বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

ভারতের প্রশাসনের স্থাপত্য
গোপালকৃষ্ণ গান্ধী

রাজনীতিক-সিভিল সার্ভেন্ট সম্পর্কের মজবুত ভিতটা নির্মাণ করে গঠন, বিশ্বাস ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা। সর্দার প্যাটেল এটা অনুধাবন করেছিলেন।
এটা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে নয়, যাঁর মতো একজন ক্ল্যাসিকাল সিভিল সার্ভেন্টের কর্মদক্ষতার পরিচয় পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল, যখন আমি পশ্চিমবঙ্গে কর্মরত ছিলাম (২০০৪-২০০৯)। এটা তাঁর চাকরি জীবনের অন্তিম দিনগুলি এবং অবসর-উত্তর জীবনে পশ্চিমবঙ্গের মতো সুন্দর একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টারূপে বর্ধিত কর্মজীবন সম্পর্কেও নয়।
বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট লেখালিখি হয়ে গিয়েছে এবং আমার তরফে সেই ব্যাখ্যার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। সরকারের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পার্শ্বদেশ যেখানে মিশছে, এই কাজের প্রভাব সেই দূরবর্তী জায়গায় কী হচ্ছে সেটা নিয়েই আমি উদ্বিগ্ন। আমরা দেশের নাগরিকরা এই দুইয়ের মিলনভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকি, বিচার ব্যবস্থার মতো তৃতীয় প্রান্তটা হামেশা সেগুলিকে যুক্ত করে। সেই পার্শ্বদেশ এবং সেই প্রতিচ্ছেদের মধ্যে বোঝাপড়াটা আমাদের নাগরিকত্বের উপলব্ধির জন্য জরুরি। আমার কিছু স্মৃতিকথা দিয়ে শুরু করব। সালটা ছিল ১৯৬৮। ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে (আইএএস) যোগদানের আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে টেলিগ্রাম মারফত আমাকে কনফার্ম করতে বলা হল, চাকরিটা আমি গ্রহণ করছি কি না। এটা অবশ্য নিযুক্ত বাকিদের ক্ষেত্রেও করা হয়েছিল। আমি জানি না, সেই কেতাদুরস্ত নিয়মটা এখনও বজায় আছে কি না।
জবাবি টেলিগ্রাম পাঠাবার আগে তার ছোট খসড়াটি আমি দেখিয়েছিলাম আমার মাতামহ রাজাজিকে (চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি)। সিভিল সার্ভিসের প্রতি তাঁর যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল এবং সেই বছর ওই পরীক্ষায় বসার জন্য তিনি আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। ‘অফার গৃহীত হল’ বলে আমি খসড়াটি লিখেছিলাম। সেটি মনে মনে পড়ে নিয়ে একটি শব্দ যোগ করার জন্য তিনি আমাকে বললেন, ‘বলো যে, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গৃহীত হল’। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, সেই সুবিশাল অফিসের কে এই শব্দটি লক্ষ করবেন! আমার মনের কথা পড়ে নিয়ে সদ্য নব্বই পেরনো প্রবীণ মানুষটি বললেন, ‘গঠন বা রীতি বলে একটি জিনিস আছে।’
গঠন। ধারণাটি সিদ্ধান্তমূলক বা চূড়ান্ত। রাজাজি সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ করেছেন রাজনীতির এক উচ্চাসন থেকে। যখন উচ্চ পদে আসীন ছিলেন, তিনি অনেক নির্দেশ দিয়েছেন, আদেশ জারি করেছেন। যারা অলস, ভ্রষ্ট তাদের টেনে তোলার চেষ্টা ছিল তাঁর। তিনি জানতেন, একজন অফিসারের মধ্যে—ওএলকিউ, অর্থাৎ অফিসার লাইক কোয়ালিটিজ থাকা উচিত। আশা করি, এখনও ওই অক্ষর তিনটি দিয়েই অফিসারদের চেনা হয়। এগুলির মধ্যে অবশ্য চিবুক উঁচু করা, দম্ভপূর্ণ হাঁটাচলা, ‘আমিই সরকার’ গোছের আবহ গড়ে তোলা ইত্যাদি পড়ে না। শুধুমাত্র  ‘সরকারি প্রশাসনের উদ্দেশ্য’ যাকে বলা হয়, সেই সেন্স‍টাই এর অন্তর্ভুক্ত। এই জিনিসটা বস্তুত হল মানুষকে সহায়তা ও পরিষেবা দান। ‍
