বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

রথের নির্মাণশৈলী ও মানুষের
শরীর একসূত্রে গাঁথা
মৃন্ময় চন্দ

বাবা বজশ্রব যজ্ঞ করলেন, আমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের গোদান করলেন, উপহার-উপঢৌকনে ভরিয়ে দিলেন দরিদ্র উপবীতধারী দ্বিজদের। ছেলে ছোট্ট নচিকেতা, দূরে দাঁড়িয়ে দেখলেন বাবা যে গোরুগুলো দান করলেন, সেগুলো মৃতবৎসা। কস্মিনকালেও দুধ দেবে না। আর উপহার সামগ্রীর বেশিটাই অকাজের। বাবার ভ্রষ্টাচারে, লজ্জিত নচিকেতা বাবাকে সটান জিজ্ঞেস করলেন “বাবা, তোমার লোক-ঠকানো অকিঞ্চিৎকর দানের অর্থ”? ছোট মুখে বড় কথা, বজশ্রব চিৎকার করে বললেন ‘এবার তোমাকেও আমি যমের দক্ষিণ দুয়ারে পাঠাব’। সেটাই হবে আমার মহত্তম দান। মুখ থেকে কথা খসামাত্রই যমদূতেরা হাজির, তারা নচিকেতাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল যমরাজের দরবারে। যমরাজ বিশেষ কাজে বাইরে।  তিনদিন  বাদে ফিরে, ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর নচিকেতার আগমনের  হেতু জানতে চাইলেন। মুগ্ধ হলেন ওইটুকু ছেলের ত্যাগ-তিতিক্ষায়। ফুটফুটে নচিকেতাকে কোলে বসিয়ে ভূরিভোজনের ব্যবস্থা করলেন। তিনটি বর প্রদান করলেন। প্রথম বরে নচিকেতা তাঁর বাবার বুদ্ধি বিভ্রমের প্রতিকার চাইলেন। যমরাজ বললেন তথাস্তু। দ্বিতীয় বরে, যজ্ঞে মোক্ষলাভের গোপন বীজমন্ত্র শিখতে চাইলেন নচিকেতা। সেটিও মঞ্জুর হল। যমরাজ আরও বললেন, তিনবার এই যজ্ঞ সমাপনে নচিকেতাকে আর জন্ম মৃত্যুর পাকেচক্রে আবর্তিত হতে হবে না। পরম ব্রহ্মের সঙ্গে মোলাকাত হবে নচিকেতার। আর যজ্ঞটিও পরিচিত হবে ‘নচিকেতা যজ্ঞ’ নামে। 
এবার তৃতীয় বরের পালা। নচিকেতা যমরাজের কাছে জানতে চাইলেন মৃত্যুর পর কী পরিণতি হয় মানুষের? গূঢ়, গোপনীয় তথ্য। যমরাজ বললেন, যে প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবতারাও জানেন না, হে পুঁচকে ছোড়া তুমি তার নাগাল পাবে কীভাবে? নাছোড় নচিকেতা। মরণের পরের সংবাদ তাঁর চাইই। ভুলিয়ে-ভালিয়ে যমরাজ বিশাল রাজ্য, পরমাসুন্দরী অপ্সরা, বিপুল বৈভব, ক্ষমতা আর ঐশ্বর্যের লোভ দেখালেন। খেয়ে পরে সুখে শান্তিতে দিনগুজরানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। নচিকেতা বললেন, সুখ শান্তি কতদিনের? যে মুহূর্তে আপনি ডাকবেন, পরনের সুতোটিও ছেড়ে আপনার শরণাগত হতে হবে। তাহলে বিত্ত-বৈভব-ইন্দ্রিয়সুখ তো ক্ষণিকের মায়া, মরীচিকা। যমরাজ বললেন পথ দুটো: একটা ভোগের, দ্বিতীয়টা ত্যাগের। প্রথম পথের শেষে স্বাগতম জানাবে মৃত্যু। দ্বিতীয়টি আত্মজ্ঞানের, 
উত্তরণ-উন্মোচন-আত্মোপলব্ধির, অমরত্বের। নচিকেতা দ্বিতীয় পথটিকেই বাছলেন। তখন যম তাঁকে রথের 
উপমা টেনে শরীর-মন-বুদ্ধি-অনুভূতি-জীবাত্মার স্বরূপ শেখাতে বসলেন। 
“আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু।/ বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃপ্রগ্রহমেব চ।।/ ইন্দ্রিয়াণি হয়ানহুর্বিষয়াংস্তেষু গোচরান।/ আত্মেন্দ্রিয়মনোযুক্তং ভোক্তেত্যাহর্মনীষিণঃ” (কঠোপনিষদ ১।৩। ৩-৪)। অর্থাৎ আত্মা রথী, শরীর নামক রথে আরূঢ় তিনি। রথের সারথি বুদ্ধি। মন হল লাগাম। আর ঘোড়া পঞ্চেন্দ্রিয়। মন, বুদ্ধি স্থির থাকলে শরীর রথ নিবাত-নিষ্কম্প। সাফল্য করায়ত্ত। কিন্তু মন-বুদ্ধি-হৃদয় বিপথগামী হলেই শরীর নামক রথও বিগড়বে। রথে জোতা অশ্বের বিশৃঙ্খল আচরণে প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা বাড়ে সারথি বা রথীর! রথী জীবাত্মা, সারথি পরমাত্মা। ঘোড়ারা ক্ষ্যাপামি করলে, সারথির পক্ষে রথের ভারসাম্য বজায় রেখে সঠিকপথে রথের পরিচালন অসম্ভব হয়ে পড়ে। শরীর রথের অন্দরে, হৃদয়ে সমাসীন জীবাত্মা, মন-বুদ্ধি তাকে পথ দেখিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিয়ে দেবে। 
হৃদয়-মন-বুদ্ধির সামান্য বেচালে শরীর-রথ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পথভ্রষ্ট হয়। জন্ম-মৃত্যুর পঙ্কিল ঘূর্ণিপাকে কলুর বদলের মত নিশিদিন ঘুরপাক খেতে থাকে নশ্বর মনুষ্যজীবন। শোক-তাপ-জরা থেকে মেলে না মুক্তি। ষড়রিপু বা ইন্দ্রিয়কে চালনা করে মন, ইন্দ্রিয়ের থেকে বড় তাই মন, মনের থেকে বুদ্ধি। হৃদয়ের অন্তঃস্থলে আসীন আত্মা—‘পুরুষ’, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলে তবেই তার সঙ্গে মিলন হবে ‘প্রকৃতি’র। সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে অপার্থিব আলোর ঝলকানিতে সৃজিত হবেন পরমাত্মা, পরমব্রহ্ম। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, ডাব নরম শাঁস আর জলে ভর্তি, জড় আর চেতন মিলেমিশে ঢ্যাবঢ্যাবে। ঝুনো নারকেল পরিপুষ্ট, পরিণত, খটখটে। খোসা থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। মনকে শক্ত হাতে লাগাম পরাতে পারলেই জাগতিক কামনা বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে, ঝুনো নারকেল, ব্রক্ষ্মের স্বরূপে উপনীত হওয়া সম্ভব। রামকৃষ্ণদেব নাকি দিনের মধ্যে ৩৬ বার সমাধিস্থ হতেন, ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁর নাড়ির হদিশ পেতেন না। আশ্চর্য হয়ে তিনি স্বগতোক্তি করেছিলেন পরমহংস ৩৬ বার মরছে আবার বেঁচেও উঠছে, কোন জাদুবলে? সমাধিকালে আত্মাকে নারকোলের মত শরীর নামক খোসা থেকে ছাড়িয়ে নিয়েই নাড়ির স্পন্দন বিরহিত হতেন রামকৃষ্ণদেব। ‘জীবনমুক্তিঃ সুখমপ্রাপ্তিঃ’। চিকিৎসাশাস্ত্রে যার ব্যাখ্যা ডাঃ সরকার খুঁজে পাননি। সাধনমার্গের সাধকদের পক্ষেই এ মায়ার খেলা সম্ভব। 
