বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

সঙ্কটকালে করোনাই
হোক প্রধান প্রতিপক্ষ
তন্ময় মল্লিক

মরার সময় হরিনাম, নাকি বিলম্বিত বোধোদয়? নির্বাচন কমিশনের বিজয় মিছিলে নিষেধাজ্ঞা জারির পিছনে কোন যুক্তিটা কাজ করেছে, সেটা বোধোগম্য নয়। এই সিদ্ধান্তকে সমস্ত রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ সমর্থন জানিয়েছেন। তবে বঙ্গে করোনা বৃদ্ধির জন্য কমিশনের দিকেই সবচেয়ে বেশি আঙুল উঠছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী ও আট দফায় ভোটের জন্যই সুনামির শক্তি নিয়ে এরাজ্যে আছড়ে পড়েছে করোনা। এখন তাকে বালির বাঁধ দিয়ে আটকাতে চাইছে কমিশন। এসব দেখে কেউ কেউ বলছেন, কমিশন গাছের গোড়া কেটে ডগায় জল ঢালছে। সেসব করে কি আর গাছ বাঁচানো যায়? 
আট দফার নির্বাচন শেষ। ভোটের ফল কী হয়, তার অপেক্ষায় বাংলার সঙ্গে প্রহর গুনছে গোটা দেশ। ২মে সেই অপেক্ষারও অবসান ঘটবে। তবে, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে চর্চা থেকেই যাবে। 
স্বশাসিত কমিশন আইনের চোখে ‘নিরপেক্ষ’ হলেও এবারের নির্বাচনে তারাই হয়ে উঠেছিল শাসক শিবিরের ‘প্রধান প্রতিপক্ষ’। কমিশনের একের পর এক জারি করা নির্দেশিকায় শুধু বিতর্কই তৈরি 
হয়নি, উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়। তাই অনেক সময় বিজেপির চেয়েও নির্বাচন কমিশনকে বেশি আক্রমণ করেছে রাজ্যের শাসক দল। 
২৬ ফেব্রুয়ারিই তৃণমূল কংগ্রেস ‘রেফারি’র ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। তবে বিজেপি নেতাদের ফু-য়ে যে রেফারির বাঁশি বাজবে, সেটা তখনও ভাবতে পারেনি। একের পর এক অফিসার বদলি ও নানা নির্দেশিকা বুঝিয়ে দিয়েছে, ‘কর্তা’র ইচ্ছায় কর্ম হচ্ছে। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমিশনই হয়ে উঠেছে শাসক দলের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। তৃণমূলের প্রায় কোনও দাবিই কমিশন মানতে চায়নি। উল্টে এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে বিজেপি সুবিধে পেয়েছে। তাই কমিশনের ‘নিরপেক্ষতা’র পাশে পড়ে গিয়েছে প্রশ্নচিহ্ন।
করোনার বাড়বাড়ন্তের সময় শুধু তৃণমূল নয়, রাজ্যের অধিকাংশ মানুষই চাইছিলেন, ভোটের দফা কমানো হোক। তাতে কিছুটা হলেও করোনার থাবা সঙ্কুচিত হবে। শেষ তিন দফার ভোট একবারে করার দাবি জানিয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু, মানা হয়নি। কেন্দ্রীয় বাহিনী কম থাকলে বুথ লুটের ভয়। তাই ভোট আট দফায়। কমিশন বুঝিয়ে দিয়েছে, মানুষের জীবনের চেয়েও মূল্যবান বুথ আগলানো। 
করোনার গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হওয়া সত্ত্বেও দিনের পর দিন সমস্ত রাজনৈতিক দল মিছিল, মিটিং করেছে। হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছেন। তাতে নেতাদের উল্লাসের নীচে চাপা পড়েছে করোনার মৃত্যুভয়। শুরু হয়েছিল ভিড় জমানোর প্রতিযোগিতা। এমনকী, যে প্রধানমন্ত্রী করোনাকে ঠেকাতে দিনের পর দিন মানুষকে ঘরে থাকতে বলেছেন তিনিই ১৭ এপ্রিল আসানসোলের জনসভায় ভিড় দেখে বললেন, ‘এমন ভিড় কোনও সভায় দেখিনি।’ করতালিতে ফেটে পড়েছিল সভাস্থল। ওই দিন ভারতে দৈনিক সংক্রমণের হার ছিল প্রায় ২ লক্ষ।
শেষ পর্যন্ত বিচারপতির তিরস্কারে সম্বিত 
ফিরেছে কমিশনের। আদালতের হস্তক্ষেপে 
