বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

একনায়কতন্ত্রের নজরদারি
শান্তনু দত্তগুপ্ত

ঠিক দু’বছর আগের কথা। মার্চ মাস। মুখোশ পরা একটা দল আচমকা হানা দিল রিনশাদ রিরার বাড়িতে। হাতে তাদের লোহার রড, আর লাঠি। কোনওরকমে পালালেন রিনশাদ। এক পড়শির বাড়িতে ঢুকে আশ্রয় নিলেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই মুখোশধারীরা হুমকি দিয়ে গেল, খুব সাবধান। মুখ বন্ধ না করলে নাজিব আহমেদের মতো অবস্থা হবে...। কে এই নাজিব? দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষের ছাত্র। ২০১৬ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তিনি নিরুদ্দেশ। ঠিক আগের রাতে তাঁর হস্টেলের ঘরে চড়াও হয়েছিল এবিভিপির ধ্বজাধারী কয়েকজন দুষ্কৃতী। সেটাই শেষ। মা ফতিমা নাফিজ কেঁদেছেন... পুলিস থেকে আদালত, সব দরজায় ঘুরেছেন। কিন্তু ছেলেকে ফিরে পাওয়া যায়নি। কখনও প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে, নাজিব আইসিস জঙ্গি গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছেন। কখনও মেডিক্যাল রিপোর্ট খাড়া করে বলা হয়েছে, ও তো মানসিক ভারসাম্যহীন! নিজেই কোথাও একটা চলে গিয়েছে। কিন্তু কোথায়? জানা যায়নি। প্রমাণও হয়নি। তাহলে রিনশাদকে যারা বাড়ি বয়ে এসে হুমকি দিয়ে গেল, তারাই কি জানত উত্তরটা? কী অপরাধ ছিল রিনশাদের? কাশ্মীর, মণিপুরের সার্বভৌমত্বের দাবিতে সরকারের ভূমিকার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি। ফলস্বরূপ রিনশাদের বিরুদ্ধে ১২৪(ক) ধারায় মামলা হয়েছিল। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। সময়টা ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ঘোরতর মোদি জমানা।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যানি বাবু। বছর তিনেক আগে আচমকাই জানতে পারলেন, তাঁকে এনআইএ’র সঙ্গে যেতে হবে। সামান্য জিজ্ঞাসাবাদ আর কী! অফিসাররা জেরা করলেন। বারবার একটাই প্রশ্ন, ২০১৭ সালে কেরলে গিয়েছিলেন তো... সেই ব্যাপারে বলুন। আপনার স্ত্রী জেনি রোয়েনা ছাড়া আর কে ছিল সেই সফরে? রোনা উইলসন? কী কী কথা হয়েছিল আপনাদের মধ্যে? হ্যানি বাবু আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁদের তিনজনের কথপোকথনের প্রায় হুবহু তিনি উল্টোদিক থেকে শুনছেন। অথচ, এর কিছুই তাঁদের জানার কথা নয়! রোনা উইলসনকে আগেই গ্রেপ্তার করেছিল এনআইএ। আর তার কিছুদিন পর হ্যানি বাবুকে। পেগাসাস স্পাইওয়্যারের তথ্যভাণ্ডারে এই দু’জনেরই ফোন নম্বরের হদিশ মিলেছে। থিওরি বলছে, তথ্যভাণ্ডারে কোনও ফোন নম্বর থাকা মানেই তার উপর নজরদারি চলছে... এমনটা নয়। তাহলে সরকারি এজেন্সি কীভাবে তাঁদের ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলি জানতে পেরে গিয়েছিল? ম্যাজিক নাকি? আজ আমরা জানি, পেগাসাস ফোনে ঢুকিয়ে দিতে পারলে এই ম্যাজিক সম্ভব। হোয়াটসঅ্যাপে একটা ভয়েস কল, বা মিসড কল হলেও চলবে। পেগাসাস ঢুকে পড়বে মোবাইলে। তারপর সেই মিসড কল মুছেও দেওয়া যায়। আপনি-আমি জানতেও পারব না। তাহলে নজরদারির অঙ্কটা একেবারে ফেলে দেওয়া যায়?
