বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

অবলুপ্তির আত্মঘাতী
পথে সিপিএম
মৃণালকান্তি দাস

সময়ের কী পরিহাস! 
চৌত্রিশ বছরের ‘বাম-শাসন’-এর পর এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দেখছেন বামপন্থীবিহীন রাজ্য বিধানসভা। যেখানে সিপিএম-সহ রাজ্যের বাম দলগুলির কোনও নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। আর সেটা হয়েছে বহুদিন পর রাজ্যের বাম রাজনীতিতে একঝাঁক তরুণ মুখ আসার পরেও। যদিও ২০১৯-এর নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করলে এমন হওয়াটা অপ্রত্যাশিত নয়। প্রকৃতপক্ষে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলেই লোকসভা ও বিধানসভায় বামপন্থীরা শূন্য হয়ে গিয়েছিল। বিধানসভা নির্বাচনে তাতে সিলমোহর পড়েছে মাত্র। পরিসংখ্যানে নজর রাখলে বোঝা যায়, এই ঘটনা হঠাৎ ঘটেনি। বামপন্থীদের ‘অধঃপতন’ পশ্চিমবঙ্গে কার্যত ধারাবাহিক এবং নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে গত ১৫ বছর ধরেই। ‘শ্যাম রাখি, না কুল রাখি’ করতে গিয়ে একদা বাঙালির মননে অধিষ্ঠিত বামপন্থার আজ ভগ্নদশা।
২০০৬-এ রাজ্য বিধানসভার ২৩৫টি আসন জিতে ক্ষমতায় এসেছিল বামফ্রন্ট। অধঃপতনের শুরু তারপর থেকেই। ২০১১-এ ক্ষমতা হারানোর পরও অধোগতি চলল নিজের গতিতেই। কেন ২০১১-তে বাম সরকারের পতন ঘটল তা নিয়ে আজ অবধি সিপিএম কোনও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করে উঠতে পারেনি। তাই আজও সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা হয় ‘বিরোধীদের চক্রান্ত’ হিসেবে। অথচ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সংঘাত কোনও দুর্ঘটনা ছিল না। ঔপনিবেশিক ১৮৯৪ আইনের মাধ্যমে জোর খাটিয়ে জমি অধিগ্রহণ, সালিম গোষ্ঠীর প্রস্তাবিত স্পেশাল ইকনমিক জোন, এগুলো সবই ছিল উন্নয়নের নয়া উদারবাদী মডেলের বিভিন্ন অঙ্গ। যেগুলি অন্যান্য রাজ্যে সিপিআইএম-সহ সমস্ত বামপন্থীরা বিরোধিতা করে। বিকল্প নীতির রাস্তা ছেড়ে, ‘গুজরাত মডেল’-এর অনুসরণে, নয়া উদারবাদী উন্নয়নের পথে বামফ্রন্ট সরকারের চলার মধ্যে যে অন্তর্নিহিত দ্বিচারিতা, সেটাই সিপিএমের মতাদর্শগত এবং রাজনৈতিক সঙ্কটকে ডেকে আনে। এরপরও শুদ্ধিকরণের পথকে বর্জন করে ২০১৬-র নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় ফেরার শর্টকাট কৌশল নিলেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বররা। ক্ষমতায় ফেরা তো হলই না, এই সুবিধাবাদী জোটের ফলে বামফ্রন্ট বিধানসভায় তৃতীয় স্থানে চলে গেল। এর থেকেই সৃষ্টি হল বিরোধী পরিসরের শূন্যস্থান, যেটা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনমতকে কাজে লাগিয়ে ভরাট করতে থাকে বিজেপি। এই ক্রমাগত অধঃপতনের কোনও ইঙ্গিত মেলেনি গত এক দশকে সিপিএমের পর্যালোচনা থেকে। মেলেনি কীভাবে তা ঠেকানো যাবে, তার সঠিক পথনির্দেশও। নেতাদের গা বাঁচিয়ে একটা দায়সারা রিপোর্ট তৈরি করেই সিপিএম তার দায় ঝেড়ে ফেলছে।
যেমন ধরুন, কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের প্রশ্ন! একটা সময়ে সিপিএমের রাজনীতির ভরকেন্দ্র ছিল এককাট্টা কংগ্রেস বিরোধিতা। কেরলে প্রথম বামপন্থী সরকারের অপসারণ থেকে শুরু করে জরুরি অবস্থা, সেই সময়ের সন্ত্রাস, গ্যাট চুক্তি, বোফর্স কেলেঙ্কারি— যে-কোনও সিপিএম ন্যারেটিভে জাতীয় কংগ্রেস তখন পয়লা নম্বর শত্রু। বিজেপির সর্বভারতীয় উত্থানের পর কেন্দ্রীয় স্তরে সেই কংগ্রেসের সঙ্গে মিত্রতা। তবুও পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গেই মারকাটারি লড়াই। ২০১১ পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের পর সেই কংগ্রেস আবার এরাজ্যে সিপিএমের স্বাভাবিক মিত্র। কে না জানে, এই বদল কোনও আদর্শগত অবস্থান নয়, নেহাতই রাজনীতিতে অস্তিত্ব বজায় রাখার বা ক্ষমতা পুনর্দখল করার কৌশল মাত্র। এই প্রশ্নে বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্ররা কী যুক্তি দেন, তাতে কিছু যায় আসে না, সাধারণ মানুষ একে ভণ্ডামিই বলে!