অধিকাংশ মানুষ স্বস্তি পেয়েছেন। ব্যতিক্রম কেবল বিজেপি। বঙ্গ বিজেপির মুখপাত্র এই রায়ের পর বিচারপতির ‘প্রকৃতস্থ’ ছিলেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। অনেকে আবার মাদ্রাজ হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলছেন, ‘মুগুরের প্রয়োগ যথাযথ স্থানেই হয়েছে।’ 
আদালত ভোটগণনা বন্ধের হুমকি দিতেই কমিশন ‘বিজয় মিছিলে’র উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে বিরোধীরা ‘মরার সময় হরিনাম’ বলে কটাক্ষ করলেও এর পিছনে পাকা মাথার অঙ্ক দেখছেন অনেকে। তাঁদের মতে, কমিশনের অধিকাংশ সিদ্ধান্তে বিজেপির সুবিধে হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পিছনেও নাকি বিজেপিকে রক্ষা করার একটা অঙ্ক রয়েছে। 
অমিত শাহ, দিলীপ ঘোষরা যতই ২০০ আসনের দাবি করুন না কেন, কোনও সমীক্ষক সংস্থাই বিজেপিকে তার ধারেকাছেও আসন দেয়নি। উল্টে তৃণমূলের ক্ষমতায় ফেরার আভাসই মিলেছে। ফল যদি সেটাই হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের এই 
নির্দেশ বিজেপি কর্মীদের জন্য ‘সুরক্ষা কবচ’ 
হিসেবে কাজ করবে। পাশাপাশি বাংলার শান্তি 
রক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা নেবে। 
এবার বঙ্গের নির্বাচনী প্রচারের সুর প্রথম থেকেই বেশ চড়া ছিল। ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বদলা নেওয়ার হুঙ্কার যেমন বিজেপি দিয়েছিল, তেমনই ‘এবার আর রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজবে না’ বলে চমকে ছিল তৃণমূলও। নিচুতলায় তার প্রভাবও পড়েছে বেশ জব্বর। নির্বাচন মিটতেই বহু জায়গায় একপ্রস্থ মারামারি হয়ে গিয়েছে। ঘরছাড়া হওয়া ও জরিমানা আদায়ের ঘটনাও ঘটেছে। আপাতত সেই সব জায়গায় শান্তি বিরাজ করলেও উভয়পক্ষই ভোটের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে। ‘বদলা’ নেওয়ার অপেক্ষায়। সব মিলিয়ে নিচুতলায় অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। 
নির্বাচনের সময় দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা করার জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীই নানা কথা বলেন। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু দলবদলু নেতাদের হুঙ্কারে এবারে নির্বাচনী ময়দানের পারদ চড় চড় করে চড়েছে। নেতাদের ‘ভোকাল টনিকে’ কর্মীরা ঝামেলায় জড়িয়েছেন। অভিজ্ঞতা বলছে, লড়াইয়ে সব সময় গরিব মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হন। কারণ তাঁরাই লড়াইয়ের ‘বোড়ে’। এই অবস্থা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। আর বের করে আনার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলিকেই নিতে হবে। যাদের জন্য পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ, জল ঢালার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে। 
এখনও আমরা বাঙালি বলে গর্ববোধ করি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিবেকানন্দ আমাদের অহঙ্কার। তাঁদের শিক্ষাই আমাদের মধ্যে জাগিয়েছে ভ্রাতৃত্ববোধ, তৈরি করেছে বিপদের দিনে মানুষের পাশে থাকার মূল্যবোধ। সেই জন্যই ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পরেও বাংলাকে সেভাবে হিংসা 
ছুঁতে পারেনি। দেশ উত্তাল হলেও বাংলা ছিল 
অবিচল। একবার বা দু’বার নয়, এই দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে বহুবার। 
