বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

রাজনীতির বিষ রং যেন
বাঙালির মর্মে না লাগে!
হিমাংশু সিংহ

২ মে ভোটের ফল যাই হোক, বিজেপি কিন্তু স্লোগান যুদ্ধের খেলায় অনেক আগেই হেরে গিয়েছে। আরএসএসের আদর্শে পুষ্ট সৈনিকরা ভেবেছিলেন ভোট যত এগিয়ে আসবে ততই ঢেলা-ইটের মতো ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিটাকে বাংলার মানুষের দিকে ছুড়ে দেবেন। আহত করবেন প্রতিপক্ষকে। কিন্তু, সেই কৌশল সফল হয়নি। 
উল্টে প্রায় একযুগ ধরে মধু খাওয়া দলবদলুদের ফুসলিয়ে এনে মাথায় তুলে নাচার পরিণাম দলের মধ্যে আদি আর নব্যের দ্বন্দ্বকে ভোটের ঠিক আগে দুর্বিষহ করে তুলেছে। সেই থেকেই গেরুয়া প্রার্থী তালিকা নিয়ে চরম অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। এঁরাই তো হলদিয়া, ডোমজুড়, কাঁচরাপাড়ায় সিন্ডিকেট চালিয়েছেন দশ বছর ধরে। এখন বাংলার শুদ্ধিকরণে তাঁরাই সামনের সারিতে থাকেন কোন যুক্তিতে! আর যাঁরা শুরু থেকে দলটা করলেন তাঁরাই বা আজ শুধু আঙুল চুষবেন কেন? এ কোন বাংলার স্বপ্ন ফেরি করছেন অমিত শাহরা। লড়াই যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধেই হবে, তাহলে বহু নিন্দিত পচা মুখগুলোই সামনে আসছে কোন যুক্তিতে! খোদ প্রধানমন্ত্রীর মঞ্চে আটজন বসে থাকলে তাঁদের পাঁচজনই দলবদলু! আর প্রার্থী তালিকায় দেড়শোরও বেশি বহিরাগত অন্য দলের। এ কোন মহান নাট্যকারের স্ক্রিপ্ট! 
তাহলে কি বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের পুঁজি আজ শুধুই বেইমানরা? এভাবে সোনার বাংলা গড়া যায়? তাহলে দেশটাই তো সাত বছরে সোনা দিয়ে বাঁধানো হয়ে যেত! আর এরাজ্যে তৃণমূলের পথ হারানো নেতাদের নিয়ে বড়জোর একটা ধর্মশালা হতে পারে, তার বেশি কিছু নয়! 
ঠিক তেমনি আগ্রাসী জয় শ্রীরামকে হারিয়ে দাবানলের মতো গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে ‘বন্ধু এবার খেলা হবে’ স্লোগান। শুধু ছড়িয়ে পড়েনি, ওই একটা স্লোগানেই মাত হয়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী 
থেকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাই প্রতিটি জনসভায় মোদিজির মুখে শোনা যাচ্ছে বিকৃত উচ্চারণে ‘খেলা হবে’র পাল্টা হুঙ্কার। কিন্তু বলতেই হবে, তা জমছে না। দাগ কাটছে না। পরক্ষণেই মানুষের মনেও থাকছে না। তাই সেই চেষ্টা ব্যর্থই বলা যায়। বিজেপির কৌশল ছিল শুধু ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে এবারের ভোট মাত করে দেবে। একই সঙ্গে হিন্দু জাগরণ ও সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলার চেষ্টারও ত্রুটি ছিল না। লক্ষ্য পরিষ্কার। এতে মেরুকরণও হবে আবার নেত্রীকে রাগিয়েও দেওয়া যাবে। কিন্তু কোনওটাই পারেনি। ভাঙা জখম পায়ে জেলার পর জেলা চষে বেড়াচ্ছেন নেত্রী, কোথাও ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে এবার তাঁকে বিব্রত করা যায়নি। কিন্তু ‘খেলা হবে’, এই একটা বার্তা চায়ের দোকান থেকে গঞ্জের হাট ছাড়িয়ে শহুরে বহুতলের ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাটের ড্রইংরুমেও ঝড় তুলেছে। এখানেই কয়েক যোজন এগিয়ে গিয়েছেন নেত্রী। তার অভিঘাত শোনা যাচ্ছে, হাইভোল্টেজ ‘ব্যাটলফিল্ড’ নন্দীগ্রামেও। অশীতিপর বৃদ্ধ পিতা বলেছিলেন, প্রয়োজন না পড়লে তিনি ছেলের হয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নামবেন না। নিশ্চয় নন্দীগ্রামে চাপ এসেছে তাই অবশেষে আড়াল ভেঙে তিনিও ছেলের হয়ে জীবনের অন্যতম কঠিন লড়াইয়ে অবতীর্ণ। মানতেই হবে শান্তিকুঞ্জ আজ অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখোমুখি। কয়েক দশক যাবৎ করেকম্মে খাওয়া মেদিনীপুরের গড় হাতছাড়া হওয়ার ভয় তাই তাড়া করছে গোটা পরিবারকে!
