বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

সঙ্কট থেকে  চরম বিপর্যয়
পি চিদম্বরম

আপনি এই নিবন্ধ যখন পড়ছেন ততক্ষণে ১৮-৪৪ বছর বয়সিদের করোনা ভ্যাকসিন দেওয়ার মতো বিরাট কর্মসূচিটা দেশে চালু হয়ে গিয়েছে। কিছু রাজ্য আগ্রহের সঙ্গে এবং কিছু রাজ্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও এতে শামিল হয়েছে। অন্যদিকে, ততক্ষণে শেষ হয়ে গিয়েছে ভোটগণনার মতো আর একটা ইভেন্ট এবং ফলাফল বেরিয়ে গিয়েছে। এই দু’টো ইভেন্টের কোনওরকম তথ্য বা ফলাফল হাতে আসার আগেই এই নিবন্ধ আমি লিখছি। 
মানুষের মধ্যে ‘ভ্যাকসিন গ্রহণে দ্বিধা’ রয়েছে। এই কল্পকাহিনিটা নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে দু’টো ঘটনায়। (এক) প্রথম ডোজ নেওয়ার জন্য মানুষ দাঁড়িয়ে পড়েছে দীর্ঘ লাইনে। (দুই) জোগানের স্বল্পতার কারণে বহু মানুষকে ভ্যাকসিন না নিয়েই ফিরে যেতে হয়েছে। ২ এপ্রিল ৪২ লক্ষ ৬৫ হাজার ১৫৭ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছিল এবং টিকাকরণের দৈনিক গড়টা এই সংখ্যার কাছাকাছি পৌঁছতে না পারার কোনও কারণ ছিল না। যাই হোক, এপ্রিল মাসে দৈনিক টিকাকরণের গড় হারটা ২৯ লাখে নেমে এসেছিল। এর একটা কারণ হল, হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনমতো ভ্যাকসিন সাপ্লা‌ই করা যায়নি। আর একটা হতে পারে লকডাউনের দিন এবং দৈনিক সময়সীমা বাড়ানো। এই হারে চললে, বাকি ৭০ কোটি ভারতবাসীর টিকাকরণের জন্য ২৪০ দিন লাগবে। 
টিকাকরণের জন্য অর্থবরাদ্দ কমানো উচিত হবে না। একটা ডোজের আনুমানিক দাম ২৫০ টাকা। ৭০ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে দু’টো করে ডোজ দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় বাজেটে এই পরিমাণ অর্থই ইতিমধ্যে বরাদ্দ করা হয়েছে। ১ মে তারিখের ভিতরে বাকি সমস্ত বাধা দূর হয়ে যাওয়া উচিত। যদি নতুন দাম দ্রুত নির্ধারণ না-করা হয় তবে দুই প্রস্তুতকারকের তরফে ঘোষিত পাঁচটা দামই এই ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে। 
ভ্যাকসিনের এই স্বল্পতা কেন?
ভ্যাকসিনের স্বল্পতা এখনও একটা সমস্যা। এর পুরো দায় কেন্দ্রীয় সরকারের। এই সঙ্কট যেসব কারণে: (এক) সরকার এখনও পর্যন্ত সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া এবং ভারত বায়োটেক ছাড়া অন্য ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে পারেনি। (দুই) কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাকসিন ছাড়া অন্যকোনও অনুমোদিত ভ্যাকসিন পাওয়ার ব্যাপারে সরকার আগাম অর্ডার দেয়নি। (তিন) ভারতে দু’টো সংস্থা ভ্যাকসিন তৈরি করছে। তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। তার জন্য তাদেরকে বাড়তি লগ্নির জোগান দিতে হবে। এর প্রয়োজনটাই উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। (চার) দু’টো ভারতীয় প্রস্তুতকারকের সঙ্গে আলোচনা করে ভ্যাকসিন ডোজের জন্য একটাই ন্যায্য দাম ঠিক করতেও ব্যর্থ হয়েছে সরকার। (পাঁচ) অভিন্ন ন্যায্য দামেই ভ্যাকসিন বেচতে হবে। এই মর্মে প্রস্তুতকারক দু’টোকে সরকার হুঁশিয়ার করতে পারত। কমপালসারি লাইসেন্সিংয়ের বিধান প্রয়োগ করেই এই বার্তা দেওয়া যেত। কিন্তু সরকার তাতেও ব্যর্থ হয়েছে। (ছয়) সরকার ব্যর্থ হয়েছে রাজ্যগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে। দায়িত্ব ও খরচ বহনের ব্যাপারটা কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলোর মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য এটা দরকার ছিল।
‘ভারত হল পৃথিবীর ঔষধালয়’—এই দম্ভোক্তি নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের অদক্ষতার সৌজন্যে। পরিবর্তে আমরাই আজ অন্য অনেক দেশ এবং প্রস্তুতকারকের কাছে ভ্যাকসিন পেতে আর্জি জানাচ্ছি। যদিও তাদের পক্ষে ভারতকে দেওয়ার মতো কমই রয়েছে। চূড়ান্ত অসম্মানটা তখনই হবে যখন আমরা চীনের সিনোফার্ম এবং অন্যকিছু চীনা ভ্যাকসিন নিতে রাজি হব। স্মরণ করা যেতে পারে, ডক্টর রেড্ডি’স ল্যাবরেটরিজ রাশিয়ার স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু করতে চাইলে কেন্দ্রীয় সরকারই সেটা কয়েক সপ্তাহ পিছিয়ে দিয়েছিল। আরও মনে রাখতে হবে, ফাইজার-বায়োএনটেক-এর ভ্যাকসিন অনেকগুলো মান্য নিয়ামক সংস্থার ছাড়পত্র পেয়েছে। তাদের ভ্যাকসিন ইতিমধ্যেই ব্যবহার করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ। তা সত্ত্বেও ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া (ডিসিজিআই) ভারতে ওই ভ্যাকসিনের ‘ইমার্জেন্সি ইয়ুজ অ্যাপ্রুভাল’ দিতে অস্বীকার করেছিল!
