বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

পেট্রল-ডিজেল-গ্যাস এবং পরিবর্তনের ডাক
শান্তনু দত্তগুপ্ত

পরিবর্তন সব সময় ভালো হবেই, এমনটা কিন্তু নয়।
ধূর্জটিবাবু বলতেন, ‘আমাদের রামায়ণ-মহাভারতই দেখুন না। বলছে ইতিহাস, কিন্তু আসলে আজগুবি গপ্পোর ডিপো। রাবণের দশটা মাথা, হনুমান ল্যাজে আগুন দিয়ে লঙ্কা পুড়োচ্ছে, ভীমের অ্যাপিটাইট, ঘটোৎকচ, হিড়িম্বা, পুষ্পক রথ, কুম্ভকর্ণ—এগুলোর চেয়ে বেশি ননসেন্স আর কী আছে?’ আসলে বিশ্বাস বা আস্থা ব্যাপারটার বড্ড অভাব ছিল ধূর্জটিবাবুর। নিজের ধারণা, বিবেচনার বিরুদ্ধেও যে কিছু থাকতে পারে, তা মানতেই চাইতেন না। অবিশ্বাসের কম্পনেই রথের চাকা শেষে মাটিতে বসে গিয়েছিল। পরিবর্তন হয়েছিল তাঁর... ভয়াবহ।
বড্ড ঝুঁকি এই পরিবর্তনের জিগিরে। তারপরও সেই চেনা হাঁকডাক আবার শোনা যাচ্ছে বাংলায়। বেশিটাই হিন্দিতে, কিছুটা ভাঙা দুর্বোধ্য বাংলায়। কারণ, যাঁরা এই পরিবর্তনের ডাক দিচ্ছেন, তাঁদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারাই বাঙালি নন। তাঁরা আসছেন দিল্লি থেকে... আর প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, বাংলা কেমন বেহাল। সমস্যার ঝুলি উপুড় করে দিচ্ছেন নেতারা। কোনওটা সামাজিক সমস্যা, কোনওটা আর্থিক... আর পুরোটাই রাজনৈতিক। ভোটের আগে ভোটারের সামনে একটা ছবি এঁকে দেওয়া... এটাই প্রচার। ভোটব্যাঙ্ক সমৃদ্ধ করার মরিয়া চেষ্টা। শুধু বিজেপি অবশ্য এই দোষে দোষী নয়। প্রতিদ্বন্দ্বী সব দলই এই ফর্মুলায় বিশ্বাসী। কিন্তু এক্ষেত্রে ফারাক একটাই—সব নির্বাচনী-বিক্রিয়ায় অনুঘটক থাকে না। এখানে আছে... কেন্দ্রের গেরুয়া শিবিরের সরকার। ‘ডবল ইঞ্জিন’ টোপ এবং ভূরি ভূরি প্রতিশ্রুতি। প্রচার চলছে... এ রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা... কোনওটাই পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়। কর্মসংস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। বলছেন পরিযায়ী শ্রমিকের কথা। আর উঠে আসছে জীবনধারণের প্রসঙ্গ। জীবনধারণ... এ এক বিষম সত্য। এই একটি শব্দের জন্য মানুষের কতই না হিসেব-নিকেশ, ভালো-মন্দ। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম কী প্রয়োজন? যুগ যুগ ধরে চলে আসছে তিনটি শর্ত, ‘রোটি, কাপড়া, মকান’। ডিজিটাল জমানায় আরও নতুন একটি শব্দ প্রচ্ছন্নভাবে জুড়ে গিয়েছে এর সঙ্গে... জ্বালানি। বেঁচে থাকার রসদের সঙ্গে যা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে। কেন? এই একটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে, একজনের জীবনধারণের খরচ কেমন হবে। পেট্রলিয়াম জ্বালানির দাম বাড়লে তার সঙ্গে পাল্লা দেয় পরিবহণ খরচ। চাষের জমি থেকে হেঁশেল পর্যন্ত যাত্রাপথের প্রতিটা স্তরে ফসলকে কোনও না কোনও যানের উপর নির্ভর করতে হয়। ডিজেলের দাম বাড়লে লরিমালিকও সরবরাহের খরচটা বাড়িয়ে দেবে। কোন দোকানি লোকসান করে জিনিস বেচে? কেউ না। তাই সাধারণ মধ্যবিত্ত যখন বাজার থেকে ফসলটি কিনছেন, তাঁর কাছ থেকে আগের সব স্তরের খরচই কিন্তু উশুল করে নেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়লে তার প্রভাব ঘুরেফিরে চলে আসে বাজারে। বাসভাড়া থেকে মুগডাল... ফুল কানেকশন। এখন দেখা যাক, এই মুহূর্তে পেট্রল-ডিজেলের বাজারটা ঠিক কেমন। ইউপিএ জমানার সঙ্গে তুলনায় কী তফাত এসেছে ‘আত্মনির্ভর ভারতে’র?