না যায় না। পেগাসাস প্রস্তুতকারক সংস্থাটি ইজরায়েলের। সেই এনএসও দাবি করে, সরকার ছাড়া আর কাউকে এই প্রযুক্তি তারা বিক্রি করে না। ২০১৯ সালে রাজ্যসভায় তৎকালীন তথ্য-প্রযুক্তিমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ সাফাই দিয়েছিলেন। 
তিনি কিন্তু একবারও বলেননি যে, ভারত সরকার এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে না। তাঁর বক্তব্য ছিল, বেআইনিভাবে আড়ি পাতা হয়নি। অর্থাৎ, যদি আড়ি পাতা হয়েও থাকে, তাহলে তার নেপথ্যে সরকারি আদেশ ছিল। তাই কি আজ অধিকারে হস্তক্ষেপের হাইপ্রোফাইল তালিকায় নাম আসছে তিন বিরোধী নেতা-নেত্রী, দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা ৪০ জনেরও বেশি সাংবাদিকের?
সমালোচনা চলবে না... পোস্টার মারা যাবে না... বেসুরো হওয়া যাবে না। তাহলেই বন্ধ হয়ে যাবে মুখ। সরকার বিরোধিতা আবার কী! সে তো রাষ্ট্রদ্রোহ! রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে না হয় তেমন কিছু বলা যায় না। তারা সব সময় প্রচারে থাকে। সাধারণ মানুষ জেনে যাবে। ওঁদের সমর্থকরা বুঝে যাবে সরকারের অভিপ্রায়। কিন্তু একজন শিক্ষক কী করবে? বা কোনও সমাজকর্মী, কার্টুনিস্ট, ছাত্র বা সাংবাদিক...! কিস্সু না। সেই ক্ষমতা তাদের নেই। বরং রয়েছে প্রচুর সীমাবদ্ধতা। সামাজিক জীব হয়ে থাকার... ক্ষমতার তালুর নীচে বন্দি থাকার। তাই রিনশাদের মতো ছাত্রদের বলার অধিকার নেই। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার। প্রয়োগ হয় ১২৪(ক) ধারা। তাই হস্তক্ষেপ হয় বাক স্বাধীনতায়, মত প্রকাশের ইচ্ছায়,  মৌলিক অধিকারে। কোন আস্পর্ধায় একজন নাগরিকের উপর নজরদারি চালানোর ছাড়পত্র পায় একনায়কতন্ত্রীরা! আপনারাই নাকি আবার ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সুর চড়ান? আপনারাই ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার নামে গাল পাড়েন? ইমার্জেন্সি মানে কী? এক কথায় মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। আপনারা যা করছেন, তা কি অন্য কিছু? অমুকের ফোনে আড়ি পাতা, তমুকের ল্যাপটপে বিতর্কিত নথি পুরে দেওয়া... আর তারপর রাষ্ট্রদ্রোহের দায়। সুপ্রিম কোর্টই কিন্তু বিতর্কিত এই আইন নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। তারপরও কি হুঁশ ফিরেছে? না ফেরেনি। শুধুমাত্র গাড়ির কাচ ভাঙার জন্য কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে ১২৪(ক) আইনে। প্রতিবাদ আর রাষ্ট্রদ্রোহ কি এক পঙক্তিতে বসে? তাহলে নাৎসিদের সঙ্গে আপনাদের কী ফারাক? ব্রিটিশ শাসকদের থেকে আপনারা কোথায় আলাদা? ‘দ্য কান্ট্রিস মিসফরচুন’ (দেশের দুর্ভাগ্য) এবং ‘দিস রেমেডিস আর নট লাস্টিং’ (এই ওষুধে কাজ হবে না)—ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে এমন প্রবন্ধ লেখার জন্য জেল হয়েছিল লোকমান্য তিলকের। দু’বার এই বিতর্কিত ঔপনিবেশিক আইনের শিকার হয়েছিলেন তিনি। সশ্রম কারাদণ্ডে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন বার্মাতেও। আর মোদিজি, আপনার জমানায় অশীতিপর, প্রায় অন্ধ এক বৃদ্ধকে কাতরে কাতরে মৃত্যুবরণ করতে হয়। ফাদার স্ট্যান স্বামী সন্ত্রাসবাদী ছিলেন কি না, তা আইন ঠিক করবে (ন্যায়বিচার পেলে)। কিন্তু একজন ভারতীয়ের এমন পরিণতি কি কাঙ্ক্ষিত? একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান... নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে বিতর্কিত রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে ৩২৬টি মামলা দায়ের হয়েছে। আর দোষী সাব্যস্ত? মাত্র ছয়। ১২৪(ক) ধারায় সবচেয়ে বেশি মামলা মোদি সরকার চাপিয়েছে অসমে—৫৪টি। তার মধ্যে ২৬টি মামলায় চার্জশিট দাখিল হয়েছে এবং ২৫টির ফয়সালা। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, একজনও কিন্তু এই মামলাগুলিতে দোষী সাব্যস্ত হননি। তাহলে কেন এই বদমায়েশি? অস্ত্র হাতে ধরলেই হয় না... তার ব্যবহারের উপর নির্ভর করে সেই হাতিয়ারের সাফল্য। নাগরিক সুরক্ষায় অস্ত্র ব্যবহার হলে তা স্বস্তি আনে। আর যদি তা নাগরিকের কণ্ঠস্বর দাবিয়ে দেওয়ার জন্য হয়? গণতন্ত্রে সেটাই সবচেয়ে বড় হুঁশিয়ারি। আতঙ্ক। 
এই আতঙ্ক আজ দানা বেঁধেছে ঘরে ঘরে... মোবাইল ফোনে, ল্যাপটপে। পেগাসাসের হানাদারির আওতায় কারা আছেন? বিরোধী নেতানেত্রীদের মধ্যে শোনা যাচ্ছে রাহুল গান্ধী, প্রশান্ত কিশোর, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। পিকে সদ্য সমাপ্ত বাংলার বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের জয়ের কারিগর। আর অভিষেক নিজেই দলের কার্যত সেকেন্ড ইন কমান্ড। এই দু’জনের ফোন ট্যাপ করলেই মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যায়—অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কারা? মজার ব্যাপার, একজন অশ্বিনী বৈষ্ণব। নিজেই এখন তথ্য-প্রযুক্তিমন্ত্রী। তিনিই আড়ি পাতার ঘটনায় সাফাই গাইছেন সরকারের হয়ে। রয়েছেন প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসাও। কারণ তাঁর কাছে যুক্তি আগে, নিয়ম আগে... মোদি নন। খবর প্রকাশের আগেই অবশ্য নরেন্দ্র মোদি সরকার এক দিস্তা সাফাই গেয়ে রেখেছে। সারমর্ম একটাই, নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর নজরদারির অভিযোগ ভিত্তিহীন। তবে এবারও তারা জানিয়েছে, যে কোনও ফোনে আড়ি পাতা বা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে নজরদারিতে সরকারি অনুমতি এমনিতেই থাকে। যদি তা সন্দেহজনক হয়। এবং এই নজরদারি অবৈধ নয়। বেআইনি নয়। 
খুব শিগগিরই বোধহয় দেশের সংবিধানের আরও একবার সংশোধনের প্রয়োজন আছে। ১২ নম্বর থেকে ৩৫ নম্বর ধারা... যেখানে রয়েছে ভারতীয়দের মৌলিক অধিকারের ছাড়পত্র। আইন সবার জন্য সমান... ধর্ম বা জাতপাতের ভিত্তিতে বিভাজন চলবে না... মত প্রকাশ ও বাক স্বাধীনতা সবার অধিকার... এই সবই কেমন যেন আজ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। আমাদের নাগরিকত্বের এখন একটাই মাপকাঠি—জো হুজুর। মেরুদণ্ড থাকা আজ অপরাধ। মেনে নিতে হবে... সরকার যা বলবে, যা করবে... সবকিছু। না হলেই রাষ্ট্রদ্রোহের খাঁড়া ঝুলবে ঘাড়ের ঠিক উপরে। 
গণতন্ত্রে সরকার নির্বাচিত হয়। বন্দুকের নল এখানে ক্ষমতার উৎস নয়। আমরা আপনাদের বসিয়েছি সরকারে। আপনাদের ভুল হলে আমরাই সমালোচনা করব। এটাই গণতন্ত্র। এটাই আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। তা আর হচ্ছে কই? নাজিব আহমেদরা যে আজও নিরুদ্দেশ! জয় শাহের বিরুদ্ধে তদন্তমূলক খবর করার জন্য রোহিণী সিংয়ের উপর চলে নজরদারি। ছড়ি ঘুরছে মাথার উপর... আছড়ে পড়বে যে কোনও সময়... বাড়বে রাষ্ট্রদ্রোহীর সংখ্যা। ভারত বদলেছে। এ সত্যিই নতুন ভারত। স্লোগান একটাই—একনায়কতন্ত্রের ডিজিটালাইজেশন।

20th     July,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