওইরকম চেকা বাহিনী রয়েছে। বিরুদ্ধ স্বরের কণ্ঠরোধ করতে ইউএপিএ আইন করে রেখেছে। এও তো মৌলবাদ, অগণতান্ত্রিক ভাবনা।
সেই সঙ্গে নির্লজ্জভাবে মানুষের ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে। এটা গণতন্ত্র! নগ্ন নির্লজ্জতা আজ কেন্দ্রীয় শাসকের ভূষণ। রাষ্ট্রযন্ত্রের সুরক্ষা কবচের শক্তির জোরে পেগাসাসের ব্যবহার সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং জঘন্যতম অপরাধমূলক কাজ। দেশের মানুষের আজ ন্যূনতম সুরক্ষাটুকুও নেই। মোদি আজ এক অন্ধ ভুবনের দিক নির্দেশক।
তাই লড়াইয়ের প্রেক্ষিত আজ ভিন্নতর। আরও অনেক বড় লড়াইয়ের অপেক্ষায় আগামী দিন। আরও বৃহত্তর শক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত হতে চলেছে সেই লড়াই। পেট্রপণ্য, গ্যাসের দাম, ব্যাঙ্কের প্রায় গঙ্গাপ্রপ্তি, দেশের সম্পত্তি বেসরকারিকরণের নিষ্পেষণে আমরা প্রতিদিন তিল তিল করে মরছি।  এর থেকে পথ দেখাতে পারে একুশে জুলাই। আজ একুশে জুলাই হয়ে উঠতে পারে একটা অপ্রতিরোধ্য শক্তির ব্যঞ্জনা। রাজ্যে স্বল্প পরিসরের বাইরে বেরিয়ে সারা দেশকে অনুপ্রাণিত করতে পারে একুশে জুলাইয়ের লড়াই। সেই লড়াইয়ের যোগ্য নেতৃত্ব দিতে পারেন একজনই। তিনি হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়। সারাদেশে তিনি হয়ে উঠেছেন মোদির অক্ষম শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জননী। দেশকে পথ দেখাক আরও একটা একুশে জুলাইয়ের লড়াই। জয় হোক একুশের।     

21st     July,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