২০১২ সালে নরেন্দ্র মোদি একটি ট্যুইট করেছিলেন। তখন তিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। লিখেছিলেন, ‘পেট্রল-ডিজেলের এই ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের ব্যর্থতার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এর জন্য গুজরাতের উপর কয়েকশো কোটি টাকার বোঝা চাপবে।’ যে সময় তিনি ট্যুইটটি করেছিলেন, দিল্লিতে তখন পেট্রলের দাম ৭৩ টাকা ৮০ পয়সা। আর ডিজেল ৪০ টাকা ৯১ পয়সা। সেই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ১১৫ মার্কিন ডলারের আশপাশে। এরপর দু’বছর ক্ষমতায় ছিল ইউপিএ। তা সত্ত্বেও পেট্রলে কেন্দ্রীয় সরকারের করবাবদ আয় ছিল লিটারে মাত্র ৯ টাকা ৪৮ পয়সা এবং ডিজেলে ৩ টাকা ৫৬ পয়সা।
পরিবর্তন এসেছে সরকারে... দেশে। নরেন্দ্র মোদি আর মুখ্যমন্ত্রী নেই। মনমোহন সিং সরকারকে উৎখাত করে তিনি প্রধানমন্ত্রী। এখন মোদিজি আর পেট্রল-ডিজেলের দাম বৃদ্ধির জন্য তাঁর নিজের সরকারকে তোপ দাগেন না (উনি তো আর অজয় মুখোপাধ্যায় নন, যে নিজের সরকারের বিরুদ্ধেই ধর্নায় বসবেন)। গত কয়েক বছর ধরে তিনি দোষ চাপাচ্ছেন আন্তর্জাতিক বাজারের উপর। আর পেট্রলে লিটার পিছু কর আদায় করছেন ৩২ টাকা ৯৮ পয়সা এবং ডিজেলে ৩১ টাকা ৮৩ পয়সা। সঙ্গে অজুহাত... মার্কেটের চাহিদা বাড়ানোর জন্য সৌদি দেশ তেলের উত্তোলন কমিয়ে দিয়েছে। তার প্রভাব পড়ছে বাজারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তো ব্যারেল পিছু অপরিশোধিত তেলের দাম ১১৫ ডলারের ধারেকাছে যায়নি! আপনাকে এখন তেল কিনতে হয় ব্যারেল পিছু ৫৯.২৫ মার্কিন ডলারে। আর আপনার অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা কর কমালেই কি রাজ্য সরকার কমাবে? তারা কমাক, তারপর আমরা দেখব। রাজ্যগুলি কিন্তু একে একে কর কমাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গেও গতকাল মধ্যরাত থেকে পেট্রল-ডিজেলে ১ টাকা করে লিটারে রাজ্য কর কমানো হয়েছে। এখন প্রতি লিটার ডিজেলে রাজ্য নেয় ১১ টাকা ৫৭ পয়সা কর। আর পেট্রলে ১৭ টাকা ৪৬ পয়সা। তারপরও অর্থমন্ত্রী এবং আপনার সরকার শুধুই দেখে চলেছে। মহামারী, লকডাউন এবং অর্থনীতির দুরবস্থার ফিকির দেখাচ্ছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের সুরাহা হয়, এমন কী করছে এনডিএ সরকার? আর দেশবাসী আশা করেই বা কী করে? গত এক দশকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের সবচেয়ে কম দাম ছিল ২০১৫-১৬’তে... ব্যারেলে ৪৬ মার্কিন ডলার। তখনও কলকাতার মানুষকে ৫৪ থেকে ৫৭ টাকা লিটারে ডিজেল কিনতে হয়েছে। আর পেট্রলের জন্য খরচ পড়েছে লিটার পিছু ৬৬ থেকে ৭৩ টাকা। এই জন্যই কি দেশের মানুষ দেশে পরিবর্তন এনেছিল?
