বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

মোদি-ভাবনা ও তার পরিণাম
পি চিদম্বরম 

আগামিকাল, মঙ্গলবার শেষ হবে অসম, কেরল, তামিলনাড়ু এবং পুদুচেরির ভোটগ্রহণ। পশ্চিমবঙ্গের আংশিক ভোটগ্রহণ হয়ে গিয়েছে। বাংলায় বাকি থাকছে আর পাঁচ দফার ভোটগ্রহণ। অসম এবং পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভালো প্রভাব রয়েছে। বাকি তিনটি জায়গাতেও পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে গেরুয়া শিবির। অসম ও কেরলে কংগ্রেসেরও সমান ভালো প্রভাব রয়েছে। এই দুই জায়গায় ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টায় আছে তারা। অন্যদিকে, তামিলনাড়ুতে কংগ্রেস চেষ্টা করছে যাতে ডিএমকে ক্ষমতায় ফিরতে পারে।
কোনও নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা চলে না। বিশেষ করে যেখানে অকংগ্রেসি, অবিজেপি দলগুলিই আসল খেলোয়াড় সেখানে কথাটি আরও বেশি খাটে। যেমন কেরলে সিপিএম, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল এবং পুদুচেরিতে এআইএনআরসি হল ‘কি প্লেয়ার’। এই প্রতিটি জায়গায় একজন করে বিতর্কিত হলেও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যাঁরা তাঁদের দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যেমন কেরলে পিনারাই বিজয়ন, পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এন রঙ্গস্বামী পুদুচেরিতে।
ডিএমকে, তৃণমূল জিতবে
ভোটের গতিপ্রকৃতি কী হতে চলেছে, প্রাক্‌নির্বাচনী সমীক্ষাগুলি শুধু সেটারই ইঙ্গিত দিতে পারে, ফলাফল বলে দিতে পারে না। বিভিন্ন সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে আমার মনে হচ্ছে, ডিএমকের নেতৃত্বাধীন জোট তামিলনাড়ুতে এবং পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস জিততে চলেছে। অসম এবং কেরলে প্রতিদ্বন্দ্বী জোটগুলি কমবেশি সমানে টক্কর দিচ্ছে। তাই ওই দুই রাজ্যেও এই ভোটে অবাক হওয়ার মতো রেজাল্ট হতে পারে। পুদুচেরি অবশ্য আমাদের দোলাচলে রেখেছে।
রাজ্যগুলির অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা (সেকুলারিজম), বহুত্ববাদ এবং তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের মতো একটি সাধারণ জায়গা থেকে লড়াই করছে কংগ্রেস। কিন্তু বিজেপির অ্যাজেন্ডা রাজ্যভিত্তিক। পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন বা সিএএ তাদের একটি ইস্যু। অথচ অসমে এটা নিয়ে তারা চুপচাপ। কারণ, তারা স্টাডি করে দেখেছে সিএএ নিয়ে অসমে উচ্চবাচ্য করলে তাদের সমস্যা আছে। অন্যদিকে, এটাই কেরল, তামিলনাড়ু ও পুদুচেরিতে একটি সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি। কংগ্রেস-মুক্ত ভারত নির্মাণের লক্ষ্য ঘোষণা করেছিল বিজেপি। ব্যাপক জোট গঠনের মাধ্যমে বিজেপির ওই স্বপ্ন ভেস্তে দিয়েছে কংগ্রেস। নির্লজ্জভাবে ও আগ্রাসী ভঙ্গিতে নিজের এই অ্যাজেন্ডা চাপিয়ে দিয়ে বিজেপি একটা বড় জুয়া খেলল।
ভোটের ফলাফলের বাইরে
চার রাজ্যের ভোটের ফলাফলটা হবে মানুষের এই মুহূর্তের স্বার্থের ব্যাপার। কিন্তু বৃহত্তর প্রশ্নটি হল, বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে বাকি তিনটি
বছর দেশ কীভাবে পরিচালিত হবে? মোদি সরকারের (বিশেষভাবে ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদির) শাসনের
মূল নীতিগুলি জলের মতোই পরিষ্কার:
প্রথমত, মিস্টার মোদি কোনওরকম বিরোধিতা বরদাস্ত করবেন না। প্রতিবাদী বিরোধী নেতা এবং বিরোধী দলগুলিকে সাজা দেওয়া হবে। কংগ্রেসকে বাদ দিলে যারা তাঁর ‘প্রাইম টার্গেট’, যাদের পিছনে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে—জম্মু ও কাশ্মীরে ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি), পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস, মহারাষ্ট্রে ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি), কেরলে সিপিএম এবং তামিলনাড়ুতে ডিএমকে। যাদেরকে রেয়াত করেছে বিজেপি তাদের মধ্যে আছে ওড়িশায় বিজু জনতা দল, অন্ধ্রপ্রদেশে ওয়াইএসআর কংগ্রেস এবং তেলেঙ্গানায় তেলেঙ্গানা রাজ্য সমিতি। নেতাসহ যেসব দলকে তোষণ করা হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিহারে জনতা দল এবং তামিলনাড়ুতে এআইএডিএমকে। একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের কর্তৃত্বকে ‘প্রোমোট’ করার জন্য অতীতে কেন্দ্রীয় সরকারি ক্ষমতার এমন নির্লজ্জ অপব্যবহার কখনওই হয়নি।
