বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

এক আমলা যখন বাঙালির
আত্মমর্যাদার প্রতীক!
হিমাংশু সিংহ

তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করে এই গরিব দেশে তাঁর মূর্তি বসেছে। অথচ তাঁর ‘স্টিল ফ্রেম’ এর আমলারাই আজ বিপন্ন। চূড়ান্ত কোণঠাসা। ধুলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে ইস্পাতের কাঠামো। তাঁদের শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। লৌহমানব সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। দেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই পোড়া দেশে অতবড় মূর্তিতে মানুষের ভ্রূ কুঁচকেছে বৈকি। প্রতিবাদও হয়েছে। কিন্তু ওসবে মোদি-অমিত শাহের কিছু যায় আসে না। কারণ সবাই জানে সর্দার প্যাটেলকে শ্রদ্ধা জানাতে নয়, নেহরু-গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই ওই আকাশচুম্বী মূর্তি বানিয়েছেন মোদিজি। ভাবটা এমন, দ্যাখ কেমন লাগে! আসলে নরেন্দ্র মোদির দেহের প্রতিটা কোষে একটা শব্দই লেখা আছে সযত্নে। প্রতিহিংসা এবং আরও নীচ প্রতিহিংসা। তাই অত বড় মূর্তি বানিয়েও আসলে সর্দারজির আদর্শ ও অহঙ্কারকে প্রতিমুহূর্তে পদদলিত করে চলেছেন তিনি। টানা সাত বছর। সেই ২০১৪ সাল থেকেই গুরুত্ব ও ক্ষমতা ক্রমে ছাঁটাই হচ্ছে শীর্ষ অফিসারদের। সরকারটা যাঁরা চালান সেই আইএএসদের। নরেন্দ্র মোদির কাছে তাই আজ দেশের আইএএস মানে ফাইলের চাপে নুইয়ে পড়া সরকারি ভৃত্যমাত্র। আরও স্পষ্ট করে বললে উচ্চমার্গের ক্রীতদাস। যেমনটি চাইব, তেমনটি করবে। পাল্টা প্রশ্ন করলেই, হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাতে দেরি হলেই গ্যারেজ পোস্টিং। শাস্তির খাঁড়া। আবার ফতোয়া জারি হয়েছে, অবসরের পরও সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনও বিতর্কিত বিষয় নিয়ে বই লেখা যাবে না। ভিজিলেন্সের গ্রিন সিগন্যাল না নিয়ে পুনর্বাসনও নয়। অর্থাৎ যোগ্যতাকে দূরে সরিয়ে ‘মোদি স্মরণং গচ্ছামি’ বলা বশংবদ আমলাই সরকারের পছন্দ। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মাথা উঁচু করা অফিসাররা কাজ করতে গিয়ে অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসকষ্টে ভুগবেন, এ তো স্বাভাবিক। চাকরির শেষ দিনে রাজ্যকে না জানিয়ে নজিরবিহীনভাবে হঠাৎ দিল্লিতে তলব এবং তিন মাসের এক্সটেনশন ত্যাগ করে অবসর নিতে বাধ্য করা, আমলাতন্ত্রের শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়ারই মরিয়া প্রয়াস। আচ্ছা বলুন তো, দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রের মন্ত্রী করতে গেলে কার অনুমোদন লাগে? তখন তো সাত খুন মাফ। এই না হলে আদর্শ গণতন্ত্র, এতো আগামী বছর স্বাধীনতার হীরক জয়ন্তীতে দেশকে উচ্ছন্নে পাঠানোর সব আয়োজন সারা! 