শুধু কংগ্রেস নয়, হিন্দু মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে সিপিএমের সম্পর্ক কী হওয়া উচিত তা নিয়ে দলের মধ্যেই রয়েছে ঐতিহাসিক টানাপোড়েন। জরুরি অবস্থা চলাকালীন ১৯৭৫ সালের আগস্টে পদত্যাগ করেন সিপিএমের প্রথম সাধারণ সম্পাদক পি সুন্দরাইয়া। দলের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের কাছে লেখা ওই মাসের ২২ তারিখের চিঠিতে তাঁর পদত্যাগের যে দশটি কারণ উল্লেখ করেছিলেন, তার প্রথমটিই ছিল জনসঙ্ঘ ও আরএসএস নিয়ে পার্টির অবস্থান। তিনি এই দুই শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করার যে পার্টি লাইন তার বিরোধী ছিলেন। এমনকী, তিনি আরএসএসকে ‘আধা সামরিক ফ্যাসিস্ত’ বলেও অভিহিত করেছিলেন।
আর ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের শোচনীয় পরাজয়ের পরে নেতৃত্বের একটা অংশ বিশ্বাস করতে শুরু করেন, বিজেপিকে দিয়ে তৃণমূলের কাঁটা উপড়াতে হবে। তাই কেন্দ্রীয় স্তরে বিজেপি বিরোধিতার চড়া সুর থাকলেও রাজ্য স্তরে তৃণমূল বিরোধিতার প্রশ্নে সিপিএম ও বিজেপি প্রায় একসুরে কথা বলতে শুরু করে। যার ফল ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বাম ভোটের সরাসরি বিজেপির বাক্সে জমা হওয়া। এরপর থেকেই ‘২০২১-এ রাম, ২০২৬ সালে বাম’ নামে এক প্রতিক্রিয়াশীল স্লোগান তৈরি হয় এবং অনেক বামপন্থী মানুষ সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করেন। এই অন্ধ নীতির ফলে যাঁরা বিজেপির ফ্যাসিবাদী চরিত্রকে উন্মোচিত করতে চেয়েছেন তাঁদেরকেই ‘তৃণমূলের স্তাবক’ বলে দেগে দিয়েছে সিপিএম। এই কাজে দোসর হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় বামেদের অধুনাখ্যাত ট্রোল বাহিনী।
২০২১-এ নির্বাচনে লড়তে নেমে সিপিএম সেই ভণ্ডামির আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের তথাকথিত যুদ্ধ ছিল ‘বিজেমূল’ নামে একটা কাল্পনিক দলের বিরুদ্ধে। যে দলের ভূভারতে কোনও অস্তিত্ব নেই। তারা এক অদ্ভুত তত্ত্ব বাজারে ছাড়ে যার মূল কথা হল, বিজেপিকে পরাজিত করতে হলে তৃণমূলকে পরাজিত করতে হবে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বিজেপি ও তৃণমূল একই মুদ্রার এ-পিঠ ও-পিঠ মাত্র। গোটা দেশের লোক যখন মোদি-মমতার মরণপণ দ্বৈরথ দেখছে, সিপিএম তখন চোখ বন্ধ রেখে বলেছে, ও-সব ‘সেটিং’। আসলে দল তো একটাই, তার নাম বিজেমূল। ছায়ার সঙ্গে এই পুরো যুদ্ধটাই করা হয়েছে বিজেপি-তৃণমূল বাইনারি ভাঙার নাম করে। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। বিজেমূল নামক এই বকচ্ছপ ধারণাটাকে জনতা স্রেফ ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।
আসলে তৃণমূল তথা মমতার কাছে ২০১১ সালে পরাজয়কে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি সিপিএম নেতৃত্বের একাংশ। তাই রাজনীতি-বিযুক্ত ব্যক্তি-আক্রোশ প্রাধান্য পেয়েছে। বিধানসভা ভোটের প্রচারে বিজেপির বিরুদ্ধে বলার চেয়ে মমতাকে নিয়ে লঘুরসের তাচ্ছিল্য ভরা উপহাস করতে বেশি আগ্রহ ছিল তাদের। ‘বিজেপিকে হারাতে গেলে আগে তৃণমূলকে হারাতে হবে।’ এই আত্মঘাতী স্লোগান তুলে ঘৃণার বিষ বাম সমর্থকদের মধ্যে ছড়িয়েছে সিপিএমই। এই স্লোগান দলের পরিধির বাইরে বিশাল জনসমষ্টির সঙ্গে বামশক্তির বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। একসময় পাড়ায় পাড়ায় মানুষের হাঁড়ির খবর রাখা কমরেডরা এখন মমতাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করাটাকেই রাজনৈতিক টাস্ক এবং শ্রেণি সংগ্রামের অনুশীলন বলে মনে করেন। তাই তাঁদের বিকল্প নীতি ছিল ধোঁয়াশাময়।
