সেশন সাহেব, বড্ড মিস করছি আপনাকে।
আপনি বলতেন, ‘গণতন্ত্র হল এমন একটা ব্যবস্থা, যেখানে আইনের শাসন সবার জন্য সমানভাবে বলবৎ থাকবে।’ সব মানুষের জন্য। সব রাজনৈতিক দলের জন্য। আপনি প্রমাণ করেছেন, এটা ছেলে ভুলানো গল্প নয়। ভারতে এমনটা হয়, করা যায়... চাইলে ভোটের সময়ও। হিমাচল প্রদেশের রাজ্যপাল গুলশের আহমেদ মধ্যপ্রদেশে গিয়ে নিজের ছেলের জন্য প্রচার চালাচ্ছেন? বাতিল করে দিলেন সাতনা কেন্দ্রের নির্বাচন। শেষমেশ পদত্যাগ করতে হল রাজ্যপাল মহাশয়কে। পাপ্পু যাদব বড্ড ঝামেলা করছে... নাগাল্যান্ড থেকে ফোর্স এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন উত্তরপ্রদেশ-বিহার সীমানায়। বিধায়ক ‘ডন’ পাপ্পু যাদবকে আটকে দিল তারা... ‘না, আপনি উত্তরপ্রদেশে ঢুকতে পারবেন না।’ কারণ তারা স্থানীয় ডনকে চিনত না। দাদাগিরি ওখানে এক পক্ষই করবে... নাগাল্যান্ডের জওয়ানরা। আপনার ব্যাপারে রিটার্নিং অফিসাররা বলতেন, ‘এবার আর পালানোর পথ নেই। ক্ষমাহীন একটা লোকের অনুগ্রহের অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে।’
আজ তাই আবার আপনাকে বড্ড মিস করছি।
আট দফায় ভোট। নির্ঘণ্ট প্রকাশ থেকে গণনা—৬৬ দিন। আর আসন সংখ্যা—২৯৪। যুক্তি দিয়েছেন এখনকার মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরা। বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলি বারবার পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অভিযোগ জানিয়েছে। তাই এমন ব্যবস্থা। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নিজের নেটওয়ার্কও কি ঠিক একই রিপোর্ট দিয়েছে? এই রাজ্যের হাল কি বিহার বা উত্তরপ্রদেশের থেকেও খারাপ? ক্রাইম রেকর্ডের প্রতিটা স্তরেই তো ওই দুই রাজ্য বাংলার থেকে অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী! কেন্দ্রীয় সরকারি পরিসংখ্যানেই তার প্রমাণ মেলে। তাহলে শুধু বাংলার জন্য এই অভিনব ব্যবস্থা কেন?
সিপিএমের রিগিং-ইতিহাস ঈর্ষণীয়। বছরের পর বছর কখনও চোরাগোপ্তা, কখনও খুল্লামখুল্লা রিগিং করে তারা বাংলা নিজেদের দখলে রেখেছিল। প্রথমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিরোধীদের অভিযোগ, তারপর নির্বাচন কমিশনের তদন্তেও একই বিষয় সামনে আসে। কমিশনের বিশেষ পরিদর্শক আমানুল্লা তাঁর রিপোর্টে সিপিএমের হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি স্পষ্ট লিখেছিলেন, সিপিএম একেবারে ভোটার তালিকা তৈরির সময় থেকেই কারচুপি শুরু করে। এমনকী কোথায় কোন পোলিং পার্টি যাবে, সেটাও ঠিক করে দেয় তারাই। আর নিজের ভোট নিজে দেওয়াটা সে সময় যে রীতিমতো লটারি পাওয়ার মতো ছিল, তা আমানুল্লা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। এই মারমার-কাটকাট বাম জমানায় পর্যন্ত আট দফায় নির্বাচনের নজির নেই। তাহলে রাজনৈতিক দলগুলির অভিযোগের ভিত্তিতে ম্যারাথন ভোটপর্বের যুক্তি কি সত্যিই খাটে? তর্কের খাতিরে না হয় কোভিড বিধি কার্যকর করা এবং বেশি সংখ্যক কেন্দ্র—এই দুই কারণকেও খাড়া করা যেতে পারে। তাই যদি হয়, তাহলে তো তামিলনাড়ুতেও একই অঙ্ক কষতে হতো। সেখানে আসন সংখ্যা ২৩৪। আর মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের নিজের উদ্ধৃতি অনুযায়ী, ‘রাজ্যটি স্পর্শকাতর’ও বটে। তাহলে তামিলনাড়ুতে এক দফায় ভোট কোন যুক্তিতে?
