বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

পুরনো হিসেব পরে, এখন
শুধুই বাংলা ও বাঙালি
হারাধন চৌধুরী

মোস্তফা সরকার। আমার বাজারতুতো দাদা। বাজার করতে গিয়ে প্রায়ই তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। তাঁর ‘দেশের বাড়ি’ বীরভূমে। পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। একটি নামী কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থায় উচ্চপদে চাকরি করেছেন দীর্ঘদিন। অবসর নিয়েছেন সম্প্রতি। কলকাতায় বাড়ি বানিয়ে সস্ত্রীক বসবাস করলেও শেকড়ের টান তাঁর এখনও প্রবল। মানুষটি বিশেষভাবে রাজনীতি সচেতন। রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসেনও। কোনও রাখঢাক নেই তাঁর। 
মোস্তফাদা বলেন, আমাদের পরিবার জাত কংগ্রেসি। আমি তো বটেই, আমাদের পরিবারের কেউ ‘হাতচিহ্ন’ ছাড়া ভোট দেওয়ার কথা কখনও ভাবেনি। বাবা ছিলেন অঞ্চল কংগ্রেসের গণ্যমান্য ব্যক্তি। বয়সজনিত কারণে তিনি আর প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেন না। কিন্তু আমার নিজের এক সহোদর ভাই এবং এক জ্ঞাতি ভাই কংগ্রেসের টিকিটে ওই অঞ্চলে ভোটে লড়ে।  মোস্তফাদার এক ভাই ডাক্তার। পরিবারের একাধিক সদস্য ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিজনেস ম্যাজেনমেন্ট পেশাতেও যুক্ত। পেশাগত কারণে তাঁরা দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকলেও ভোটের সময় তাঁরা দেশের বাড়িতেই ফিরে আসেন। সকলেই গ্রামের ভোটার। রাজনীতি তাঁদের কারও পেশা নয়, কিন্তু পরিবারের পরম্পরা মেনে তাঁরা ভোটের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
মোস্তফাদার অকপট স্বীকারোক্তি, গত পঞ্চায়েত ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর আমাদের খুব রাগ হয়েছিল। কারণ, তাঁর পার্টি তৃণমূল অধিকাংশ কেন্দ্রে কংগ্রেসকে প্রার্থী দাঁড় করাতে দেয়নি। এনিয়ে কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটিও হয়েছে বিস্তর। কিন্তু গত লোকসভার ভোট থেকে বিজেপি বাংলায় মাথা চাড়া দিতেই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির পুনর্মূল্যায়ন করতে শুরু করেছি আমরা এই বিধানসভার ভোটে। তলিয়ে ভাবতেই হচ্ছে, একটামাত্র রাজ্যের ভোট নিয়ে গোটা গেরুয়া পরিবারের এত ইন্টারেস্ট কীসের! আরও চার জায়গায় ভোট হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসক দলের সেসব নিয়ে কোনও ইন্টারেস্ট আছে বলে তো মনেই হচ্ছে না। কেন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে পার্টির সর্বভারতীয় সভাপতিকে ডেইলি প্যাসেঞ্জার হতে হয়েছে? 
আমার বাজারতুতো আরেক দাদা হলেন গ্যাব্রিয়েল। বছর ছয় আগে প্রথম আলাপে চমকে দিয়েছিলেন সত্তরোর্ধ্ব মানুষটি। একে গ্যাব্রিয়েল নাম, তার উপর ভয়ানক স্মার্ট। ইংরেজি প্রশ্নের উত্তর যে ঝরঝরে বাংলায় দিয়েছিলেন তা ভোলবার নয়। আমার বিস্ময় ভাঙিয়ে দিয়েছিলেন নিজেই: শুনেছি কেরলের আলাপ্পুঝায় আমার ঠাকুর্দার জন্ম। ছিলেন মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার। কর্মসূত্রে অনেক রাজ্যে কাটাবার পর অবশেষে এই বাংলায় এসে থিতু হন। এখানেই আমার বাবার জন্ম। বাবাও কর্মসূত্রে নানা জায়গায় কাটালেও তাঁরও বিশেষ বাংলাপ্রীতি ছিল। তিনি এখানেই বিয়েথা করে থিতু হন। আমাদের চার ভাইবোনের জন্ম এই কলকাতাতেই। আমি নিজেও দীর্ঘদিন দিল্লি ও মুম্বইতে চাকরি করে সেই কলকাতার টানেই ফিরে এসেছি শেষমেশ। একটি কনভেন্ট স্কুলের রিটায়ার্ড টিচার আমার স্ত্রী। তিনিও কলকাতায় থাকতেই ভালোবাসেন। ইংরেজি, হিন্দিটা কাজের ভাষা হিসেবে রপ্ত করেছি। কিন্তু বাংলাটা আলাদা করে শিখতে হয়নি, যেমন আপনাদের। দুঃখের বিষয়, মালয়ালম, আমার পূর্বপুরুষের ভাষাটা শেখা হয়ে ওঠেনি। জানিও না, ‘দেশের বাড়ি’ বলে আর আদৌ কিছু আছে কি না।   