রথযাত্রা আসলে সফর/পথচলা। ব্রক্ষ্মের সঙ্গে মিলনের বাহন রথ। দক্ষিণ ভারতের রথোৎসবে তাই সাড়ম্বরে পালিত হয় ‘ব্রহ্মোৎসব’। কিন্তু পুরীর রথে ব্রহ্মোৎসব অনুপস্থিত। মানুষের শরীর-রূপী রথে মোক্ষলাভের সমস্ত উপকরণই মজুত। রথে আসীন শ্রীজগন্নাথদেব মানুষের মধ্যে নেমে এসে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন কীভাবে যাত্রার শেষে অভীষ্ট মোক্ষের পথে পৌঁছতে হবে! তাই পুরীর রথযাত্রায় নেই কোনও ভেদাভেদ। নেই উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধনের বিচার। মোক্ষের পথ, ধর্মাধর্ম ভেদে আলাদা হতে পারে না। গজপতি রাজাকেও, আত্মসম্মার্জনার পথে, পুরীর রথে ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে হয়। ভিন্নধর্মী আলেকজান্ডার ক্যানিংহ্যাম বা শ্রীমতী গান্ধীর শ্রীমন্দিরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, পুরীর রথে স্বাগতম সকলেই। 
সতেরশো শতাব্দীর ঘটনা। জাহাঙ্গিরের সুবেদার, ভক্ত কবি  ‘সালাবেগ’ রথ-দর্শনে পরিত্রাহি ছোটার সময় পড়ে গিয়ে জখম হলেন। প্রভুর কাছে করুণ মিনতিতে বললেন দয়াপরবশ হয়ে প্রভু একটু যদি ‘সালাবেগের’ জন্য অপেক্ষা করেন। কী স্পর্ধিত আবদার! বড়া ডান্ডা অর্থাৎ মন্দিরের সামনের গ্র্যান্ড রোডে জগন্নাথদেবের ১৬ চাকার রথ ‘নন্দিঘোষ’ গেল আটকে, সারথির প্রাণপণ চেষ্টাতেও নড়ল না স্থাণুবৎ রথ। আজও ‘বড়া ডান্ডায়’ রথের দিন সাময়িক আটকে থাকে রথ। ভিন্ন ধর্মের মানুষদের দর্শনাকাঙ্ক্ষা পূরণে সিংহদ্বারে জগৎপিতা সব ধর্মের মানুষকে পতিতপাবন-রূপে দিবারাত্র দর্শন দেন। ‘ব্রহ্মোৎসব’ পুরীর রথ লোকাচারে বেমানান, তাই বাতিল।  
মানবশরীর যেমন পঞ্চভূতে গড়া, তার সমাপ্তিও তেমন পঞ্চভূতে বিলীন। শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীজগন্নাথদেবের রথও তেমন পঞ্চ উপাদানে তৈরি, কাঠ-ধাতু-রঙ-কাপড়-জরি। মন ও বুদ্ধি বা চেতনার যথোপযুক্ত প্রদর্শনে পুরীর রথে সারথি অর্জুন, আর মহাভারতের যুদ্ধে রথের রশি শ্রীকৃষ্ণের হাতে, রথী অর্জুন। মন, সাধারণ মানুষের বুদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে, বুদ্ধি মনকে নিয়ন্ত্রণ করলেই সাধনমার্গের দরজা খুলে যায়। মানসিক চাপ হৃদপিণ্ডের বারোটা  বাজায়, ধমনীতে চর্বি জমে অ্যাথেরোস্কেলোরোসিস হয়। রক্তপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হার্ট অ্যাটাকের সূচনা হয়। ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধলে, মস্তিষ্ক উপোস করে মরবে, অবশ্যম্ভাবী তখন ব্রেন স্ট্রোক। মন-হৃদয়-মস্তিষ্ক একতারে বাঁধা। রথের রশি-অশ্ব-সারথির সন্ময় যুগলবন্দিতে সামান্য তাল কাটলে রথও যেমন বেসামাল, মানবশরীরও তাই।
ঋণ: স্বামী রঙ্গনাথানন্দ, স্বামী চিন্ময়ানন্দ
লেখক: শ্রীজগন্নাথ গবেষক। মহামারী বিশারদ—ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনা, চ্যাপেল হিল ও জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি  

12th     July,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