অথচ দেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেল আইএএস বলতে যে শব্দ বন্ধনীর ব্যবহার করেছিলেন তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে তাঁর উদারবাদী আধুনিক চিন্তা। তিনি আমলা বলতে ‘স্টিল ফ্রেম অব ইন্ডিয়া’ বুঝয়েছিলেন। এবং দেশ স্বাধীনতা পাওয়ার আগে থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল, স্বাধীন মাথা উঁচু মেরুদণ্ড সোজা আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আর দেশের ৩১ নম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের আমলে সেই ‘স্টিল ফ্রেম’ই পরিণত হয়েছে ‘স্টিল কেজ’ এ। স্রেফ ইস্পাতের খাঁচায়। ঠিক যেমন সিবিআই আজ খাঁচার তোতাপাখি মাত্র! অথচ সর্দার প্যাটেলের স্বপ্ন ছিল, রাজনীতির ওঠাপড়ায় ক্ষমতার অলিন্দে নেতা আসবে, নেতা যাবে, কিন্তু দেশের প্রশাসনিক কাঠামো ও সংবিধানের মর্যাদা ধরা থাকবে ইস্পাত কঠিন ব্যুরোক্রেসির শক্তিশালী ভিত্তির উপর। সেই কাঠামো রক্ষা করবে নির্ভীক আইএএসরা। তাঁরা হবেন গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার মূল স্তম্ভই শুধু নন, সমন্বয়কারীও। ক্ষমতার দম্ভে কোনও নেতা আঙুল তুলে সেই কাঠামোকে সহজে আঘাত করার সাহস পাবে না। অথচ মুখে স্বাধীনতার বড় বড় কথা বলেও আজ স্বাধীনতার ৭৪ বছর পর সেই কাঠামোর মূলেই আঘাত করতে উদ্যত মোদি সরকার। প্যাটেল বলেছিলেন, যদি অফিসাররা তাঁর বিরুদ্ধেও নোট দেন তিনি খুশিই হবেন। বুঝবেন দেশ ঠিক পথে চলছে। আর তা না পারলে বুঝতে হবে সেই অফিসার তাঁর দায়িত্ব পালনের যোগ্যই নন। পাল্টা নোট দেওয়া দূরে থাক, কোভিড ও ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এক অঙ্গরাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলার কাণ্ডারি কেন ফুল মালা নিয়ে আগে থেকে কলাইকুণ্ডায় মোদিজির অপেক্ষায় নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকেননি সেই অপরাধে শোকজের চিঠি খাচ্ছেন। ১৫ মিনিট তাঁর জন্য বরেণ্য দেশনেতাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে, এমনই অভিযোগ। তাতে মাথার উপর কোন আকাশটা ভেঙে পড়েছে। তিনি তো মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দুর্গত মানুষের কষ্ট দেখতেই বেরিয়েছিলেন। কোথাও প্রমোদ ভ্রমণে যাননি। এবং মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক কক্ষে ঢুকেছিলেন। ঢুকে দেখেছিলেন, পিএম-সিএম মিটিংয়ের সার্কুলার বদলে অযাচিতভাবে কিছু লোকের উপস্থিতি, মুখ্যমন্ত্রীকে অসম্মান করার অশালীন চেষ্টা। আচ্ছা রাজ্যটা গুজরাত হলে বিরোধী দলনেতার ডাক পড়ত! কিংবা কোভিডের মৃত্যুমিছিল রুখতে এ পর্যন্ত কতবার ডাক পড়েছে লোকসভার বিরোধী দলনেতা অধীর চৌধুরীর। তবু মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে ওই বৈঠকে মুখ্যসচিব তুলে দিয়েছিলেন রাজ্যের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ও দাবিদাওয়ার খতিয়ান। তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে অসম্মান করার অভিযোগ কি ধোপে টেঁকে। জবাবি চিঠিতে আলাপনবাবু লিখেছেন, যতক্ষণ মুখ্যমন্ত্রী ওখানে ছিলেন, তিনিও সেখানে ছিলেন। তারপর বরেণ্য দেশনেতার অনুমতি নিয়েই বিপর্যয় মোকাবিলার কাজ দেখতে তিনি ও মুখ্যমন্ত্রী দীঘা চলে যান। প্রধানমন্ত্রী যেমন দেশের তেমনি মুখ্যমন্ত্রীও রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলার প্রধান। 
মুখ্যমন্ত্রী যদি চান সেক্ষেত্রে দীঘা না গিয়ে মুখ্যসচিব আলাপনবাবুর পক্ষে কলাইকুণ্ডায় থেকে যাওয়া কি সঙ্গত হত? তখন বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ৫১ নং ধারার লঙ্ঘন হত না? মুখ্যসচিব হিসেবে তিনি কার নির্দেশ মানতে বাধ্য? আলাপনবাবুর দোষটা কোথায়? তিনি তো কেন্দ্রের ক্যাবিনেট সচিব নন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব।
