বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

নন্দীগ্রাম নয়, মমতার চ্যালেঞ্জ একলপ্তে ২৯১
শান্তনু দত্তগুপ্ত 

মোক্ষম জবাবটা দিয়েছেন ওমর আবদুল্লা। গত শনিবার বেহালার মুচিপাড়ায় শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, ‘তৃণমূল ক্ষমতায় ফিরলে পশ্চিমবঙ্গটা কাশ্মীর হয়ে যাবে।’ ২০১৯ সালে কাশ্মীর থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিদায় নেওয়ার পর থেকে ওমর আবদুল্লা ভালোই ভুগছেন। গৃহবন্দিত্বের নামে আক্ষরিক অর্থে কয়েদ ছিলেন তিনি। তাই শুভেন্দুবাবুর এহেন মন্তব্যের জবাব দেওয়ার লোভ সামাল দিতে পারেননি। ট্যুইট করেছেন, ‘আপনাদের মতো বিজেপিওয়ালাদের কথা অনুযায়ী, উনিশ সালের আগস্ট মাস থেকে কাশ্মীর তো স্বর্গ হয়ে গিয়েছে! তাহলে বাংলা যদি কাশ্মীর হয়ে যায়, তাতে অসুবিধা কোথায়? যাই হোক, বাঙালিরা কাশ্মীর ভালোবাসেন... বিপুল সংখ্যায় এখানে ঘুরতেও আসেন। তাই আপনার এই বোকা বোকা এবং কুরুচিকর মন্তব্যের পরও আপনাকে ক্ষমা করলাম।’ শুভেন্দুবাবু এই ক্রিকেট টিমে নতুন এসেছেন। হোম গ্রাউন্ডের পিচ তো দূরঅস্ত, দলের স্ট্র্যাটেজিটাই জানেন না। জানলে এমন বেফাঁস কি বলতেন? হয়তো না। তাঁর উপর এখন বিস্তর চাপ। নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী হতে হয়েছে তাঁকে। উপায়ও ছিল না! আগেই বড় মুখ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলেন তিনি। নিজেও জানেন, নন্দীগ্রামে জিততে পারলে তবেই শুভেন্দু অধিকারী নামটির রাজনৈতিক অস্তিত্ব ভবিষ্যতে থাকবে। আর হারলে? পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে ধূসর হয়ে যাবে তাঁর স্মৃতি। বিদ্রোহ করে দল ছেড়েছেন তিনি। বড্ড বোঝা এই বিদ্রোহের। গণতন্ত্রে তো বটেই। যে মুহূর্তে তিনি দলত্যাগী, ঠিক তখন থেকে শুভেন্দু অধিকারী ভোটারদের স্ক্যানারে। বিজেপিও সেটা বিলক্ষণ জানে। তাই বাংলায় তৃণমূলের সবচেয়ে সেফ আসনটিতেই পরীক্ষার মুখে ফেলেছে তাঁকে। ভাবটা এমন... জিতে এসো দেখি! জিতলে বিজেপির ভালো, হারলে তোমার ‘দাপট’ আর আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে না। তার মধ্যে তোমার থেকে যতটুকু উশুল করার, সে তো করেই নেব!
এই চ্যালেঞ্জ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নয়। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে যে প্রার্থীই দাঁড়ান না কেন, ওজনে বিস্তর ফারাক রয়েই যাবে। নন্দীগ্রাম নিয়ে এই ক’দিনে প্রচুর লেখা ও বলা হয়েছে। কিন্তু যে কথাটি বলা হয়নি তা হল, গেরুয়া শিবির কিছুতেই নন্দীগ্রামের মাটিকে জমি আন্দোলনের ভরকেন্দ্র হিসেবে দেখতে চাইছে না। নন্দীগ্রামের সঙ্গে কোনওভাবে মমতার আত্মিক যোগ নতুন করে প্রতিষ্ঠা হয়, চাইছে না সেটাও। তাই প্রচারের যাবতীয় অভিমুখ ধর্মীয় মেরুকরণের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়াটাই তাদের লক্ষ্য ও মোক্ষ। নন্দীগ্রামে ৩০ শতাংশ ভোটার সংখ্যালঘু। তাই বিজেপি চাইছে ৭০-৩০ অঙ্কেই ভোটটা সেরে ফেলতে। গেরুয়া শিবির ভেবে নিয়েছে, এই কেন্দ্রের হিন্দু ভোটের সবটাই তারা ঝুলিতে পুরবে। আর বাম-কংগ্রেস-আব্বাস জোট মুসলিম ভোট কেটে নেবে। তাহলে মমতার জন্য থাকল কী?
