বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

দিল্লিতে বাংলার চার আব্বুলিশ
হারাধন চৌধুরী

‘হামে বাবুল চাহিয়ে।’—বক্তার নাম নরেন্দ্র মোদি। তিনি তখনও প্রধানমন্ত্রী নন। সারা ভারতে বিজেপির মুখ। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের প্রচারে মোদি উপস্থিত আসানসোলে। বলিউডের তারকা-গায়ক বাবুল সুপ্রিয়কে জিতিয়ে দেওয়ার আবদার করেছিলেন মোদি। তাঁর কথা শুনেছিল আসানসোল। 
সেবার বাংলা মোদিকে দু’জন এমপি দিয়ে (অন্যজন দার্জিলিং থেকে সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া) মন্ত্রী পেয়েছিল একজন। 
উনিশে আঠারো এমপি। তাহলে ক’জন মন্ত্রী পাওয়া উচিত? হিসেব কষতে বসেছিল বাঙালি। ভুলে গিয়েছিল—রাজনীতির অঙ্ক পাটিগণিত নয়, গণিতের সমস্ত শাখার অতিরিক্ত কিছু। ২০১৯-এ বাংলা পেয়েছিল দু’জন মন্ত্রী—বাবুল, সঙ্গী দেবশ্রী চৌধুরী। বাজপেয়ির পর, মানে দেড় দশক বাদে বিজেপি মন্ত্রিসভায় একসঙ্গে দু’জন মন্ত্রী বাংলা থেকে। কিন্তু তাঁরা দু’জনেই রাষ্ট্রমন্ত্রী। 
বাংলা থেকে কেন্দ্রে শেষবার পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের মুকুল রায় (রেলমন্ত্রী: ২০১২-র ২০ মার্চ-২১ সেপ্টেম্বর)। 
দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে বাঙালির সোনার দিন বলতে যা বোঝায় সেটা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেই অস্ত গিয়েছে। প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি ছিলেন ২০১২-র ২৫ জুলাই থেকে ২০১৭-র ২৫ জুলাই পর্যন্ত। রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দে বিচরণ বলতে তার আগের সময়টাকেই ধরতে হবে। রাইসিনা হিলের বাসিন্দা হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত প্রণববাবু ছিলেন মনমোহন সিংয়ের অর্থমন্ত্রী। ইন্দিরা গান্ধীর অর্থমন্ত্রী ছিলেন ১৯৮২-৮৪-তে। মনমোহন জমানায় প্রণববাবু প‍্রতিরক্ষা (২০০৪-০৬) ও বিদেশ মন্ত্রকের (২০০৬-০৯) গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও সামলেছেন। নরসিমা রাও-ও বিদেশমন্ত্রী (১৯৯৫-৯৬) করেছিলেন তাঁকে। এছাড়া, প্রণববাবু হয়েছেন কখনও কংগ্রেসের লোকসভার নেতা, কখনও রাজ্যসভার নেতা অথবা পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। 
তাঁর সম্পর্কে বহু উচ্চারিত কথাটাই খাঁটি, প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর সবকিছুই হয়েছেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী কেন হতে পারেননি সে প্রসঙ্গ তর্কসাপেক্ষ এবং অন্য। 
বড় আক্ষেপের বিষয় এই যে, ন’বছর পূর্ণ হতে চলল বাংলা থেকে কোনও পূর্ণমন্ত্রী নেই কেন্দ্রে। অটলবিহারী জমানায় বিজেপি/এনডিএ মন্ত্রিসভায় বাংলার দু’জন রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন: তপন শিকদার (১৯৯৯-২০০৪: যোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রক/ রসায়ন ও সার মন্ত্রক) এবং সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় (২০০০-২০০৪: রসায়ন ও সার/ বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রক)। তপনবাবুর আগে পরে কেন্দ্রে রাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন বাংলার আরও কয়েকজন। কিন্তু, তাঁদের মধ্যে কেউই তপনবাবুর মতো জনমানসে দাগ 
কাটতে পারেননি। যোগাযোগ বিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর অবদান বাংলার বহু মানুষ আজও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে। মানুষ তাঁকে টেলিফোনের মন্ত্রী হিসেবেই চিনত। কিন্তু সার ও রসায়ন মন্ত্রকে তাঁর দায়িত্বের কথা ক’জনের মনে আছে সন্দেহ। কথাটি অনুরূপভাবে সত্য তাঁর সতীর্থ সত্যব্রতবাবু বা কৃষ্ণনগরের জুলুবাবুর বেলাতেও। 