আসলে কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতা ও এক্তিয়ারের এই সীমাহীন টানাপোড়েনের মধ্যে দাঁড়িয়ে একজন মুখ্যসচিবের করণীয় কী, সেটাই কোটি টাকার প্রশ্ন। তাও আবার প্রায় ৩৩ বছর চাকরি করার পর অবসর নেওয়ার মাত্র ৭২ ঘণ্টা আগে। কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে এসে একজন সৎ যোগ্য আমলার কি এটাই প্রাপ্য ছিল। দেশের তাবৎ আইএএস, আইপিএসদের পক্ষে এই ঘটনা ব্যুরোক্রেসির সবচেয়ে কালো অধ্যায় নয় কি! নিঃসন্দেহে গোটা ঘটনাক্রম অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তাঁদের এবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় উপস্থিত। চুপ করে সব মেনে নিলে সঙ্কট বাড়বে। প্রতিদিন বাড়ছেও। সেই সঙ্গে আলাপনবাবু কয়েক বছর আগে তাঁর ‘আমলার মন’ বইয়ে যে ‘হীনমন্যতা’র অবতারণা করেছেন তাঁর উৎসটাও ঠিক কোথায় তাও বিলক্ষণ বুঝতে পারছি।
আসলে পুরো লড়াইটাই সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। অল ইন্ডিয়া সার্ভিসের ৬(১) ধারাও নয়, বিপর্যয় মোকাবিলার ৫১ নং ধারাও নয়, নরেন্দ্র মোদির রাগ আসলে বাঙালির উপর। বাংলার উপর। কয়েক হাজার কোটি টাকা জলে দিয়েও বঙ্গ বিজয় হয়নি। উল্টে বারবার বিকৃত গলায় ‘দিদি ও দিদি’ বলার হিসেব সুদে আসলে চুকিয়ে দিয়েছে বাঙালি। 
৪৮ শতাংশ ভোট পেয়ে রেকর্ড করেছে প্রতিপক্ষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। তাই মোদিজির গোটা শরীর জ্বলছে প্রতিহিংসার আগুনে। বাঙালি বিদ্বেষে। ফল বেরনোর দু’সপ্তাহের মধ্যে প্রথম সারির মন্ত্রী নেতাদের গ্রেপ্তার করে খুব একটা সুবিধা হয়নি। তোতা সিবিআইয়েরই মুখ পুড়েছে। এবার টার্গেট আলাপনবাবু। মুখ্যসচিব হিসেবে এক্সটেনশন দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে অন্যায়ভাবে দিল্লিতে তলব কোন উদ্দেশ্যে? তাঁকে আঘাত করে বাঙালি জাতিকে শিক্ষা দেওয়ার এই অত্যন্ত  সস্তা কুনাট্যও অচিরেই ব্যুমেরাং হতে বাধ্য। 
বলা বাহুল্য, আমি আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুব ঘনিষ্ঠভাবে চিনি বললে মিথ্যে কথা বলা হবে। দু’একবার সাক্ষাতে এবং ফোনে সৌজন্য বিনিময় হয়েছে মাত্র। তাঁর ঋজু সাবলীল নির্মেদ বাংলার সঙ্গে একটু আধটু পরিচয় আছে। ১৯৮৭ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে ভারতীয় প্রশাসনিক সার্ভিসের কঠিন পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়া এবং ধীরে ধীরে আসানসোলের বালিজুড়ি গ্রাম, অজয়নদীর পার থেকে উঠে এসে এই বাংলায় প্রশাসনের শীর্ষ পদে আসীন হওয়া বড় কম কথা নয়। সম্প্রতি তাঁর একমাত্র ভাইকে কোভিডে হারিয়েও বিপর্যয় মোকাবিলা থেকে একমুহূর্ত নিজেকে সরিয়ে রাখেননি তিনি। যতদূর জানি আপনজনের অকাল বিয়োগের পরদিনও ঠিক সময়ে নিজের অফিসে পৌঁছে কাজে মন দিয়েছিলেন। এমন একজন কর্তব্যপরায়ণ অফিসারকে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ৫১ ধারা প্রয়োগ করে জেলে পোরার হুমকি!  আর কত নীচে নামবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। আর কত অবমূল্যায়ন ঘটাবেন পদটার। আসলে হুমকিটা আলাপনবাবুকে নয়, বাংলার মানুষকে। কিন্তু এভাবে তো একটা জাতিকে ভয় দেখানো যাবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানো যায়নি, আলাপনবাবুও মাথা নোয়াননি। আগামী দিনে এমন আঘাত বারবার আসবে। বাঙালি ভয় পায় না, আবার প্রমাণ হবে। দেশের সর্বস্তরের আমলারাও এককাট্টা হবেন। হতেই হবে।
আলাপনবাবু তাঁর ‘আমলার মন’ বইটি লিখেছিলেন কয়েক বছর আগে। সেখানে অনেক প্রসঙ্গের অবতারণা হলেও রাজনৈতিক প্রভুদের কোপে দেশের প্রথম সারির আইএএসদের আজ কী শোচনীয় অবস্থা তা আরও বিস্তারিতে বইটির পরবর্তী সংস্করণে নিশ্চই লিপিবদ্ধ হবে। সেই সর্বশেষ সংযোজিত অধ্যায়টা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম। আর অপেক্ষায় রইলাম চব্বিশের লোকসভা ভোটে এই বাংলার আপসহীন মানুষ নরেন্দ্র মোদির বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার কী জবাব দেন তা দেখার জন্য। 

6th     June,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