পরিবর্তন অনেক সময় অভিশাপের মতো হয়... ধূর্জটিবাবুর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা ইমলিবাবাকে দেখে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন, ‘ছেলেবেলায় দেখা বিডন স্ট্রিটে আমার মামাবাড়ির দেয়ালে টাঙানো রবি বর্মার আঁকা একটা ছবি। দুর্বাসা মুনি অভিশাপ দিচ্ছেন শকুন্তলাকে। ঠিক এইভাবে হাত তোলা, চোখে ঠিক এই চাহনি।’ আজ মধ্যবিত্ত মনে করছে, হেঁশেলে অভিশাপ লাগেনি তো? ৮০০ টাকা গ্যাসের দাম! ভর্তুকি বলতে ১৯ টাকা। রান্না করব কী, আর খাবই বা কী? আবার কি তাহলে কাঠকয়লা বা কাঠের আগুনে ফিরে যাওয়ার সময় হল? নরেন্দ্র মোদি উজ্জ্বল ঘোষণা ছিল উজ্জ্বলা প্রকল্প নিয়ে। সেই সাধারণ মহিলারা আবার রান্নার গ্যাস কিনতে পারবেন তো? হয়তো কিনবেন, হয়তো কিনতে বাধ্য হবেন। হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। এবার গুলি চাইই চাই... যত দাম দিয়েই হোক না কেন। তাই পাবলিক গ্যাস কিনছে, বাসে চড়ছে, গাড়িতে তেল ভরছে। আর সঙ্গে ফুঁসছেও। এই জন্যই কি পরিবর্তন? এরপরও দিল্লি থেকে বিজেপির ডাকসাইটে সব নেতারা আসছেন... বলছেন ‘পরিবর্তন চাই’। কেন পরিবর্তন? কোথায় কোথায় পরিবর্তন? সবই রীতিমতো তালিকা বানিয়ে পরিবেশন করছেন তাঁরা। কিন্তু মানুষও বিচার-বিবেচনা করছে... স্বাস্থ্যে পরিবর্তন? বিজেপি আয়ুষ্মান ভারত আনলে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিমা... কিন্তু রাজ্যে এখনই তো স্বাস্থ্যসাথীতে ওই ৫ লক্ষ টাকাই পাওয়া যায়! স্কুলছুট? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যাশ্রী আছে... রয়েছে সবুজসাথী সাইকেলও। কাস্ট সার্টিফিকেট? বাড়ির দরজায় পৌঁছে দিচ্ছে প্রশাসন। মেয়ের বিয়ে? রূপশ্রী আছে। আর রইল আইন-শৃঙ্খলা... সেদিনই কথা হচ্ছিল কলকাতা পুলিসের একটি থানার ওসির সঙ্গে। রাজনীতির কোনও রং গায়ে তিনি চড়িয়ে আছেন বলে বদনাম এতটুকু নেই। তিনি পর্যন্ত বলছিলেন, ‘এখানে মেয়েদের ভয়? এই রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ... উত্তরপ্রদেশ নয়।’ কেন এমন উদাহরণ? খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, দলিতের উপর অত্যাচারের মতো অপরাধের তালিকাই এই প্রশ্নের উত্তর। আর উত্তরপ্রদেশে কোন পার্টির সরকার?—বিজেপি।
তারপরও পরিবর্তনের ডাক বাংলার আকাশে বাতাসে গুঁতোগুঁতি করছে। সোশ্যাল মাধ্যমে দাপিয়ে প্রচার চালাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলি। দেখা যাচ্ছে ছবি, অডিও, ভিডিও... কখনও গানে, কখনও মিমে। আরও কিছু মেসেজও আসছে ফোনে... ‘আপনার অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা পেতে চাইলে নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন।’ এ কোন ১৫ লক্ষ টাকা? ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে নরেন্দ্র মোদি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন? ভুলেও ক্লিক করবেন না... কিছুই আসবে না। উল্টে ফাঁকা হয়ে যাবে আপনার অ্যাকাউন্টই। তখন আর কোনও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিই কাজে লাগবে না। নেতারা আসবেন, বক্তৃতা দেবেন, ভোট নেবেন, তারপর আর ফিরেও তাকাবেন না। মানুষ কতটা সমস্যায় আছে, তা বিচার করার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে—রাজকোষ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নেওয়া। খুব বেশি কিছু দরকার নেই... জ্বালানিই যথেষ্ট। ২০২১-২২’এর বাজেট অনুযায়ী কেন্দ্র আশা করছে, পেট্রল-ডিজেলের উপর কর চাপিয়েই মোদি সরকারের আয় হবে ৩ লক্ষ ৬১ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি আমরাও না হয় একটা হিসেব কষে নিই... পাঁচ বছর আগে সংসার চালাতে আমাদের কত খরচ পড়ত? আর এখন সেই খরচ কত শতাংশ বেড়েছে? সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরে অঙ্কটা প্রায় দু’গুণ। সেই অনুপাতে সবার উপার্জন কি বেড়েছে? না বাড়েনি। কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুত দিশা কিন্তু মোদিও দেখাতে পারেননি।
খগম নামে এক তপস্বী ছিলেন। তাঁর শাপে বন্ধু সহস্রপাদ মুনি ঢোঁড়া সাপ হয়ে যান। ধূর্জটিবাবুরও পরিবর্তন এসেছিল... গায়ে চাকা চাকা দাগ, শরীর বরফের থেকেও বেশি ঠান্ডা, কথা নেই... শিসের শব্দ। অবিশ্বাস এবং ঝুঁকি... বদলে দিয়েছিল তাঁর ভাগ্য, তাঁর শরীরকে। সে এক ভয়াবহ পরিবর্তন।
পরিবর্তন কিন্তু সব সময় ভালো হয় না। 

23rd     February,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