একটা ভোট সমাজকে আড়াআড়ি ভেঙে দেয়। সেই বিভাজনের ক্ষত পূরণ করতেই লেগে যায় বছরের পর বছর। তাঁরা বিষ ছড়িয়ে চলে যান, তাতে চিরস্থায়ী ক্ষতি হয়ে যায় গোটা জাতির, অনেক চেষ্টা করেও সেই ঘা সারে না। বাংলার চলতি নির্বাচন পর্ব সেরকমই অভূতপূর্ব বিভাজনের ভোট। বাংলার চেনা ভট্টাচার্য, মিত্র, সেনগুপ্ত, ঘোষ, বোসদের হটিয়ে বাংলায় অবাঙালিরাজ কায়েম করার লড়াই। এই লড়াইয়ের একদিকে দলবদলু লোভী বেইমানরা। দ্বিতীয়ভাগে ঘাঁটি আগলে থাকা টিকিট না-পাওয়া বঞ্চিত গেরুয়া শিবির। আদি বিজেপি নামেই যাঁরা বেশি পরিচিত। তৃতীয় ভাগে রয়েছে কোনও প্রলোভনে পা না দিয়ে পুরনো শিবিরেই থেকে যাওয়া মা-মাটি-মানুষের দল। চতুর্থভাগে সিপিএমের একঝাঁক উজ্জ্বল তরুণ মুখ। আর একদম শেষভাগে অধীর আর আব্বাস সিদ্দিকির দলের প্রার্থীরা। যদিও সবাইকেই ধর্মনিরপেক্ষ জোটের প্রতিনিধি ছাড়া অন্যকিছু বলতে মানা, কিন্তু আলিমুদ্দিনের মূল লক্ষ্য তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটে ভাঙন ধরানো। 
পশ্চিমবঙ্গের ভোটে যেমন কোনওদিন ত্রিশঙ্কু ফল হয়নি, তেমনি একসঙ্গে এতগুলি শক্তিকে কখনও রাজ্যের নির্বাচনে এভাবে সম্মুখসমরে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি বিধানসভার ভোটে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে রাজ্যের অলিতে-গলিতে ঢুকে একইদিনে একাধিক প্রচার সভা করতে। প্রশ্ন ওঠেই, বাংলা-দখলের এমন তাগিদ, এমন মরিয়া চেষ্টা কোন মধুভাণ্ড দখলের নেশায়? দেশের মানুষের কি আর কোনও সমস্যা নেই, কেন্দ্রীয় সরকারের কি এছাড়া আর কোনও কাজ নেই।
গরিবের ভোট কেনার জন্য আজ বাংলার আকাশে যত হাওয়াই জাহাজ আর কপ্টার উড়ছে, তা দিয়ে বাংলার গরিব নিরন্ন মানুষকে অন্তত ছ’মাস খাওয়ানো যেত! লকডাউন কিংবা উম-পুনের পর মানুষ যখন অসহায়, তখন ঘন ঘন রাজ্যে আসতে এঁদের দেখা যায়নি কেন? প্রশ্নটা কি খুব অপ্রাসঙ্গিক? বিনাপয়সার চাল রাঁধতে ন’শো টাকার গ্যাস, ধর্মে সইবে তো! নির্বাচনে এই বিপুল ব্যয় না করে রান্নার গ্যাসের দাম কি একটু কমানো যেত না? পিএম কেয়ার্সের টাকা কার ভোগে লাগল! পেট্রপণ্যের দাম কমানো নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ কোনও পদক্ষেপ করল না কেন? জিতে এলে রাজ্যে সপ্তম বেতন কমিশন কার্যকর করার রঙিন বেলুন উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু এই ক’বছরে ত্রিপুরায় কি সপ্তম বেতন কমিশন কার্যকর হয়েছে? এ প্রশ্ন মানুষ তুলবেন না? পশ্চিমবঙ্গে মতুয়াদের মন জয়ে সিএএ নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি থাকলেও অসমে গেরুয়া ইস্তাহারে নাগরিকত্ব ইস্যু বেমালুম উধাও। এই দ্বিচারিতা আর মিথ্যার ফুলঝুরির আসল অর্থটা কী? ভোট, গণতন্ত্র সবই তো মানুষের জন্য। তাহলে সেই জনগণকেই আগাগোড়া বোকা বানানোর খেলা আর কতদিন মানুষ সহ্য করবে। সবাই জানেন, ভোটের আগের দিন পর্যন্ত নেতানেত্রীরা বলেন, ‘মানুষই শেষ কথা বলবে। যাই ঘটুক, আইন আইনের পথে চলবে।’ কিন্তু ভোট মিটলেই জনগণ আবার সেই গহীন আঁধারে ডুবে যায়, তখন শুধু নেতারাই শেষকথা বলেন, আইনও বেমালুম পোষ মেনে চলে তাঁদেরই। আমরা যতই গণতন্ত্রের বড়াই করি, বাস্তবের মাটিতে এটাই দস্তুর। সেই দিক দিয়ে বাংলায় এবারের ভোট বহুমাত্রিক ক্যানভাসে আঁকা এক বর্ণময় ছবি, যার তল পাওয়া ভগবানেরও অসাধ্য!
