স্যাংফ্রোয়া (sangfroid) হল একটি ফরাসি শব্দ। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি অনুসারে এর অর্থ হল—‘কঠিন পরিস্থিতিতেও শান্ত থাকার ক্ষমতা’।
ভারতীয়রা ‘স্যাংফ্রোয়া’-তে ফরাসিদের হারিয়ে দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক হেঁটে কয়েকশো কিমি দূরে তাঁদের গ্রামে বা শহরে ফিরে যাচ্ছেন, খালি পেটে খালি পকেটে, সামান্য ওষুধপত্র বা অন্য সাহায্য ছাড়াই! এসব দেখে অন্যকোনও দেশ তাপউত্তাপহীন থাকতে পারত না। হাসপাতালের সামনে গুরুতর অসুস্থ রোগী সমেত অ্যাম্বুলেন্সের দীর্ঘ লাইনকে, উন্নয়নশীল দেশের অভিশাপ জ্ঞানে, অন্যকোনও দেশ সহ্য করত না। কোভিড-১৯-এ চার লক্ষাধিক (সংখ্যাটি চার-পাঁচ গুণ কমিয়ে দেখানো হয়েছে বলেই অনুমান) মানুষের মৃত্যুর মতো মর্মন্তুদ একটি ঘটনাকে অন্যকোনও দেশ, গণবিক্ষোভে ফেটে পড়ার পরিবর্তে, একান্ত ব্যক্তিগত শোক বলে মেনে নিত না। গরিব পরিবারের লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে রয়ে গেল, অথচ তাদের বাবা-মায়েরা ক্ষমতার দুর্গে ঝড় বইয়ে দিলেন না—এই সহ্যক্ষমতা অন্যকোনও দেশে দেখা যেত না। এই তালিকা আপনি আরও দীর্ঘ করতে এবং তার জন্য ভারতবাসীর ‘স্যাংফ্রোয়া’-তে অভিভূত হতে পারেন।
দায়িত্ব এড়ানো
শেষমেশ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইস্তফা দিয়েছেন। পদত্যাগ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীও। শিক্ষামন্ত্রীও ইস্তফা দিয়েছেন। মন্ত্রিত্ব ত্যাগের আরও ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তাঁদের কেউই দায়িত্ব স্বীকার করে ইস্তফা দেননি। ২০২০ এবং ২০২১ সালে তাঁদের প্রশাসন জনগণের উপর যে দুঃশাসন চাপিয়ে দিয়েছিল তার দায়কে এই ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগের সঙ্গে যুক্ত করেননি কেউই।
সুতরাং, ফরাসি তদন্তমূলক পত্রিকা ‘মিডিয়াপার্ট’ রাফাল যুদ্ধবিমান চুক্তি নিয়ে সম্প্রতি তাদের প্রতিবেদন (গত এপ্রিলের ফলো আপ রিপোর্ট) প্রকাশ করলেও ভারতের রাজধানীতে তা নিয়ে সামান্য আলোড়নও সৃষ্টি হয়নি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের একজনও এনিয়ে ভ্রু কুঁচকেছেন কি না আমার সন্দেহ রয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক, তিনিও প্রতিক্রিয়াশূন্য। কাহিনিটা মন্ত্রিসভার অতীতের অনেক বিবৃতির উল্টো হওয়া সত্ত্বেও প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিষয়টিকে না-দেখার ভান করেছিলেন। ওটাই হল স্যাংফ্রোয়া বা অবৈকল্য।
তিন পর্বে তদন্ত করেছিল মিডিয়াপার্ট। সেই সূত্রে গত এপ্রিলে তারা জানিয়েছিল দুর্নীতিরোধী ফরাসি সংস্থা (এএফএ) প্রমাণ পেয়েছে যে, ফরাসি অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি দাসো এক অজ্ঞাতনামা ভারতীয় দালালকে দশ লক্ষ ইউরো দালালি দিতে রাজি হয়েছিল। নাম প্রকাশ না-করেও তারা এটা জানিয়েছিল যে, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত অন্য একটি চুক্তির জন্য ওই দালালের বিরুদ্ধে ভারতে তদন্ত জারি রয়েছে। তবে, ডেফিস নামে এক ভারতীয় কোম্পানিকে দাসো ৫,৯৮,৯২৫ ইউরো দিয়েছিল (এটা কতটা যুক্তিসংগত!)। এমনকী একেবারে প্রারম্ভিক পর্বে এটা তেমনই ছিল, একটা নির্দিষ্ট অভিযোগ যেমনটা হতে পারে। (আরও পড়ুন: ‘ফিরে এল রাফালের ভূত’/ বর্তমান/ ১২ এপ্রিল, ২০২১)। এটার সঙ্গে প্রথামাফিক ‘স্যাংফ্রোয়া’র সাক্ষাৎ হয়েছিল—ভারতে, তবে ফ্রান্সে নয়।
যথাস্থানে
এবার আরও তথ্য খোলসা হয়ে গেল:
২০১২ সালে একটি পাবলিক টেন্ডার সূত্রে দাসোকে নির্বাচন করা হয়। তাদেরকে বাছাই
করা হয়েছিল এই শর্তে যে তারা ভারতীয় বায়ু
সেনাকে ১২৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান সরবরাহ
করবে। তার মধ্যে ১৮টি দেবে ‘ফ্লাই-অ্যাওয়ে’ অবস্থায় এবং বাকি ১০৮টির জন্য যন্ত্রাংশ এনে ভারতে ‘অ্যাসেম্বলড’ করা হবে।
২০১৫ সালের ২৫ মার্চ। ভারতীয় বায়ু সেনার প্রধান এবং হ্যাল-এর চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে দাসো এভিয়েশনের সিইও ঘোষণা করেন যে, দাসো ও হ্যাল-এর মধ্যে শীঘ্রই একটি চুক্তি সম্পাদন হবে। চুক্তির বিষয় কী ছিল? যুদ্ধবিমান ভারতে তৈরি হবে এবং তার জন্য প্রযুক্তি হস্তান্তর করা হবে হ্যাল-কে।