সমীকরণটা কিন্তু এতটাও সহজ নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, রাজ্যের ২৯৪টা আসনে তিনিই প্রার্থী। তৃণমূলের একমাত্র মুখ তিনিই... এই ধারণা বাদ দিয়েও আর একটা কনসেপ্ট এই ভাবনার নেপথ্যে রয়েছে। সেটা হল, বাংলার প্রত্যেকটা আসনকে তিনি সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। পাহাড় হোক বা সমতল, মাটির চরিত্র বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় ভোটারের আবেগ, প্রয়োজন। সেটাও তিনি সেই এলাকার মানুষের মতোই বোঝেন। আর তা শুধু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নয়, বিরোধী নেত্রী থাকার সময় থেকেই। তাই নন্দীগ্রাম নিঃসন্দেহে তৃণমূলের সবচেয়ে সেফ সিট। আর এই কারণেই এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চ্যালেঞ্জ নয়।
সত্যিই কোনও চ্যালেঞ্জ যদি মমতা নিয়ে থাকেন, তাহলে সেটা হল, ২৯১ আসনের প্রার্থী একবারে ঘোষণা করে দেওয়া। শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে বুঝিয়েছিল, ধাপে ধাপে ঘোষণা করুন... বিজেপি এবং জোটের মতো। তাহলে বিক্ষুব্ধরা একবারে ধাক্কা দিতে পারবে না। সুপ্রিমো কিন্তু তা করলেন না। সবক’টি আসনে একবারে প্রার্থী ঘোষণা করে তিনি বার্তা দিলেন, যাদের যাদের বিক্ষোভ দেখানোর, এখনই দেখিয়ে নাও। যারা যেতে চাও, তারা চলেও যাও। শূন্যস্থান তৈরি হবে, আবার সেটা একবারে পূরণও হবে। সেটাই দরকার। ধাপে ধাপে স্ট্র্যাটেজি তিনি তৈরি করবেন না। গোছানোর কাজটা তিনি করবেন একলপ্তে। এলিট ক্লাসের বিরোধীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যঙ্গ করে থাকেন। কিন্তু এমন কিছু সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে, রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি কতটা পরিণত। যা তিনি অর্জন করেছেন ধীরে ধীরে... বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ে। সেবারও কিন্তু তিনি চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন। বছরের পর বছর, এক একটা নির্বাচনে তাঁর দলের হার হয়েছে, তিনি শিখেছেন। তারপর সেই শিক্ষা প্রয়োগ করেছেন পরবর্তী ভোটযুদ্ধে। বিশ্বাস ছিল তাঁর... বাংলার মানুষের উপর। নিশ্চিত ছিলেন, আজ না হয় কাল বাংলা তাঁর এই লড়াইকে মান্যতা দেবে। বুঝবে, পরিবর্তন দরকার। মানুষ বুঝেছিল। যার ফল ২০১১ সালের ভোট। বিরোধী নেত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী... হার আর জিতের মধ্যে দিয়ে আরও আরও পরিণত হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই চ্যালেঞ্জটা তিনি ফিল্টার করতে পারেন। বুঝতে পারেন, কোনটা নিতে হবে, আর কোনটা এড়িয়ে গেলে চলবে। এবারও তিনি অনুভব করছেন, লড়াইটা খুব সহজ নয়। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ‘ডাবল ইঞ্জিন’ প্রচার, চাকরির প্রতিশ্রুতি, ‘সোনার বাংলা’ গড়ার ডাক, ফের পরিবর্তনের হুঙ্কার... সব কিছুর নেপথ্যেই গোছানো কৌশল আছে। এ রাজ্যে বিজেপির সংগঠন মোটেও তেমন মজবুত নয়। লোকসভা ভোটে ৪২টার মধ্যে ১৮টা আসন দখলের পরও না। এখনই তাদের মধ্যে আদি-নব্যের সংঘাত, এখনই অবিশ্বাসের বাতাবরণ, মাত্র দু’দফার প্রার্থী ঘোষণার পরই জেলায় জেলায় বিক্ষোভ। তাও তো আগে তালিকা ঘোষণা হয়নি! প্রার্থী ঘোষণার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়... কবে তৃণমূল ঘোষণা করবে, আর সেই বুঝে সাজবে সেনা। কিন্তু প্রচার? তাতে কোনও ফাঁক নেই। দিল্লি থেকে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা আসছেন... আক্রমণের ঝাঁঝ বাড়াচ্ছেন। এটাই আপাতত বিজেপির ব্রহ্মাস্ত্র। মানুষ পাশে আছে কি না, জানে না গেরুয়া শিবির। তাও ঝুঁকি নিতেই হবে। এটা প্রেস্টিজ ফাইট। নরেন্দ্র মোদিকে মুখ করেই... এই বঙ্গে যে আর কোনও মুখই নেই! সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম কয়েকদিন ঘোরাফেরা করল, কিন্তু তাও শেষমেশ দানা বাঁধল না। এবার কি মিঠুন চক্রবর্তী? ব্রিগেডে মোদির জনসভায় বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন তিনি। অনেক ফিল্মি ডায়লগও আউড়েছেন। কিন্তু ভোটের খেলা অন্য। এখানে কোনও রিটেক নেই। এই নাট্যশালা বড্ড কঠিন ঠাঁই। তাই চ্যালেঞ্জটা মমতার নয়, বিজেপির।
গত কয়েক বছরে একের পর এক রাজ্য হাতছাড়া হয়েছে মোদির... একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং ডাবল ইঞ্জিনের টোপ সত্ত্বেও। তাহলে বাংলা কি এই প্রচারে সাড়া দেবে? নরেন্দ্র মোদি আত্মবিশ্বাস দেখাচ্ছেন। কিন্তু বঙ্গ বিজেপির সত্যিকারের মুখ যদি কেউ থেকে থাকেন, সেই দিলীপ ঘোষকে তাঁর নিজের এলাকা থেকেই প্রার্থী করেননি। তাহলে কি অন্য কোনও আসন থেকে দিলীপবাবু দাঁড়াবেন? হয়তো। আবার নাও হতে পারে। দিলীপ ঘোষ প্রার্থী হলেন, তারপর হেরে গেলেন... তাতে কিন্তু আদপে গেরুয়া শিবিরই অস্বস্তির মুখে পড়বে। তাই হয়তো আপাতত অপেক্ষা করছে বিজেপি! বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে একটা উপনির্বাচনে দিলীপবাবুকে জিতিয়ে আনা কঠিন হবে না। এখন মনোনিবেশ থাকুক শুধু মমতায়... কেন্দ্রের সরকারে থাকায় মোদিজির হাতে মেশিনারি আছে। রয়েছে স্ট্র্যাটেজি তৈরির ক্ষমতাও। সব মিলিয়ে আটকাতেই হবে তৃণমূল সুপ্রিমোকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি এই যুদ্ধে জিতে যান, তাহলে গোটা দেশে মোদি-বিরোধী জোট আরও শক্তিশালী হবে। তা কিছুতেই হতে দিতে চায় না গেরুয়া শিবির। তাই আঁটসাঁট হচ্ছে চক্রব্যূহ।
একটা খবর বেরিয়েছিল সংবাদ ভাস্করে। সময়টা ১৮৪৯ সালের ৭ জুলাই... ‘নগরে মহান গোল উঠিয়াছে, মেং লা জানবাজার নিবাসিনী রাজচন্দ্র রায় বাবুর স্ত্রী শ্রীমতী রাসমণী দাসীর রূপ্যময় রথ চালাইতে দেন নাই। পোলিস চৌকীদার দ্বারা পথ রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। তজ্জন্য রাসমণী দাসী লা সাহেবের নামে সুপ্রিমকোর্টে অভিযোগ করিয়াছেন কিম্বা তাহার উদ্যোগ করিতেছেন। ইহা যদি সত্য হয় তবে আমরা শ্রীমতী রাসমণী দাসীকে ধন্যবাদ দিব।’ কেন ধন্যবাদ? কারণ, জানবাজারে তখন রানি রাসমণি দোর্দণ্ডপ্রতাপ। তিনি চাইলে তখনই পেয়াদা দিয়ে লা সাহেব শুধু নন, তাঁর পুলিস চৌকিদারদের পর্যন্ত পিটিয়ে ভাগিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি রাগ সংবরণ করলেন এবং আইনের দ্বারস্থ হলেন। ব্রিটিশ ভারতে বাংলার রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থা... সেই শেকল ভেঙে লড়াইটা পৌঁছে দিলেন রাজতন্ত্রের দরবারে। অসম যুদ্ধ, তাও সঠিক পথটাই নিলেন রানি রাসমণি। চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন রাজদণ্ডকে লক্ষ্য করে।
আজ রাজতন্ত্র নেই। গণতন্ত্রে আমরা নির্বাচিত করি শাসককে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিন্তু গণতন্ত্রের পরিধির মধ্যে থেকেই চ্যালেঞ্জটা ছুড়েছেন। দশ বছর আগে পরিবর্তনের পর তাঁর স্লোগান ছিল, ‘বদলা নয়, বদল চাই।’ বিজেপির বাড়বাড়ন্তের সময়ও কিন্তু সেই স্লোগানে বদল আনেননি মমতা। আর আজ বিজেপি বলছে, পরিবর্তন হলে বদলাও হবে। তাহলে সংবিধান মেনে আজ যুদ্ধে কে নেমেছেন? উত্তরটা স্পষ্ট। কিন্তু বাংলার মানুষ কি সেই ‘দুঃসাহস’কে সম্মান জানাবেন? 

9th     March,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