ভ্যাকসিনের জোগান অপ্রতুল, এটাই সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। নামী হাসপাতালগুলো থেকেও ভ্যাকসিন সঙ্কটের খবর আসছে। এটাই যদি হয় মেট্রোপলিটন সিটিগুলোর চেহারা, তবে কল্পনা করুন, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি শহরের হাসপাতালগুলোর দুর্দশার কথা। ভাবুন দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণির শহর এবং বড় শহরগুলির অবস্থাও। ১৮-৪৪ বর্ষীয়রা যখন হাসপাতালে হাসপাতালে ভিড় জমাবেন ভ্যাকসিনের সঙ্কট তখন আরও তীব্র হয়ে উঠতে পারে। বেড এবং অক্সিজেনের সঙ্কট নিয়ে এখন চলছে বিভিন্ন হাসপাতালে কর্তৃপক্ষকে ঘেরাওয়ের পালা। ভ্যাকসিনের না-পাওয়ার কারণে ক্ষুব্ধ লোকজন অনুরূপভাবে এবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ঘেরাও করতে থাকলে অবাক হব না। 
কেউ সবজান্তা নয়     
কেন্দ্রীয় সরকার এমন শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হল কেন? এই সম্পর্কে আমি দীর্ঘ তালিকা পেশ করতে পারি। কারণগুলো সংবাদ মাধ্যমের, বিশেষভাবে, বিদেশি মিডিয়ার খুঁজে বার করা: (এক) ঔদ্ধত্য: মন্ত্রীরা বলছেন, ‘মোদিজি যেভাবে মহামারীকে পরাস্ত করেছেন, পৃথিবী তাকে অভিনন্দিত করছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাঁকে ‘বিশ্বগুরু’ আখ্যা দিয়েছেন! (দুই) অতিশয় কেন্দ্রীকরণ: সমস্ত সিদ্ধান্ত একজনমাত্র ব্যক্তিই নেবেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে রাজ্যগুলোকে অনুগত অধস্তন বানিয়ে ফেলা হয়েছে। (তিন) পরামর্শদানে দুর্বলতা: ডাঃ পল, ডাঃ গুলেরিয়া এবং ডাঃ ভার্গব—এই ত্রয়ীর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা রয়েছে। তবু মনে হচ্ছে, তথ্য বিশ্লেষণ এবং প্রধানমন্ত্রীকে নির্ভয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার চেয়ে তাঁরা টেলিভিশনের পর্দাতেই বেশি সময় ব্যয় করে ফেলছেন। (চার) বিচ্ছিরি পরিকল্পনা: পরিকল্পনা জিনিসটা কী, সেটা পরিকল্পনা কমিশন ছাড়া কোনও সংস্থা জানে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে যখন বিচিত্র পরিস্থিতি, ভয়ানক বিপর্যয় এবং অসংখ্য সমস্যাকে একসূত্রে গেঁথে একটা সমাধানে পৌঁছতে হবে। (পাঁচ) ‘আত্মনির্ভর’ কথাটার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে ভুল ক্ষেত্রে। ‘সেলফ-সাফিসিয়েন্সি’ জিনিসটাকে  উপলব্ধি করেনি। ফলে কথাটাকে সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদে নামিয়ে আনা হয়েছে। (ছয়) দু’টোমাত্র ভারতীয় প্রস্তুতকারক সংস্থাকে তোল্লা দেওয়া হয়েছে। অথচ দরকার ছিল উৎসাহ জুগিয়ে এই ‘জাতীয় উদ্যোগে’ আরও কিছু সংস্থাকে শামিল করার। অথবা, প্রয়োজনমতো ভ্যাকসিন আমদানি করে সেগুলো সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করতে হতো। 
পথ সামনে জাতি বিরাট মূল্য চোকাচ্ছে। ১ মে’র হিসেবে, সারা দেশে দৈনিক সংক্রমণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লক্ষ ১ হাজার ৯৯৩। ৩০ এপ্রিল সক্রিয় সংক্রামিতের সংখ্যা পৌঁছেছিল ৩২ লক্ষ ৬৮ হাজার ৭১০-এ। ওই সময়ে মৃত্যুর হার ছিল ১.১১ শতাংশ (সম্ভবত কমিয়ে দেখানো হয়েছে)। সারা পৃথিবীতে দৈনিক নতুন সংক্রমণের যে চিত্রটা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ভারতের অংশ ৪০ শতাংশের বেশি!
এই চরম বিপর্যয় আমরা এখনও রুখে দিতে পারি। প্রধানমন্ত্রীর উচিত এবার থামা এবং নতুন উপায়ে পদক্ষেপ করা। স্বাধীনভাবে ভাবনাচিন্তা করতে সক্ষম এমন সর্বাধিক ৯ সদস্যের একটি গোষ্ঠীকে ক্ষমতা দিতে হবে। যে-গোষ্ঠীতে থাকবেন মন্ত্রী, চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ, পরিকল্পনাকারী এবং রূপায়ণকারী (তাঁরা কর্মরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত, সরকারি কর্মচারী কিংবা সুশীলসমাজের অংশ হতে পারেন)। নামকরণ করা হোক এমপাওয়ার্ড ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ। মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে এই গোষ্ঠীকেই পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হোক। ফলাফল কী হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শুধু সেটারই মূল্যায়ন করুন। হার্ভার্ডের পাঠ বিশেষভাবে ফলপ্রসূ।  
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত

3rd     May,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