ফের একবার কঠিন পরীক্ষার মুখে আমরা দাঁড়িয়ে। একদিকে অগ্নিগর্ভ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অন্যদিকে করোনার ছোবল। এমন সঙ্কটের মুখে বাংলা এর আগে কখনও পড়েনি। এই অবস্থায় যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, করোনাই হোক তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ। রাজনৈতিক হিংসা, বিদ্বেষ ভুলে সবাইকে নিয়ে করোনার মোকাবিলায় ঝাঁপাতে হবে। বাঙালিকে যারা ‘কাঁকড়ার জাত’ বলে কটাক্ষ করে মজা লোটে, তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে, ‘সকলের তরে সকলে আমরা/প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ নীতিতেই বাংলা বিশ্বাসী। তাহলে বাংলার মানুষও বুঝবেন, যোগ্য দলকেই তাঁরা জয়ী করেছেন। তাঁদের পছন্দ ভুল হয়নি। যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ সব সময় পাওয়া যায় না। সঙ্কটকালেই দিতে হয় দক্ষতার প্রমাণ।
করোনা আবহে দ্রুত বদলে যাচ্ছে সব কিছুই। বদলে যাচ্ছে মানুষের চাহিদাও। সোনাদানা, গাড়ি বাড়ির চেয়েও বহু মানুষের কাছে মূল্যবান 
অক্সিজেন সিলিন্ডার। এই পরিস্থিতিতে বদল দরকার রাজনৈতিক নেতাদেরও। তাঁদের ভাবনার। কোনও রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি নয়, সঙ্কটকালে করোনাই হোক প্রধান প্রতিপক্ষ।
নারায়ণ দাভলকর। বয়স ৮৫। প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে নাগপুরের ইন্দিরা গান্ধী সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ভর্তি হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই নারায়ণবাবু জানতে পারেন, তাঁর অর্ধেকেরও কম বয়সি এক মহিলা স্বামীকে ভর্তি করার জন্য দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু হাসপাতালে বেড খালি নেই। কথাটা শোনামাত্র নারায়ণবাবু ডাক্তারবাবুদের বলেন, ‘আমি তো অনেক দিন বাঁচলাম। ওই যুবকের সংসার রয়েছে। স্ত্রী, সন্তান রয়েছে। সংসারে ওঁর বেঁচে থাকাটা খুব প্রয়োজন। তাই আমার বেডটি ওই যুবককে দিন।’ এই বলে তিনি মেয়েকে ফোন করে প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়েই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। বাড়িতে যাওয়ার পর নারায়ণবাবুর শ্বাসকষ্ট আরও তীব্র হয়েছিল। তিন দিনের মাথায় তিনি মারা যান।
না, ভুল বললাম। নারায়ণবাবু মারা যাননি। এই সমস্ত মহামানবের কখনও মৃত্যু হয় না। তাঁরা মরতে পারেন না। অবক্ষয় আর আস্ফালনের তাণ্ডবের মধ্যেও নারায়ণবাবুরা মাথা উঁচু করে যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন। সমাজের ‘জাগ্রত বিবেক’ হয়ে। 
নারায়ণবাবু রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের সদস্য ছিলেন। অন্যের প্রাণ বাঁচানোর জন্য নারায়ণবাবুর মহান আত্মত্যাগ বুঝিয়ে দিয়েছে, আরএসএস কোনও ব্যক্তির রাজনৈতিক উত্তরণের সোপান নয়, এ এক আদর্শ। তবে ব্যক্তি বিশেষে তার ফারাকও হয়ে যায় বিস্তর। একই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে কেউ দেন বদলার হুঙ্কার, ছুটে বেড়ান ক্ষমতার পিছনে। আবার কেউ অন্যকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করেন। করোনার এই সঙ্কটময় মুহূর্তে নারায়ণবাবুর জীবনদর্শনই হোক আমাদের আদর্শ।

1st     May,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