২৬ মার্চ। হ্যাঁ, ঠিক তার পরদিনই! দাসো একটি ভারতীয় বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতাপত্র (মউ) স্বাক্ষর করল—‘সম্ভাব্য যৌথ উদ্যোগ’-এর জন্য। তাতে বিষয় নির্দিষ্ট করা হল: প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাসেম্বলি অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচার, মেনটেন্যান্স অ্যান্ড ট্রেনিং।
৮ এপ্রিল। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি সফরসঙ্গী ভারতের সিনিয়র অফিসাররা প্যারিসে ‘কনফার্ম’ করলেন যে, দাসো ও হ্যাল-এর মধ্যে চুক্তিটা হওয়ার অপেক্ষায় আছে এবং খুব শিগগির সেটি চূড়ান্ত হয়ে যাবে।
১০ এপ্রিল। প্যারিসে প্রধানমন্ত্রী মোদি ঘোষণা করেন যে দাসো-হ্যাল চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে এবং ভারতীয় বায়ু সেনা (আইএএফ) ফ্রান্সে প্রস্তুত ৩৬টি যুদ্ধবিমান কিনবে।
৯ নভেম্বর। দাসো এবং একটি ভারতীয় বেসরকারি কোম্পানির মধ্যে ‘স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট’ সই হল। দাসো-র আইনগত দায়বদ্ধতার মধ্যে থাকবে—নির্মাণ, প্রযুক্তি, কারিগরি জ্ঞান, এয়ারফ্রেম সাব-অ্যাসেম্বলি নির্মাণ, অ্যাসেম্বলি চূড়ান্ত করা, প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের আধুনিকীকরণ, আন্তর্জাতিক বিপণন এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান। ভারতীয় বেসরকারি কোম্পানিটি—ভারতীয় বাজারে বোঝাপড়া, উৎপাদনের সুযোগ-সুবিধা এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে বিপণন ব্যবস্থা করার দায়িত্ব পালন করবে।
২০১৬-র সেপ্টেম্বর। ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান বিক্রয়ের ব্যাপারে একটি আন্তঃসরকার চুক্তি সম্পাদিত হয়।
২৮ নভেম্বর। দাসো এবং ভারতীয় বেসরকারি কোম্পানির মধ্যে শেয়ারগ্রহীতার চুক্তি স্বাক্ষর হল। ১৫৯ মিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত জোগানোর (এবং ৫১ শতাংশ ইক্যুইটির মালিকানা গ্রহণের) ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হল দাসো। অন্যদিকে, ভারতীয় বেসরকারি কোম্পানিটি ১০ মিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত জোগানোর (এবং ৪৯ শতাংশ ইক্যুইটির মালিকানা গ্রহণের) ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হল।
এই সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, ফ্রান্সের পাবলিক প্রসিকিউশন সার্ভিসেস পিএনএফ একটি নতুন তদন্ত শুরু করেছে এবং বিচারবিভাগীয় তদন্তের দায়িত্ব দিয়ে একজন বিচারপতিকে নিয়োগ করেছে।
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা
বিতর্ক যখন দানা বাঁধছে তখন চারটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান, যাদের ‘ওয়াচডগ’ বা প্রহরী বলে মনে করা হয়, তারা দেশকে হতাশ করল: সংবাদ মাধ্যম, শীর্ষ আদালত, সংসদ এবং সিএজি। আমি নিশ্চিত এবং ব্যথিত এই কারণে যে, সংসদ আত্মরক্ষার ভূমিকায় নিয়োজিত থাকবে এবং অভিযোগগুলিকে অবজ্ঞা করে যাবে। আমি এই ব্যাপারেও নিশ্চিত যে, সিএজি ঝাঁপ বন্ধ করে রাখবে এবং তাদের ১৪১ পাতার রিপোর্ট ‘রি-ওপেন’ করবে না। উল্লেখ্য যে, ওই রিপোর্টের ভিতরে ১২৬ পাতার মাথামুন্ডু সাধারণের বোধগম্য নয়।
যাই হোক, সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে ফুরফুরে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। তবু, আন্তঃসরকার চুক্তি এবং ২০১৮-র ১৪ ডিসেম্বর বিচারপতি গগৈ কর্তৃক প্রদত্ত রায় ‘রিভিউ’ করে দেখার জন্য আদালতকে রাজি করানো যেতে পারে। সংবাদ মাধ্যমের উপরেও আমি আস্থা রাখব। অনেকে আত্মসমর্পণ করেছে। কিছু হয়েছে দমনপীড়নের শিকার। তা সত্ত্বেও সংবাদ মাধ্যমে এখনও কিছু কলম এবং কণ্ঠ রয়েছে—যারা নিজেদের পাঠযোগ্য এবং শ্রাব্য করে তুলতে পারে।
মানুষের জন্য তারা কি স্যাংফ্রোয়া থাকবে? অবশ্য মূল ফরাসি ভাষায় শব্দটির অন্য অর্থ রয়েছে: ‘কোল্ড ব্লাড’—যার বাংলা অর্থ ‘শীতল রক্ত’।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী।
মতামত ব্যক্তিগত