বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

স্বাধীন ভারতে সবথেকে
কলঙ্কিত নির্বাচন
সন্দীপন বিশ্বাস

বাংলার ভোট নিয়ে রক্তাক্ত খেলায় মেতেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তার সব গোপন অভিসন্ধিগুলি একে একে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। মমতাকে শত কৌশলে আটকাতে না পেরে তারা বার বার ফাউল গেম করে চলেছে। সেই ফাউল গেমের দুই মাসতুতো ভাই নির্বাচন কমিশন এবং অমিতজির মালিকানাধীন কেন্দ্রীয় বাহিনী। নির্বাচন কমিশন বাংলায় আট দফায় ভোট ঘোষণার পরেই প্রশ্ন উঠেছিল, কেন আট দফায় ভোট? অন্য রাজ্যে তো এত দফায় ভোটের আয়োজন কমিশন করেনি? এখন তার জবাব মিলছে। প্রত্যেকটা পর্বের ভোট হচ্ছে, আর আমরা দেখতে পাচ্ছি, কেন্দ্র কীভাবে পোষ্য সংস্থাটিকে নিজের আজ্ঞাবহ হিসেবে ব্যবহার করছে। আগের সব নির্বাচনী নির্ঘণ্ট অনুযায়ী দেখেছি, ভোট নেমে আসত উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে। এখন ভোট সাজানো হয়েছে লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে বিজেপি প্রভাবিত এলাকাগুলি থেকে ক্রমান্বয়ে। যাতে দীর্ঘ ভোটের প্রচারে চিৎকার করে সম্ভাব্য ফল নিয়ে গলা ফাটিয়ে বলা যায়, ‘আমরাই জিতছি’। সেই সঙ্গে ভোটের দিনগুলিতে মোদির প্রচারের ব্যবস্থা করা। ভোটারদের পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করার জন্যই কি এমন ব্যবস্থা? নির্বাচন কমিশন কি তা না মেনে পারে? মোদ্দা ব্যাপার হল, আট দফা জুড়ে কেন্দ্রীয় ক্ষমতাকে অস্ত্র করে আধিপত্যবাদকে একটু একটু করে নানা কৌশলে সম্প্রসারিত করা। রাজ্যের মানুষের উপর পরোক্ষে একটা চাপ সৃষ্টি করা। কিন্তু সব কৌশল যুদ্ধক্ষেত্রে খাটে না। 
এখানেও প্রথম তিন দফার ভোটে যে বিজেপির কৌশল খাটেনি, সেটা গেরুয়া কর্তারা বুঝেছেন। বিজেপি বারবার চেয়েছে কম ভোট পড়ুক। বহু কেন্দ্রে মুসলিম মহল্লায় গিয়ে নাকি ভয় দেখানো হয়েছে, যাতে মুসলিম ভোট কম পোল হয়। কিন্তু প্রথম তিন দফার নির্বাচনে ভোটের শতকরা হার দেখে নার্ভাস হয়ে যায় বিজেপি। তাদের ভোটবাক্স যে নাড্ডাজির সভার মতোই শুনশান, তা টের পেতে শুরু করেছিল মোদি এবং অমিত শাহের সিন্ডিকেট। গোদের উপর বিষফোঁড়া, মোদিজির কাছে জমা পড়া কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর গোপন রিপোর্ট। তাতে বলা হয়েছে, বিজেপি এরাজ্যে এক তৃতীয়াংশেরও কম আসন পাবে। বেশ কিছু আসনে বিজেপি প্রার্থীরা তৃতীয় স্থান পাবেন। তাই চতুর্থ পর্যায়ের ভোট থেকে বিজেপির স্ট্র্যাটেজি বদল হল। জল ঘুলিয়ে দেওয়ার কৌশল। ঘোলা জলে মাছ ধরতে হবে। নাহলে আমও যাবে, ছালাও যাবে। আম ও ছালা বাঁচানোর লক্ষ্যেই অশান্তি পাকানোর ব্যবস্থা করা হল চতুর্থ দফার ভোটে। শীতলকুচিতে অমিত শাহের অনুগত কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে প্রাণ গেল চার জন নিরীহ ভোটারের। পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। কিন্তু কারা মরলেন? কেন ওঁদের মারা হল? কেন বুকে গুলি করা হল? ওরা কি জঙ্গি? জওয়ানরা কতটা আক্রান্ত ছিলেন? না, সাজানো রিপোর্টে তার কোনও সদুত্তর মিলবে না। শীতলকুচির খেলা খুবই শীতল মস্তিষ্কের। মৃত্যুর মতো হিমশীতল। কিন্তু বিপদের পর বিপদ। মমতা সঙ্গে সঙ্গে শীতলকুচি যেতে চাইলেন। আটকাতে হবে