সিপিএমের আরেকটা ভুল পদক্ষেপ, তৃণমূল সরকারের জনমোহিনী প্রকল্পগুলি সম্পর্কে ধারাবাহিক বিষোদ্গার, যা বামেদের নির্বাচনী প্রচারে চরমে উঠেছিল। একটা আদ্যন্ত নয়া অর্থনীতির জমানায় যখন রাষ্ট্র বাজারের চাপে তার জনকল্যাণমূলক দায়বদ্ধতা ক্রমশ ত্যাগ করছে, তখন দুনিয়াজুড়ে জনগণের জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের দাবি জোরদার হচ্ছে। সিপিএমের নেতাদের একথা অজানা নয়, ১০০ দিনের রোজগার যোজনাই হোক বা মিড ডে মিল—সবটাই সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প। কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, সবুজসাথী, ২ টাকার চাল, স্কুলের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই, খাতা, ব্যাগ বা ল্যাপটপ দেওয়াকে ধারাবাহিক ভাবে ভিক্ষার রাজনীতি আখ্যা তারাই দিতে পারে, যাদের অবস্থান গরিব মানুষ থেকে বহু দূরে। শ্রেণি বিশ্লেষণহীন ভোটমুখী রাজনীতিই যদি বামদের ফিরে আসার মোহিনীমন্ত্র হয়, তবে মানুষ বামপন্থীদের পছন্দ করবে কেন? বরং বলা ভালো, রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রো-গরিব তকমাটা দখল করে ফেলেছেন।
ভোট বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেন, ‘নো ভোট টু বিজেপি’ বলায় সিপিএম রেগে যাচ্ছিল, তার কারণ সিপিএম ‘অল ভোট টু বিজেপি’ করতে চেয়েছিল। যা বাংলার মানুষ চায়নি। শুধু তাই-ই নয়, আব্বাস সিদ্দিকির নেতৃত্বাধীন আইএসএফের সঙ্গে জোট প্রতীয়মান হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের মুসলিম প্রধান আসনগুলিতে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে তৃণমূলকে দুর্বল করে বিজেপিকে শক্তিশালী করার নীল নকশা হিসেবে। মুসলিমরা একদিকে এই নীল নকশাকে সজোরে প্রত্যাখান করেছেন আর বামপন্থীদের একটা অংশ বিজেপির বিপদ সম্পর্কে সচেতন হয়ে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। এর পরিণতি বামপন্থীদের প্রাপ্ত ভোট ৫ শতাংশের নীচে। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করতে চেয়ে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সিপিএম। পরের যাত্রা তো ভঙ্গ হলই না, নিজের নাকটাই কাটা গেল। বিজেপি ৩ থেকে ৭৭ হল। বাম-কংগ্রেস ৭৬ থেকে শূন্য!
২০১১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত শরীর শুকিয়ে আসছে অথচ রোগটাই জানা যাচ্ছে না। রোগ ধরার চেষ্টা হয়েছে কোনও? ভুল লাইনের নাগপাশে সিপিএম আজ এতটাই আবদ্ধ যে, এর থেকে কোনও সহজ মুক্তির সম্ভাবনা নেই। প্রয়োজন মতাদর্শগত পুনরুজ্জীবন, রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণ এবং সর্বোপরি দিগ্ভ্রান্ত নেতৃত্বের আপাদমস্তক পরিবর্তন। তা কি সম্ভব?

10th     June,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