এই ভোট বাংলার মহিলাদের কাছেও নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ। কেউ কি  এই পশ্চিমবঙ্গকে সাধ করে উত্তরপ্রদেশ বানাতে চান। গত কয়েক মাসে 
হাতরাস, কানপুর, মীরাট থেকে গত কয়েক মাসে নারীনিগ্রহ আর মহিলার সম্মান লুণ্ঠনের যে খবর সামনে এসেছে তার তুলনায় বাংলার অবস্থা শতগুণে ভালো। ভোট দেওয়ার সময় মা বোনেরা নিশ্চয় কথাগুলি অক্ষরে অক্ষরে মনে রাখবেন। এখনও এ রাজ্যে রাত দশটার সময়ও মহিলারা বিনা আতঙ্কে ঘুরে বেড়াতে পারেন। এ বড় কম কথা নয়। অন্য অনেক রাজ্যেই এখন তা দিবাস্বপ্ন।
এবারের আট দফার মধ্যে শনিবার প্রথমদফা কাটল। কিন্তু এত কেন্দ্রীয়বাহিনী নামিয়েও ভোটগ্রহণপর্ব সম্পূর্ণ শান্তিতে মিটল না। সকাল থেকেই ইভিএম খারাপ, প্রার্থীদের ঘিরে গণ্ডগোল এবং এমনকী ভোটারদের মার খাওয়ার ছবি পর্যন্ত দেখা গেল। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ভোট পড়েছে প্রায় ৮৫ শতাংশ। রেকর্ড আটদফায় এত বাহিনী এনে ভোট করিয়েও সম্পূর্ণ শান্তি রক্ষা করা গেল না কেন, এই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। বাকি আছে আরও সাত দফার ভোট। ভোটগ্রহণ পর্বের মধ্যেই আবার আজ রঙের উৎসব। তাই আশা ও আশঙ্কার দুলুনিটা বড় কম নয়। বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতির উপর বহিরাগত আগ্রাসনের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে এসেছে দোল উৎসব। বাঙালিকেই ঠিক করতে হবে তার ভবিষ্যৎ। রবীন্দ্রনাথের ভাবনার বসন্ত উৎসব, দোল বাঁচবে, না আগামী বছর থেকে তা অবাঙালি হোলির গর্ভে চিরবিলীন হয়ে যাবে, এই প্রশ্ন আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এরা খাওয়াকে বলে ভোজন। দলের সাংগঠনিক মাথাকে বলে প্রভারী, কারিয়া কর্তা। বুথ পিছু থাকেন একজন করে মণ্ডল সভাপতি। এই রেওয়াজ বাংলার সংস্কৃতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সেই বহিরাগত অপ-সংস্কৃতি কি এবার গ্রাস করবে পবিত্র দোলের পূর্ণিমাকেও! নির্বাচনের হানাহানিতে দীর্ণ রোদনভরা এবারের দোল তাই বাঙালির অস্মিতাকে বাঁচিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়েই দরজায় হাজির। দেখতে হবে সাম্প্রদায়িকতা, বিভাজন রাজনীতির বিষ মাখানো রং যেন আম বাঙালির চোখে মুখে এবং অবশ্যই মর্মে না লাগে। উদ্বেল রঙের উৎসব যেন কলুষিত না হয়, দোল যেন বাঙালির একান্ত নিজস্ব হয়েই বেঁচে থাকে যুগ যুগ ধরে। রাজনীতির বিষ বিভাজনের প্রবেশ সেখানে নিষেধ।

28th     March,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