বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

বাংলার মহিলাদের জীবনে
এই ভোট কেন গুরুত্বপূর্ণ
হিমাংশু সিংহ

শেষে নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে এসে চার চারটি তাজা প্রাণ কেড়ে নিল মোদি-অমিত শাহের কেন্দ্রীয় বাহিনী। রক্তাক্ত হল নির্বাচন। বাংলার ভোট ইতিহাসে যা বেনজির। গুরুতর জখম হতে হল চোদ্দ বছরের এক নিরীহ কিশোরকেও। কোনও নিন্দাই এই ‘ট্রিগার হ্যাপি’ বাহিনীর জন্য যথেষ্ট নয়। এর থেকেই বোঝা যায় বাহিনীর হাতে বাংলার মানুষ মোটেই নিরাপদ নয়। বরং আরও বেশি বিপন্ন। রেকর্ড আট দফায় ভোট, হাজার হাজার জওয়ান, বাইরের পুলিস, বহিরাগত গুন্ডা, সবই বাংলা দখলের জন্য। সেই লক্ষ্য নিয়েই তারা কাজ করছে। প্রশ্ন উঠছে একটা নির্বাচনকে ঘিরে এই আগ্রাসন কেন? সাধারণ মানুষ তো বটেই, বিশেষ করে এই বঙ্গের শান্তিপ্রিয় মহিলারা এই প্রহসন মেনে নিতে নারাজ। তাই দিল্লির সরকারের রকমসকম দেখে তাঁরা নীরবে ফুঁসছেন।
বাংলার ভাগ্য নির্ণায়ক নির্বাচনে বহিরাগত গুন্ডাদের রুখে দিতে তাই দলে দলে মহিলারা ক্রমশ এগিয়ে আসছেন। তার প্রমাণ ভোটের লাইনে মহিলাদের ঢল। আশার কথা, ভোট যত এগচ্ছে মহিলাদের উৎসাহও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। কারণ এ রাজ্যের প্রায় সাড়ে সাত কোটি ভোটারের মধ্যে ৪৮ শতাংশই মহিলা। সংখ্যাটা কম নয়, সাড়ে তিন কোটির আশপাশে। তাই এবারের হাড্ডাহড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলার মা বোনেদের রায় নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে একটা ভোটকে কেন্দ্র করে সমাজটাই যখন দলবদলু আর বেইমানে ভরে গিয়েছে। আড়াআড়ি বিভক্ত হয়ে গিয়েছে মানুষ। আর এই বিভাজনের উপর দাঁড়িয়েই দলীয় সংগঠন নয়, বাইরের শক্তির উপর ভর করে যখন রাজ্য দখলের ছক কষছে গেরুয়া শিবির!
একটা কথা প্রায়শই বলা হয়, বাংলার মহিলারা হাজারো দুঃখ দুর্দশা সহ্য করতেও রাজি, কিন্তু বিশ্বাসভঙ্গ দেখলেই সপাটে রুখে দাঁড়ান। প্রয়োজনে দু’দিন না খেয়ে থাকবেন, শাড়ির খুঁট বারবার দাঁতে কাটবেন, চোখের জল ফেলবেন, কিন্তু বেইমানদের প্রতি একআনা করুণাও নৈব নৈব চ। প্রেমে, অপ্রেমে, রাজনীতি থেকে সমাজজীবনে এমনকী খেলার মাঠে পর্যন্ত সর্বত্র বাঙালি নারী এব্যাপারে আপসহীন। অসম্ভব জেদি, কঠোর ও অকুতোভয়। তার জন্য যে কোনও মূল্য দিতেও সে পিছপা হয় না। প্রয়োজনে মাটিতে মিশে যাওয়ার ঝুঁকি নিতেও তাই কুছ পরোয়া নেই। কিন্তু রং বদলানো গিরগিটিদের যেমন সে ক্ষমা করে না, তেমনি বিশ্বাসভঙ্গের সম্পর্ককেও বয়ে বেড়াতে খুব একটা ভালোবাসে না। এটাই বঙ্গ নারীর চিরকালীন ইউএসপি। তা রক্তের প্রতিটি কোষে, ডিএনএ’র সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। স্বস্তি আর স্বাচ্ছন্দ্য চাইলেও ভালোবাসে না ক্ষমতা আর টাকার উচ্চকিত আস্ফালন, মোটা টাকায় নেতা কেনাবেচা। বাইরে থেকে গুন্ডা নিয়ে এসে বেপরোয়া দখলদারি, দেওয়া নেওয়ার নামে নিছক ভণ্ডামি বঙ্গ ললনাদের কোনওদিনই পছন্দ নয়। মেরুকরণে বিভক্ত সমাজকে বরাবর মা-বোনেরা ঘৃণার চোখেই দেখে এসেছেন। উল্টে একটা সবুজ শান্তির নীড় খোঁজে সে যার ভিত্তিই হচ্ছে অকৃত্রিম বিশ্বাস। সেই সঙ্গে একটা সম্মানজনক বোঝাপড়া। সেই মতোই একটা ছোট্ট স্বপ্নকে অনেক কষ্টে সাজানোর নিরন্তর প্রয়াস চলে তাঁর। ইতিহাসের আবহমান ধারায় কোনও দল, কোনও ইজম কিংবা মতবাদ, রাজনৈতিক আগ্রাসন সহজে বাংলার নারীর চরিত্রের এই বজ্রকঠিন অথচ শান্ত কোমল দিকটার বদল ঘটাতে পারেনি। আজও পারবে না। এখানেই সে অনন্যা। অপরাজেয়। বাংলার সেই ঐতিহ্য ও সামাজিক শান্তির ঘেরাটোপটাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে এবারের নির্বাচনেও বাঙালি মহিলারা চোয়াল শক্ত করে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে প্রস্তুত। বলা বাহুল্য, কোনও বাধা না মেনেই সেই সিদ্ধান্ত তাঁরা নিচ্ছেন এবং সুস্পষ্ট মতাধিকার প্রয়োগ করছেন। নিঃসন্দেহে যা আশার কথা। এখানেই পরাজয় ঘটেছে গেরুয়া শক্তির। কারণ বাংলা দখল করতে গিয়ে তাঁদের নেতারা প্রথমেই হত্যা করেছে মানুষের বিশ্বাসটাকে। প্রশ্রয় দিয়েছে বেইমানিকে।
তাই অবিশ্বাসে ঘেরা দলকে হারিয়ে বাংলাকে বাঁচাতে, এই বঙ্গের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ণ রাখতে বাঙালি নারীর এক একটি ভোটের গুরুত্ব আজ অপরিসীম। ওখানে কোনও ভুলচুক হলে তাঁদের স্বাধীন মাথা উঁচু করে চলা অস্তিত্বটাই আগামী পাঁচ বছর বিপন্ন হতে বাধ্য। টালমাটাল হতে পারে তাঁর বড় চেনা পারিপার্শ্বিক সমাজটাই। এখানকার রাজনৈতিক ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস একটা চূড়ান্ত আগ্রাসী মনুবাদী দলের পুরুষতান্ত্রিকতায় হারিয়ে যাবে। ভুললে চলবে না, সামান্য একটা নির্বাচনই আজ আমাদের সমাজ চিন্তার গোড়ায় আঘাত করতে উদ্যত। এই সন্ধিক্ষণে তাই নিজের সঙ্গে গোটা সমাজের রসাতলে যাওয়া থেকে বাংলাকে রুখবেই আটপৌরে ঘরের মা, বোনেরা। এটা তাই সামগ্রিক নারীজাতির কাছে মুঠি শক্ত করে রুখে দাঁড়িয়ে শপথ নেওয়ারও উচিত সময়।
ইতিমধ্যেই যে ক’দফা ভোট হয়েছে তাতে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে উঠে এসেছে মহিলাদের লম্বা লাইন। যা আশা জাগিয়েই শুধু ক্ষান্ত হয়নি, প্রমাণ করেছে প্রত্যয়ী মুখে বর্গীর হানাদারি রুখতে বঙ্গ নারী কতটা অকুতোভয়। বোমা, গুলি, লাঠি কিছুই তাঁকে বশ মানাতে ব্যর্থ। নন্দীগ্রামে ভোটের দিন মুখ্যমন্ত্রী যখন অভিযোগ পেয়ে বয়ালের স্কুলে ঘাঁটি গেড়ে বসে তখনও দেখা গেল প্রত্যন্ত গ্রামের একদল মহিলা কেন্দ্রীয় বাহিনীর ছোটাছুটিতে ভয় না পেয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে লাইনে। পিছন পিছন আসছেন আরও অনেকে। ওই মা বোনেরা ভয় কাকে বলে জানেন না। ভোটার কার্ডটা বুকে আগলে মতদানের এই প্রবল উৎসাহ কীসের ইঙ্গিত? বহিরাগতদের ঠেকানোর? এই প্রশ্ন নিয়ে সেফোলজিস্টদের মধ্যে নিরন্তর গবেষণা চলছে, চলুক। কিন্তু সবকিছুকে আমল না দিয়েই আগামী চার দফাতেও সেই উৎসাহ হারও দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে ভোটযন্ত্রে যে আছড়ে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। গণ্ডগোল দেখেও ভোটের লাইন থেকে কিছুতেই সরতে দেখা যায়নি মা বোনেদের। এই শক্তিটা তাঁরা পাচ্ছেন কোথা থেকে? নন্দীগ্রাম থেকে আরামবাগ পেরিয়ে পুরশুড়া কিংবা খানাকুল গোটা দিন সেই একই চিত্র। 
আসলে এই শক্তি তাঁরা পাচ্ছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেই। তাঁরা জানেন দশকের পর দশক ধরে যেটুকু স্বাধীনতা তাঁরা লাভ করেছেন তা কিছুতেই নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। তাই বিশ্বাসঘাতক আর অসৎ ধান্দাবাজ দলবদলুতে ভরা একটা চরম সাম্প্রদায়িক দলের পক্ষে বাংলার মহিলারা তাঁদের আস্থাসূচক ভোটটা দিতে কিছুতেই রাজি নন। গোটা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা লোকলস্কর টাকার বস্তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেও না। অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁরা দেখেছেন, অজ গ্রামের মেয়ের দূর দেশের পক্ষীরাজে চেপে উড়ে আসা অচেনা রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ টেকে না। ভেঙে যায়। ওসব হাতিশালে হাতি আর ঘোড়াশালে ঘোড়ার গল্প আজ আর মা বোনেরা খুব একটা বিশ্বাসও করতে চান না। তাঁরা তাই গত চার দশকের পরীক্ষিত নেতানেত্রীদের উপরই আস্থা রেখে এগতে চান। জীবনের অভিজ্ঞতাই তাঁদের সেই শিক্ষাই দিয়েছে।
মহিলাদের জন্য কী করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? মহিলাদের সম্মান দিতে কন্যাশ্রী দিয়েছেন। যা আজ বিশ্বমঞ্চেও সমাদৃত। পরিবারের স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডটা গৃহকর্ত্রীর নামে করে বাংলার নারীজাতিকেও বিরাট স্বীকৃতি দিয়েছেন। ১৮ বছরের উপর সব বিধবাকে ভাতা দিয়ে তাঁদের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করেছেন। স্কুলের ছাত্রীরাও পেয়েছে সবুজসাথীর সাইকেল। ট্যাবের জন্য দশ হাজার টাকা। এটুকু স্বীকৃতি আর সম্মান তো আগে কেউ দেয়নি। সেই সঙ্গে একটা পরিচয় দিয়েছেন। সেই পরিচয়টা হচ্ছে, আপনি যে রাজ্যে থাকেন তা শাসন করেন একজন অসমসাহসী লড়াকু মহিলা, যাঁর সাহস আর তেজের সামনে মাথা ঝোঁকাতে বাধ্য হয় দিল্লির সরকারও। আর এই গৌরবগাথার উল্টোদিকে বিজেপি হুঙ্কার দিচ্ছে, ক্ষমতায় এলে অন্যরাজ্যের মতো লাভ জিহাদ বন্ধে কড়া আইন করবে। আর অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড তৈরি করে মেয়েদের গায়ে হাত তুলবে, বিচার করবে। কতবড় স্পর্ধা। মহিলাদের স্বাধীনতা হরণ করার এই অপচেষ্টা এবং সঙ্ঘের মনুবাদী সমাজে মহিলাদের কোণঠাসা অবস্থানের কথা বুক ফুলিয়ে বলার জন্য একদিন অন্তর রাজ্যে আসছেন উত্তরপ্রদেশের এক ভণ্ড যোগী। দিচ্ছেন নারী সুরক্ষার লম্বা চওড়া ভাষণ। অথচ, জাতীয় অপরাধ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (এনসিআরবি) রিপোর্টই বলছে, উত্তরপ্রদেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ, নির্যাতন লাফিয়ে বাড়ছে। যাঁর নিজের রাজ্যেই মহিলারা সুরক্ষিত নয়, সেই মুখ্যমন্ত্রী উড়ে এসে বাংলার মা বোনেদের সুরক্ষার কথা বলেন কোন আক্কেলে? চার দফার ভোট হয়ে গিয়েছে। বাকি আরও চার দফা। কলকাতা সহ বিস্তীর্ণ এলাকার মতদান এখনও বাকি। তাই এই সময়টা সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কারণ, এই নির্বাচনের ফলাফলের উপরই নির্ভর করছে, এই রাজ্যের নারী জাতির সম্মান শেষ পর্যন্ত থাকবে না যাবে। 
শুধু দেশ নয়, গোটা বিশ্ব আজ একজন মহিলার নামেই পশ্চিমবঙ্গকে চেনে। এই ব্যাপারে এলিট জ্যোতি বসুর চেয়েও আমাদের অগ্নিকন্যা কয়েক যোজন এগিয়ে। কারণ তিনি নিজের তৈরি করা সাধারণ মানুষের আস্থা জাগানো দলের অদ্বিতীয় নেত্রী। সেই সঙ্গে এ দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রীও বটে। এ বড় কম কথা নয়। বাংলার গর্ব 
এই মাটিতে বড় হয়ে ওঠা আপসহীন সাধারণ ঘরের মাথা উঁচু করা এক মহিলাকে হারাতে টাকা আর পেশিশক্তির নিরন্তর অপব্যবহার করে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। শত্রু মিত্র কেউ এই সহজ সত্যটা অস্বীকার করতে পারবে না। যত বড় ঝড়ই আসুক দমে না গিয়ে এক পা জখম নিয়েও যিনি বলতে পারেন, খেলা হবে। গোল হবে। জেতা হবে। এটাই তাঁর জিত। জগৎ কাঁপানো সেই মহিলার হ্যাটট্রিকের খেলাতেও তাই এই বঙ্গের প্রতিটি মহিলা তাঁদের অসামান্য যোগদানটুকু রাখতে বদ্ধপরিকর।

11th     April,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