ব্যাচের সহকর্মীদের সঙ্গে ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে গিয়ে সাক্ষাৎ হল আমার দেখা অন্যতম সেরা দক্ষ অফিসার টি এন চতুর্বেদীর সঙ্গে। আমরা তাঁকে অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর হিসেবে পাইনি, তিনি ছিলেন সেখানকার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। তিনি আমাদের মধ্যে ব্যক্তিত্ব এনে দিয়েছিলেন, সরকারি চাকরিতে এসবই হতো। এটা ছিল প্রশাসনের স্থাপত্য এবং শাসনাধীন নাগরিক—উভয়েরই প্রতি শ্রদ্ধার বিষয়। এটা ছিল ভারতের বাস্তব অবস্থা, এর জটিলতা ও বিপুলাকারের সামনে বিনম্রতা এবং একইসঙ্গে এক গভীর সচেতনা নিয়ে এর বহুবিধ দুর্দশা দূরীকরণে আমাদের সামান্য কিছু ভূমিকা গ্রহণ।
এর অর্থ—আমাদের মেনে নিতে হয়, নির্বাচন নামক ট্রেডমিলের ভিতর দিয়ে যে রাজনৈতিক শ্রেণিটা পেরয়, তারা মানুষের পালস যেসব প্রকারে জানে, আমরা সেইভাবে চিনি না। আর সেটাই হল ‘পালস’ বোঝার রাজনীতিকদের বিশেষ কৌশল। অন্যদিকে, ‘পালস-টেকিং’ এবং ‘পালস-ট্রিটিং’ যাতে অবশ্যই একসঙ্গে চলতে পারে সেটাই হল আমাদের অর্জিত দক্ষতা। রাজনীতিক এবং আমাদের কর্তব্য সম্পাদনের ভিত্তি হল পারস্পরিক শ্রদ্ধা। পারস্পরিক। এই ধারণাটিও চূড়ান্ত। আমাদের সাধারণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্য যে-কোনও ব্যক্তির থেকে এটা যিনি ভালো জানতেন তিনি আমাদের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল।
ভারতের সংবিধান অনেক বিবেচনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ফসল। প্যাটেল যখন সার্ভিসগুলির দায়িত্বে ছিলেন তখন সেগুলির পক্ষে মঙ্গলজনক দু’টি অনুচ্ছেদ খসড়া সংবিধানে রাখার কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে প্রথমটি হল অনুচ্ছেদ ৩১১। তাঁদের রাজনৈতিক প্রভুদের তরফে মর্জিমাফিক শাস্তিদানের ক্ষেত্রে ওই স্পষ্ট ব্যবস্থাটি সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য রক্ষাকবচ হয়েছিল। গণপরিষদের অন্য অনেক সদস্যদের মতো প্যাটেল ছিলেন স্বাধীনতার যোদ্ধাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয়। সত্যি বলতে কী, উচ্চতার বিচারে তাঁর কোনও তুলনা ছিল না। তিনি জানতেন, জেলে পাঠানো এবং বড় ও ছোট সরকারি কর্মকর্তাদের তরফে কঠোর ব্যবহার কোন অর্থ বহন করে। এটা আমলাবর্গের হাতে ফেরত দেওয়াটা একজন ছোট মাপের ‘স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী’র পক্ষে স্বাভাবিক হতে পারত। কিন্তু প্যাটেল ছিলেন প্যাটেলই। প্রতিহিংসার কোনও জায়গা ছিল না। অন্যদিকে ছিল বিশ্বাস। আর ছিল শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা ছিল নাগরিকদের মতামত ও সমালোচনার প্রতি। ‘আজ’ সর্দার সমাবেশে বলেছিলেন, ‘‘আমার সচিব আমারই মতের বিরুদ্ধে একটি নোট লিখতে পারেন। আমার সব সচিবকে এই স্বাধীনতাই আমি দিয়েছি। আমি তাঁদের বলেছি: ‘আপনারা যদি আমাকে আপনাদের সৎ মতামত জানাতে না পারেন, তাহলে আপনাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়াই শ্রেয়’।’’
এবং, সিভিল সার্ভেন্টদের জন্য ৩১৪ অনুচ্ছেদের অধীনে নতুন নিশ্চয়তা চালু করা নিয়ে সমালোচকদের উদ্দেশে ওই ভাষণেই তিনি বললেন: ‘‘আপনারা যদি ... এই সার্ভিসে না-থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তবে সার্ভিসটা আমি সঙ্গে করে নিয়ে চলে যাব। তাঁরা তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করবেন। তাঁরা সক্ষম মানুষ ...। লাঠি হাতে তুলে নিয়ে বলবেন না যে: আমরা একটা সুপ্রিম পার্লামেন্ট’।’’
এটা কোনও একজন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস অফিসারের ভাষণ ছিল না। কথাগুলো বলেছিলেন সর্দার প্যাটেল। শ্রদ্ধার অর্থ কী, তিনি জানতেন—জ্ঞাপন এবং গ্রহণ দু’দিক থেকেই।
• লেখক প্রাক্তন প্রশাসক, কূটনীতিক ও রাজ্যপাল

18th     June,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