মোদি জমানায় বাবুল সুপ্রিয় টানা সাতবছর এবং দেবশ্রী চৌধুরী দু’বছরের বেশি রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তাঁরা কোন মন্ত্রকে ছিলেন? মন্ত্রী হিসেবে দেশ বা বাংলার জন্য তাঁদের অবদান কী? কোনও ক্যুইজে এই প্রশ্ন করা হলে, ক’জন নির্ভুল উত্তর দিতে পারবেন? খুব সন্দেহ আছে ক’জন জানেন যে বাবুল নগরোন্নয়ন, আবাসন ও শহুরে দারিদ্র দূরীকরণ (২০১৪-১৬); ভারীশিল্প ও রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ (২০১৬-১৯); পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন (২০১৯-২১) প্রভৃতি মন্ত্রকে দীর্ঘদিন দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। প্রশ্নটা একইভাবে রাখা যায় দেবশ্রী চৌধুরী সম্পর্কেও। একইরকম সংশয় আছে ঠিক ক’জন বঙ্গবাসী জানেন, এই ৭ জুলাই পর্যন্ত তিনি ছিলেন নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির ডেপুটি! 
রাজীব, নরিসমা বা মনমোহন জমানায় বাংলা আরও কম-সংখ্যায় কংগ্রেস/সহযোগী এমপি পাঠিয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা ভোগ করেছে দিল্লিতে। তারপরও অনেকের মনে হচ্ছে, বাবুল ও দেবশ্রীকে সরিয়ে, সদ্য সদ্য বাংলা থেকে চারজন নতুন রাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ করে মোদি ধামাকা করে ফেলেছেন! 
মন্ত্রিসভার এই সম্প্রসারণের ফলে কাদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল? বাঁকুড়ার সুভাষ সরকার, বনগাঁর শান্তনু ঠাকুর, আলিপুরদুয়ারের জন বারলা এবং কোচবিহারের নিশীথ প্রামাণিকের। মোদি বাংলা থেকে একজনকেও পূর্ণমন্ত্রী করতে পারলেন না! অথচ তাঁর হাতে বিজেপির টিকিটে জয়ী লোকসভার সদস্যই আছেন ১৮ জন। একটা দামি কথা চালু আছে, চিফ সেক্রেটারি ইজ দ্য গভর্নমেন্ট। যার মর্মার্থ হল—দক্ষ আমলারাই দপ্তর বা সরকার সামলে থাকেন। বেশিরভাগ মন্ত্রীই সাক্ষীগোপাল মাত্র, সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়মরক্ষার নিমিত্তই তাঁদের অবস্থান—কী রাজ্যে, কী কেন্দ্রে। 
ধরা যাক, বাংলা থেকে নির্বাচিত লোকসভার কোনও সদস্যকেই তেমন যোগ্য মনে করেন না মোদি। তাহলে রাজ্যসভা থেকে এক বা একাধিক ক্যাবিনেট মন্ত্রী করতে কোনও বাধা ছিল না। অশ্বিনী বৈষ্ণব বা ধর্মেন্দ্র প্রধানকে যেমন করা হয়েছে। 
আসলে, বাংলাকে এবং বাঙালিকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে শ্যামাপ্রসাদের পার্টির অনীহা আজও প্রবল। এই বেনিয়ার পার্টি তার ইয়া বড় পেট ভরে বাংলা থেকে শুধু পেতে চায়, দিতে চায় না হাত উপুড় করে।
এবার চারজন ‘আব্বুলিশ’ মন্ত্রী রাখার একটাই ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আরও বাগড়া দেওয়া, যেটা ধনকারকে দিয়ে হয়ে উঠছে না অনেক সময়। এই গুরুত্বহীন সম্প্রসারণে বাংলার কোনও লাভ হবে না। আঞ্চলিক বা সম্প্রদায়গত মলম লেপন কিছু হবে হয়তো,  কিন্তু ওই খণ্ডাংশেরও সামান্য উত্থান হবে না এতে। 
এমনকী, আলোচ্যমান চার হাফ-মন্ত্রীর মোহভঙ্গও দেখবেন সময়ের অপেক্ষা মাত্র, অভিজ্ঞতা তাঁরা ধার করতে পারেন বাবুল বড়াল এবং দেবশ্রী চৌধুরীর কাছ থেকে। 
জাতপাতের সমীকরণে মমতাকে টপকে যাওয়ার চেষ্টা হবে। এনআরসি নিয়ে নতুন বিতর্কে ইন্ধন দিয়ে (অলরেডি যেটা শুরু করেছেন দিলীপ ঘোষ) মমতাকে চাপে রাখা হবে মতুয়া ভোটে ভাগবৃদ্ধির আশায়। উদ্দেশ্য আসন্ন পুরভোট, বিধানসভার উপনির্বাচনে যদি একটু এগনো যায়। 
একুশের বিধানসভার ভোটটা মোদির পার্টির জন্য ‘হয় এবার নয় নেভার’ টাইপ হয়ে গেল! তারপর কেন্দ্রেও জুটল না কিছু—দিল্লিতে হত্যে দেওয়ার পরেও না। স্রেফ হাওয়াই মিঠাই মুঠোয় ভরেই, কিছুদিন আগে, বাংলায় ফিরতে হয়েছে কয়েকজন নব্য গেরুয়া এমপি-কে। আবার নিজেদের হাতে এত কাঁটা বিছিয়ে ফেলেছেন পুরনো সড়কে তাঁরা, সেখানে ফেরার পথটাও তাঁদের জন্যে আপাতত অতি দুর্গম মনে হচ্ছে। সব মিলিয়ে ইদানীং কাউকে কাউকে দেখে বেশ কষ্টই হচ্ছে, এই হতাশা কোথায় রাখবেন তাঁরা! 
এই ট্রেন্ডটাই যে আরও অক্সিজেন পাবে তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন সৌমিত্র খাঁয়েরা। বারুদের স্তূপের উপরে উপবিষ্ট পার্টি ‘পূর্ব মেদিনীপুর বনাম বাকি বাংলা’ লড়াইয়ে আরও ছত্রখান হতে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে কি? দিলীপবাবু তো শিশু, ‘অন্যগাছের ছালেদের’ নিয়ে স্বয়ং মোদিকেও নির্ঘাত বেগ পেতে হবে ২০২৪-এর আগে, বারবার।

14th     July,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