তাঁকে। কেন্দ্রের নির্দেশ পেয়েই কি নেতা-নেত্রীদের তিনদিনের শীতলকুচিতে ঢোকায় নিষেধাজ্ঞা আনল কমিশন? তাতেও এই ভোটের খেলায় মমতাকে আটকানো যাচ্ছে না! মারাদোনার মতো প্রতিপক্ষের ডিফেন্স চুরমার করে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। ওঁকে আটকাও যেভাবে হোক। জো হুজুর নির্বাচন কমিশন ২৪ ঘণ্টার জন্য মমতার প্রচার নিষিদ্ধ করে দিলেন। ভোট যত এগচ্ছে, আমরা দেখছি হারের আক্রোশে নখ-দাঁত বেরিয়ে পড়ছে। তবুও উদ্দেশ্য সফল হবে না। মানুষ সব বোঝেন। কার টিকি কোথায় বাঁধা, কে কার হাতের পুতুল আর টেবিলের তলায় কোন খেলা, মানুষ সব জানেন। বাংলার এবারের নির্বাচন স্বাধীন ভারতের সবথেকে কলঙ্কিত নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। একদিকে যখন মৃত্যুশোক। অন্যদিকে তখন বিজেপি নেতাদের আস্ফালন। তাঁরা গলার শিরা ফুলিয়ে বলছেন, ‘আরও মারা হবে।.. বুকে গুলি করে মারা হবে।.. পরবর্তী ভোটগুলিতে শীতলকুচির মতো ঘটনা বারবার ঘটবে।’ এসব দেখেশুনে রাজ্যের মানুষের প্রশ্ন, যেনতেন প্রকারে জিততে গা জোয়ারি খেলায় বাংলাকে কি আর একটা গোধরার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন গুজরাতের দুই ভূমিপুত্র? কিন্তু রাজ্যের শান্তিপ্রিয় মানুষ বুলেটের জবাব ব্যালটেই দেবেন। মানুষ দেখতে পাচ্ছেন দেশের কাজ চুলোয় গিয়েছে। দেশ এখন গৌণ। তেলের দাম, গ্যাসের দাম, রেলের ভাড়া, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসত্রের দাম বেড়েই চলেছে। দেশজুড়ে চলছে ক্ষুব্ধ মানুষের ধিক্কার। হুঁশ নেই প্রধানমন্ত্রীর। তিনি সব কাজ ছেড়ে এরাজ্যে পড়ে রয়েছেন। অতীতে এমন কম্ম কোনও প্রধানমন্ত্রীকে করতে দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী পদের একটা মর্যাদা আর সম্ভ্রম রয়েছে। সেটা গেলে থাকবে শুধু ক্ষমতাটুকই। মোদিজির দিল্লি-বাংলা ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করার মাঝখানেই বেড়ে গেল সারের দাম। অর্থাৎ কালা কৃষি আইনের বিষফল ফলতে শুরু করেছে। আরও বাড়বে। মোদি সরকার শিল্পপতিদের দাসানুদাসে পরিণত হয়েছে। কিছু করার ক্ষমতা সরকারের নেই। শুধু কথার বারফট্টাই। সেই কথায় ভুললে আগামী দিনে আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে। একবার ভেবে দেখুন, তাঁর ঘরের পাশে কৃষকরা গত সাত আট মাস ধরে আন্দোলন করছেন, শ’ পাঁচেক কৃষকের প্রাণ গিয়েছে। ক’বার তিনি তাঁদের সঙ্গে দেখা করেছেন? কতবার সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট হয়েছেন? হননি। কিন্তু হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মোদি-শাহ-নাড্ডাবাবু দিল্লি থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করছেন। এত টাকা আসছে কোথা থেকে? কে দিচ্ছেন? বাংলার মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাঁদের সন্দেহ, রহস্যজনক পিএম কেয়ার্স ফান্ড সেই টাকারই অফুরন্ত উৎস হতে পারে। নির্বাচনে টাকার অন্তহীন বেহিসেবি সাপ্লাই। সন্দেহ কি সত্যিই অমূলক? আমরা জানি না। শুধু জানি, এই ফান্ড এমন এক আলাদিনের ফান্ড, যার কোনও সরকারি অডিট হবে না। প্রধানমন্ত্রীর নামে ফান্ড, কিন্তু তা বেসরকারি অডিটের আওতাধীন। সন্দেহ যাঁরা করছেন, তাঁদেরই আর দোষ কি? নিজেকে নিষ্কলঙ্ক রাখার দায় তো প্রধানমন্ত্রীর নিজেরই! 
ওদিকে বিহার, উত্তরপ্রদেশের খবর জানেন তো? সেখানকার বেকার যুবকরা ব্যাগ গুছিয়ে বসে 
আছেন। সেখানে বিজেপি নেতারা বুঝিয়েছেন, বাংলায় পদ্ম ফুটলেই হিন্দিভাষী ছেলেমেয়েদের এখানে চাকরির স্লুইস গেট খুলে যাবে। আসলে 
বঙ্গ-হিন্দুত্বের গলায় গামছা দিয়ে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে হিন্দি-হিন্দুত্বের বৃত্তে। এতে খুব উৎসাহিত হিন্দি বলয়।
যে দলকে মানুষ সারা দেশ থেকে উৎখাত করার জন্য মুখিয়ে আছেন, তাকে আদর করে আসন পেতে ঘরে ডেকে আনা হতে পারে শতাব্দীর সেরা মূর্খামি। ভোট মিটবে। কোনও এক দল ক্ষমতা দখল করবে। তার আগে এতগুলি প্রচার সভা, এতগুলি রোড শো। বড় ভয় লাগছে। প্রশ্ন উঠছে, নির্বাচন কমিশনের যুক্তিহীনভাবে মোদির সব নির্দেশ পালন করার নিট ফল কি অশান্তি। সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি। চুলোয় যাক করোনা। আসল লক্ষ্য তো ক্ষমতা লাভ। মানুষের কথা ভাবার এত সময় ওদের কই? সুতরাং বাংলায় করোনা বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দায়ী থাকবে কে? নির্বাচন কমিশন কি?
একে রাজ্যে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ঝড়ের বেগে বাড়ছে। অন্যদিকে কোভিড ভ্যাকসিনের হাহাকার। কোভিড ভ্যাকসিন ভাঁড়ারে পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকা সত্ত্বেও মোদিজি টিকা উৎসবে মেতে উঠতে বললেন। টিকা না থাকার কারণে 
চার সপ্তাহ অন্তর দ্বিতীয় ডোজকে বাড়িয়ে ছয় সপ্তাহ করা হয়েছে। রাজ্যজুড়ে ভ্যাকসিনের এই হাহাকার সত্ত্বেও উদাসীন কেন্দ্রীয় সরকার। এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই প্রধানমন্ত্রীর। 
বিজেপির বাংলা জয়ের লক্ষ্যের পিছনে রয়েছে নিধন-বাসনা। সেই লক্ষ্যে দীর্ঘদিন চলছে মগজধোলাই। উড়েছে বস্তা বস্তা বেহিসেবি টাকা। বিজেপির আসল লক্ষ্য বাঙালির অস্মিতা নিধন, বাঙালির ভাষা নিধন, বাঙালির সংস্কৃতি নিধন, বাঙালির ঐক্য নিধন। বাঙালিকে হিরো থেকে জিরো করে দাসানুদাসে পরিণত করা। কিন্তু তা বোধহয় সম্ভব হল না। হিমাচল, পাঞ্জাবের লোকাল বডির নির্বাচনে বিজেপি হেরেছে। সাফ হয়ে গিয়েছে ত্রিপুরার উপজাতি পরিষদের নির্বাচনেও। মোদিজির নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র বারাণসীতেও একের পর এক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুছে যাচ্ছে বিজেপি। মোদিজির বিভেদমূলক নীতি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার বিরুদ্ধে এককাট্টা হচ্ছেন সেখানকার ছাত্র ও যুব সমাজ। পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে আসন বদল করতেই হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পথ দেখাবে বাংলা, অসম, তামিলনাড়ু, কেরল। ৪ রাজ্যের ভোটের ফলে বিজেপির ভরাডুবি বুঝিয়ে দেবে, বিজেপির শেষের শুরু এখান থেকেই। এখন ঈশান কোণে পাকিয়ে উঠছে চৈতালি ঝড়ের মেঘ। শোনা যাচ্ছে জননির্ঘোষ, ‘ঘর সামলাও চৌ...কি...দা...র।’ 

14th     April,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