এবার একটা রাজনৈতিক যুক্তি দেখা যাক। দক্ষিণের এই রাজ্যে এআইএডিএমকের সঙ্গে জোট বেঁধেছে বিজেপি। যতদিন জয়ললিতা ছিলেন, বিজেপি সেখানে কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারেনি। জয়ার প্রয়াণ, দলের মধ্যে ভাঙন এবং টালমাটাল দক্ষিণী রাজনীতি বিজেপিকে খানিকটা ডিভিডেন্ড দিয়েছে। তার উপর ‘ডবল ইঞ্জিনে’র টোপ তো রয়েইছে। এটা একটা মোক্ষম অস্ত্র। ভবি ভোলে না, কিন্তু ভোটার ভুলে যায়। হাতের সামনে ত্রিপুরা বা অসমের মতো উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও। যাই হোক, সোজা কথায় এআইএডিএমকের সঙ্গে বিজেপির জোট তামিলনাড়ুতে বেশ শক্ত জমির উপর দাঁড়িয়ে। এই সমঝোতায় প্রধান দল অবশ্যই রাজ্যের শাসক দল এআইএডিএমকে। এখনও পর্যন্ত যা খবর, গেরুয়া শিবিরকে জয়ললিতার পার্টি খান পনেরো আসন দিতে চাইছে। কারণ, পিএমকে’র মতো অন্য শরিক রয়েছে। তাদেরও তো খুশি করতে হবে! মোটামুটি জোটে অশান্তির কোনও লক্ষণ এ পর্যন্ত নেই। চিন্তার বিষয় একটাই, আসন্ন নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ’র পাল্লা ভারীর দিকে। কাজেই ভোটপর্বকে বেশি দফায় ভাঙলে মুশকিল। বরং একদিনে ২৩৪ আসনের কর্মকাণ্ড চুকিয়ে ফেলাতেই অ্যাডভান্টেজ।
এবার আসা যাক কেরলে। বাম প্রভাবিত এই রাজ্যে এবারও জনমত ঝুঁকে পিনারাই বিজয়নের দিকে। মূল প্রতিপক্ষ? কংগ্রেস... যাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে গলায় গলায় ভাব। এই রাজ্যে কিন্তু বিজেপির দাঁত ফোটানোর কোনও সম্ভাবনাই নেই। পুদুচেরি হয়তো গেরুয়া শিবিরের দখলে আসবে। কিন্তু সে তো সান্ত্বনা পুরস্কার! অর্থাৎ সম্ভাবনা বা লক্ষ্য একমাবেদ্বিতীয়ম—পশ্চিমবঙ্গ। শাসক দল তাই এখানে দুর্নীতিগ্রস্ত, তোলাবাজ, মানুষের পাশে দাঁড়ায় না, আইন-শৃঙ্খলার হাল খারাপ... অভিযোগ অনেক। বিজেপির দাবি, এক-দুই দফায় ভোট করালে যা নয় তাই করবে তৃণমূল। সেই সুযোগ দেওয়া যাবে না। বারবার দরবার... নির্বাচন কমিশনে। তবলার বাঁয়া কংগ্রেস-বাম জোট (ভুল হয়ে গেল, এই জোটে তো আইএসএফ’ও আছে। সত্যিই, দারুণ আদর্শবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ সংযুক্ত মোর্চা)। সেই সব অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে ম্যারাথন সূচি ঘোষণা করে দিল নির্বাচন কমিশন। সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত—বেশি দিন ধরে ভোট হলে আর রিগিং করতে পারবে না। সেশন সাহেব, আপনি হলেও কি তাই করতেন? ১৯৫১-৫২ সালে ছিল দেশের প্রথম লোকসভা নির্বাচন। স্বাধীনতার পর ভারত সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অভিজ্ঞতা শূন্য... প্রশাসন এবং ভোটার, দুই পক্ষেরই। সেই পর্বে ভোট হয়েছিল ৬৮ দফায়, লেগেছিল মোট চার মাস। তার সঙ্গে এই বিধানসভা নির্বাচনের কি কোনও তুলনা চলে? আপনি যে ছ’বছর মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ছিলেন, সেই সময় দু’টি লোকসভা নির্বাচন আপনাকে সামলাতে হয়েছিল। সঙ্গে গুচ্ছ বিধানসভা ভোট। বাংলাতেই ভোট হয়েছিল ’৯১ ও ’৯৬ সালে। ওই জমানায় বিহার-উত্তরপ্রদেশে দলিত রাজনীতি ও গুন্ডারাজ, বাংলায় ভোট-সন্ত্রাস সত্ত্বেও আপনি খুব বেশি হলে তিন দফায় নির্বাচনের কর্মকাণ্ড গুটিয়ে ফেলেছিলেন। ১৯৯১ সালে সিপিএমের সন্ত্রাস আজও গায়ে কাঁটা দেয়। সেবার ভোটে কান্দুয়ায় কংগ্রেস কর্মীর হাতের পাঞ্জা কেটে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছিল। সেশন সাহেব, তা সত্ত্বেও কিন্তু আপনি এক দফায় ভোট শেষ করে দিয়েছিলেন। দু’টি বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন আপনি... রাজনীতি ও ভোটে দুর্বৃত্তায়নের টুঁটি চেপে ধরা, আর দ্বিতীয়ত, প্রার্থীদের যথেচ্ছ টাকা ওড়ানোয় বেড়ি পরানো। দুনিয়া জানে, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিপ্লব এনেছিলেন আপনি। কোনও রাজনৈতিক দল বলতে পারবে