আলোচনায় প্রবেশ করে গ্যাব্রিয়েলদা যোগ করেন, শুনতে পাই বিজেপি রিচেস্ট পলিটিক্যাল পার্টি। কর্পোরেট আঁতাতে পার্টি যত বড়লোক হচ্ছে, আমরা তত গরিব হচ্ছি। আরএসএসের আইটি সেল দেশজুড়ে জাল বিস্তার করতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। অথচ ইপিএস থেকে পেনশন পাচ্ছি মাসে দেড় হাজার টাকা। স্বামী-স্ত্রীতে মোট হাজার তিন! এতে সংসার চলে কি? ভরসা ছিল স্মল সেভিংস। সেখান থেকেও আয় তো রোজ কমছে। ফের যদি চিটফান্ডের রমরমা হয়, সরকার কাকে দুষবে? দু’বছর হল হেলথ ইনস্যুরেন্সের প্রিমিয়াম আর জমা করতে পারি না। খুব চিন্তায় ছিলাম। সেই চিন্তা এবার দূর হয়েছে—মাস দুই আগে স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড পেয়েছি। তাই এবার ভাবতেই হচ্ছে, সবচেয়ে বড় বামপন্থী কে—ইয়েচুরি, না মমতা? বাম ছেড়ে মোদির রামে তো যাওয়া হবে না ভাই—আত্মহত্যা মহাপাপ নরকে গমন! 
পাশেই চারামাছ কাটতে দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মাঝবয়সি পুরকর্মী শিপ্রাদি। কুণ্ঠা ছেড়ে আলোচনায় যোগ দিলেন: আমরা নাকে ভাত খাই না। বুঝি, কেন ভোট এলেই বেচারা জওয়ানদের শহিদ হতে হয়। পুলওয়ামা থেকে বিজাপুর, সুকমায় জওয়ানদের অকালমৃত্যুর পিছনে কোনও রাজনীতি নেই—আমাদের বিশ্বাস করতে হবে! সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখে কোনও কথা শোনা যায়? তিনি কথা রাখতে জানেন না। যা বলেন, তাঁর সবটাই ফাঁকা আওয়াজ। আমাদের জীবন তো যা হোক করে চলে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েদের কী হবে! মোদিবাবুরা জানেন, ভোটযন্ত্রে এসবের বিরূপ ফল ভোটে পড়বেই। তাই তাঁর পার্টিকে কিছু নির্মম কৌশল নিতে হয়। 
ফের মোস্তফাদা: আমরা এটা বুঝে গিয়েছি, এই ভোটে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টক্কর নিতে পারেন একজনই। তিনি আর কেউ নন বাংলার বাঘিনী। তাই আমরা 
ঠিক করেছি, তাঁর উপর আর রাগ পুষে রাখা নয়। পুরনো হিসেব পরে হবে। আপাতত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত শক্ত করার পক্ষে আমরা। যারা কোনওদিন হাতচিহ্ন ছাড়া ভোট দিইনি, তারা তৃণমূলের জোড়াফুলেই ভোট দেব। বিষে বিষে বিষক্ষয়। বাংলায় পদ্মফুলকে রুখতে আমাদের ভরসা ঘাসের উপর জোড়াফুল। 
বাজারের কোণে দাঁড়িয়ে এইভাবে সময় কাটানো যখন চলছে, তখন এক বয়স্ক ব্যক্তি, নামটা জানার সুযোগ হল না, মন্তব্য করে বসলেন: আপনাদের পার্টি তো আব্বাসের দলের সঙ্গে জোট করেছে। সদাহাস্যময় মোস্তফাদাকে বেশ ক্ষুণ্ণ মনে হল। তিনি পাল্টা বলেন, এই হল আপনাদের সমস্যা। আপনাদের মতো শিক্ষিত কিছু বাঙালি ভদ্রলোক মনে করেন, মুসলিমরা বাঙালি নয়। বাংলার ভালোমন্দ তাদের কাছে বিচার্য নয়। তারা শুধু ‘অন্ধ’ মুসলিম সমাজ নিয়েই চিন্তিত। মুসলিম মানেই ধর্মীয় নেতাদের ‘ফতোয়া’ মেনে এককাট্টা হয়ে ভোট দেয়। 
মোস্তফাদা বলেন, এটা কিন্তু আমাদের প্রতি অন্যায়। আমাদের জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর। আমাদের মেয়েরাও কত শিক্ষিত হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে, আপনারা খোঁজ রাখেন না। এই যে আব্বাসের কথা বলছেন, ওঁকে মুসিলম সমাজের ক’জন মানে? হুগলির বাইরে ওঁর কোনও প্রভাব নেই। ফুরফুরা শরিফেরও সকলে তাঁকে মানে কি? আব্বাসের দল এবং মিমকে ভোট কাটুয়ার অতিরিক্ত বলে মনে করি না। ওরা আসলে বিজেপির হাতই শক্ত করছে। টিভির টক শোগুলো খেয়াল করুন, দেখবেন বিজেপির নানা স্তরের কিছু নেতা আব্বাস এবং হায়দারাবাদের ওয়েইসি সম্পর্কে কত ‘শ্রদ্ধাশীল’। আমি আমার সমাজকে যতটা চিনি, তা থেকে বলতে পারি, এবার আর হাত বা কাস্তে-হাতুড়ি, খাম নিয়ে বিশেষ কেউ মাথা ঘামাবে না। বেশিরভাগ সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের প্রতীকেই পড়বে। 
মোস্তফাদা যুক্তি দেন: আপাতত বাংলার ও বাঙালির বাঁচার লড়াইটাকেই আমরা বড় করে দেখছি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া কেউ মোদি-শাহের আগ্রাসন থেকে বাংলাকে ও  বাঙালিকে বাঁচাতে পারবেন না। এই ভোটের পর আমরা নিশ্চয় ফের কংগ্রেস হয়ে যাব। যাঁরা সিপিএম, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক, সিপিআই,এসইউসি প্রভৃতি আছেন তাঁরাও তাই হয়ে যাবেন। মোস্তফাদা বলেন, আমার কাছে খবর আছে, নন্দীগ্রামেও এই অঙ্কে ভোট পড়েছে। এতেই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে নন্দীগ্রামে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধির। মুখ্যমন্ত্রীকে শারীরিক আঘাত, ভোটের দিন তাঁকে রুখে দেওয়ার নষ্টামি কেন হয়েছিল আমরা জানি। খবর পেলাম, ভোটপ্রচারে সিপিএমের কিছু নেতা নন্দীগ্রামে গিয়ে বলেছেন, ‘বিজেপিকে হারাতে পারবে এমন প্রার্থীকেই ভোটটা দেবেন প্লিজ।’ ওঁদের পক্ষে সরাসরি তৃণমূলের হয়ে ভোট চাওয়ার অসুবিধা ছিল। তাই ওঁরা পরোক্ষে মমতাকেই জেতানোর বার্তা দিয়েছেন শেষের দিকে। তাতে ভালো কাজ হয়েছে বলেই আমাদের বিশ্বাস। আরও অনুমান করছি, রাজ্যের অনেক জায়গাতেই এই সমীকরণে ভোট পড়ছে এবং পড়বে। প্রধানমন্ত্রীর মেরুকরণের রাজনীতি যত জোরদার হচ্ছে, ‘বাংলার নিজের মেয়ে’র হাত শক্ত হচ্ছে তত, উনি তত বাঁচার প্রতীক হয়ে উঠছেন আমাদের।  
গ্যাব্রিয়েলদা নিশ্চিত: ‘ম্যানুফ্যাকচার করা’ ভোটসমীক্ষা নিয়ে টিভিতে নির্লজ্জ লাফালাফি চুপসে যেতে দেরি নেই। বাংলায় ভোটের তিন দফা হয়ে গেল। বিজেপির প্রতি মোহ বাকি পাঁচ দফায় আরও ভেঙে যাবে। তিনি মনে করেন, এবার অল্পবয়সি ব্রাইট কিছু ছেলেমেয়েকে প্রার্থী করাটা সিপিএমের অত্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু তার সুফল তারা পাবে না, কিছু ভুল পদক্ষেপের জন্য। মানিক সরকার এবং দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের পরামর্শ মানলে আগামী দিনে বামেদের ভালোই হতো। বললেন, আমার তো মনে হয়, বিজেপির প্ল্যানেই আব্বাসের দল কংগ্রেস-বামেদের জোটে ঢুকেছে। 
বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে কান খাড়া রেখেছিলেন কুবির ইশেদ। তাঁর সহকর্মী মানাদিও। মাছ হাতে ধারালো বঁটি সামলাতে সামলাতে মাঝে মাঝে ঠোঁটের কোণ বিশেষ অর্থবহ করে তুলছিলেন আধফোটা হাসিতে।

7th     April,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