দ্বিতীয়ত, লোকসভায় বিজেপির নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা রয়েছে। রাজ্যসভাতেও কুড়িয়ে-বাড়িয়ে সাধারণ গরিষ্ঠতা অর্জন করার যোগ্যতা তাদের আছে। ভীষণভাবে অসাংবিধানিক এবং অন্যায় আইন পাশ করিয়ে নেওয়ার জন্য এই সুযোগটিকে ব্যবহার করা হবে। এই প্রসঙ্গে অতি সাম্প্রতিক দু’টি দৃষ্টান্ত হল: জম্মু ও কাশ্মীরকে ভেঙে দেওয়া এবং দিল্লির সরকারকে একটি মর্যাদাসম্পন্ন পুরসভার স্তরে নামিয়ে আনা। তার আগের দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে রয়েছে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন বা সিএএ এবং তিনটি কৃষি আইন। আরও কিছু আশা করা যেতে পারে। নানা কারণে আদালতগুলি থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়ার অর্থ—পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চূড়ান্ত ঘোষণা না-হওয়া পর্যন্ত এই আইনগুলির সংশোধন চলবে।
তৃতীয়ত, প্রশাসনের উন্নয়নের জন্য নতুন চিন্তাভাবনা, নয়া উদ্যোগ অথবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনও অবকাশ থাকবে না। একটারই অবকাশ থাকবে শুধু—মোদি-ভাবনা। একটি দৃষ্টান্ত হল, কোভিড-১৯ টিকাকরণ কর্মসূচি নিয়ে যে বিশৃঙ্খলা চলছে। প্রথম দফায় স্বাস্থ্যকর্মী এবং সামনের সারির যোদ্ধাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল। কিন্তু তার পরবর্তী সমস্ত পদক্ষেপই হল ভুলে ভরা। বিশেষভাবে বলতে হবে টলোমলো পর্বগুলির কথা—অ্যাপ, আগাম নাম নথিভুক্ত করার বাধ্যবাধকতা এবং আমলাতান্ত্রিক গাফিলতি। পালস পোলিও কর্মসূচির সঙ্গে এই টিকাকরণ অভিযানের বৈপরীত্য পরিষ্কার। পালস পোলিও টিকা খাওয়ানোর দিনক্ষণ সাদামাঠাভাবে ঘোষণা করে দেওয়ামাত্র হাজার হাজার মা তাঁদের সন্তানদের নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাজির হয়েছিলেন প্রতিটি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। আগামী জুলাইয়ের ভিতরে ৪০ কোটি টিকাকরণের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিণামে যে অযৌক্তিক বিলম্ব ঘটছে তাতে এই লক্ষ্যপূরণ করা কঠিন হবে। মাঝখান থেকে রোজ হাজার হাজার মানুষ করোনা সংক্রমণের শিকার হবেন এবং শ’য়ে শ’য়ে মানুষ মারাও যাবেন। এই একই ‘মোদি-ভাবনা অনুসরণ করো’ আইনের ফাঁদে পড়েছে সরকারের প্রতিটি কর্মসূচি—প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা থেকে ফসল বিমা। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় যে, উল্লিখিত দু’টি প্রকল্পই চূড়ান্তরূপে ব্যর্থ।
আরও দারিদ্র্য
চতুর্থত, আর্থিক ক্ষেত্রের পুনরুদ্ধারের জন্য যে পলিসি নেওয়া হবে সেগুলি কর্পোরেটদের স্বার্থেই নির্ধারিত হবে। যেহেতু সরকার জোগানদারদের সুবিধার দিক থেকে পদক্ষেপ করেছে, তাই ফিসকাল স্টিমুলাসের দাবিটি নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে, ‘রিকভারি’ বিলম্বিত হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার রয়ে গিয়েছেন, নতুন চাকরি হয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু, জনসংখ্যার প্রতিটি শ্রেণির আয়পত্তর কমে গিয়েছে, আরও বেশি মানুষকে দারিদ্র্য ও ঋণের ফাঁদে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। গরিব এবং মধ্যবিত্তের প্রতি সহানুভূতি পুরোপুরি উবে গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করতে হয় পেট্রল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের আকাশছোঁয়া দাম এবং ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের উপর সুদের হার নির্দয়ভাবে কমিয়ে দেওয়ার কথা। আর, এসব হচ্ছে এমন একটা সময়ে যখন মুদ্রাস্ফীতির হার খাতাকলমে ৬ শতাংশ এবং এটা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে।
কোটি টাকার প্রশ্ন হল, এই ভোটের রেজাল্ট কি মোদি-ভাবনার মূল নীতিগুলিকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে, নাকি সরকার এবং শাসক দলকে একটি জবরদস্ত ঝটকা দেওয়ার কারণ হয়ে উঠবে?
 লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত 

5th     April,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