না, আপনি তাদের সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিলেন। তাহলে আজ বিরোধীরা কীভাবে এই অভিযোগ তোলার সাহস পাচ্ছে? তৃণমূল কংগ্রেস দাবি করছে, আট দফার গোটা বিষয়টাই আসলে বিজেপির দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের সুবিধা পাইয়ে দিতে। কীভাবে? পক্ষে যুক্তিও রয়েছে। কেরল, তামিলনাড়ু, পুদুচেরি... এই তিন রাজ্যেই এক দফায় নির্বাচন। অসমে শুধু তিন দফায়। সেই ছায়াছবিরও ‘দি এন্ড’ হয়ে যাবে ৬ এপ্রিল। আর এই তিনদিন, অর্থাৎ ২৭ মার্চ, ১ এপ্রিল ও ৬ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গে কোথায় কোথায় ভোট? পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, দুই মেদিনীপুর, হাওড়া-হুগলির একাংশ এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা। জঙ্গলমহলে গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি আশাতীত ফল করেছিল। যা তাদের এখনও যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস জুগিয়ে চলেছে। উনিশের ভোটের নিরিখে এবং দলবদলের হাওয়ায় হাওড়া-হুগলি নিয়েও গেরুয়া শিবির আশায় বুক বাঁধছে। আর রইল দক্ষিণ ২৪ পরগনা। এই জেলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শক্ত জমি। কিন্তু নির্ঘণ্ট অনুযায়ী এই একটি জেলাতেই তিন ভাগে ভোটগ্রহণ হবে। অর্থাৎ, বাকি সব রাজ্যের ভোট মিটিয়ে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা বাংলায় কোমর বেঁধে ঝাঁপাতে পারবেন। আর ততদিন ভালোভাবে শান দিয়ে নেবেন মেরুকরণের রাজনীতির অস্ত্রটিকে।
ধর্মীয় মেরুকরণ... গত তিন দশকের ভোট-রাজনীতিতে বিজেপির একমাত্র মারণ অস্ত্র। যা ভোটারকে ভারতবাসী নয়, নির্দিষ্ট কোনও ধর্মের ধারক ও বাহক বলে ভাবতে বাধ্য করায়। ভোট দিতে যাওয়ার সময় তিনি যোগ্যতার কথা বা উন্নয়নের কথা ভাবেন না, বিবেচনা করেন গায়ে সেঁটে থাকা ধর্মের স্ট্যাম্প দিয়ে। কিন্তু সেশন সাহেব... আপনি তো বলতেন, ‘হিন্দু বলতে আমি রাম বা কৃষ্ণের পূজারি বুঝি না। আমার কাছে হিন্দুত্ব বলতে কোনও মন্দির গড়া, বা মসজিদ ধ্বংস করা নয়। হিন্দুত্বর মানে সেই আদর্শ, সেই জিন, সেই রক্ত... যা আমাদের শিরায় শিরায় বয়ে যায়। আপনি পাঞ্জাবের বাসিন্দা হতে পারেন, বা তামিলনাড়ু... কেরলের বা বাংলার... ভিতটা সবার এক। মনুষ্যত্ব।’ তাই তো আপনি পেরেছিলেন... যাবতীয় বিভেদ এবং চোখরাঙানি দূরে সরিয়ে দেশবাসীকে তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগের সুযোগ দিতে। আর এখন? মুর্শিদাবাদ, মালদহ এবং উত্তর দিনাজপুরে বাংলার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলিম বাস করেন। এখানে ভোট পড়েছে ২২ এপ্রিল। অথচ, ১২ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে যাচ্ছে রমজান মাস। নির্ঘণ্ট তৈরির সময় নির্বাচন কমিশন কি এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিষয়টি মাথায় রেখেছিল?
সেশন সাহেব, আপনি হলে নিশ্চয়ই ভাবতেন। সম্প্রতি বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ক্ষমতায় এলে পরেরবার তাঁরা এক দফায় ভোট করাবেন। তাহলে এই আট দফার পিছনে কি দিলীপবাবুর দলের সত্যিই গূঢ় কোনও ভূমিকা আছে? সেশন সাহেব, আপনার জমানায় এই প্রতাপ কি কেন্দ্রের শাসক দল দেখাতে পারত?
বিজেপি তাল ঠুকছে... দারুণ ভোট হবে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও মাস খানেক আগে ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছেন—বাংলার ভোটে একটিও মাছি গলতে দেবেন না। চক্রব্যূহ সাজিয়ে ফেলেছে গেরুয়া শিবির... বাংলা দখলের লক্ষ্যে। ২ মে ভোটের ফল যাই হোক না কেন, বিজেপি কিন্তু তৃণমূলের বিরুদ্ধে আর রিগিংয়ের অভিযোগ তুলতে পারবে না! আট দফার পরও যদি সেই অভিযোগ ওঠে, তার লজ্জা এবং দায়, দু’টোই নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহকেও।