১২ ফেব্রুয়ারি রাজ্যসভায় এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি লোকসভায়, অর্থমন্ত্রী শ্রীমতী নির্মলা সীতারামন যে বাজেট ভাষণ দিয়েছিলেন সেটি ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপ্রবণ। লোকসভায় তিনি আক্রমণাত্মক না-হয়ে এক ডজন বার আমার আগের দিনের বক্তব্যের উল্লেখ করেন, যেটা আমার কাছে সংসদীয় বিতর্কের চাপানউতোর বলে মনে হয়েছে।
সংখ্যার স্বাধীনতায় আমার আপত্তি রয়েছে। বাজেটের পুরোটাই হল সংখ্যা: প্রতিটি সংখ্যা অবশ্যই যুক্তিপূর্ণ হতে হবে। মোট আয় বা সংগ্রহ, মোট ব্যয় বা খরচ এবং ঋণগ্রহণের পরিমাণ (= রাজকোষ ঘাটতি)—এই তিনটি সংখ্যা যে-কোনও বাজেটের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাজেট হল রাজস্ব এবং ব্যয়ের একটি বার্ষিক বিবরণ। স্রেফ ওই সংখ্যা ‘তিনটি’ যদি ভুল দেওয়া হয়, তবে বাজেট নামক জিনিসটির গুরুত্ব কিছু বাজে কাগজের স্তূপের অধিক নয়।
তিনটি প্রধান সংখ্যা
গত ১ ফেব্রুয়ারি যখন বাজেট পেশ করা হল
তখন প্রধান সংখ্যা তিনটির (থ্রি কি নাম্বারস) বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে আমি প্রশ্ন করেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে সংখ্যা তিনটি ‘সন্দেহজন’, অর্থাৎ সংখ্যাগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আমার সমালোচনার ভিত্তি ছিল মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) বৃদ্ধি সংক্রান্ত বাস্তব তথ্যাদি। টানা সাতটি ত্রৈমাসিকে (২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের চারটি ত্রৈমাসিক এবং ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের তিনটি ত্রৈমাসিক) জিডিপির বৃদ্ধি মন্থর হয়ে গিয়েছিল এবং ২০১৯-২০ সালের চতুর্থ ত্রৈমাসিকে আরও নেমে গিয়েছিল। আমি যুক্তি দিয়ে বলেছিলাম, ২০২০-২১ সালের প্রজেকশানটা ছিল আশাব্যঞ্জক এবং তার মধ্যে বেশ উচ্চকাঙ্ক্ষাও ছিল। অর্থমন্ত্রী রেগেমেগে আমার সমালোচনা খারিজ করে দিলেন।
এক মাস বাদে, মহামারী ভারতব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল এবং ২০২০-২১-এর যাত্রা শুরু হল একটি অশুভ ইঙ্গিত নিয়ে। অর্থনীতির মন্থর গতি মন্দায় রূপান্তরিত হল। অর্থমন্ত্রীর তরফে প্রজেক্ট করা সংখ্যাগুলির আর গুরুত্ব রইল না। মহামারী না এলেও তিনি ভুল প্রমাণিত হতে পারতেন। আর মহামারীর কারণে তিনি নিজেকে ভয়ানক রকম ভুল প্রমাণ করলেন। শুধু দেখুন আমরা কোথা থেকে শুরু করেছিলাম (বাজেট এস্টিমেটস বা বাজেট বরাদ্দ) এবং ২০২১-এর ৩১ মার্চ কোথায় গিয়ে শেষ করব (রিভাইজড এস্টিমেটস বা সংশোধিত বরাদ্দ):
(সব অঙ্ক কোটি টাকায়)
একই হীন কাহিনির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ২০২১-২২ সালের বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রেও, যার জন্য প্রশ্ন ওঠারও অবকাশ রয়েছে। আমি সংসদে কিছু প্রশ্ন রেখেছিলাম, কিন্তু কোনও উত্তর পাইনি। তার কিছু আমি এখানে দিলাম।
প্রশ্ন আছে, কিন্তু কোনও উত্তর নেই
১. পূর্ববর্তী বছরের হিসেবে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে
কর রাজস্ব (ট্যাক্স রেভিনিউ) ১ শতাংশ কমে গিয়েছিল। তাহলে ২০২১-২২ সালে কর রাজস্ব
(নিট) বেড়ে ১৪.৯ শতাংশ হবে বলে যে আশা দেখানো হয়েছে তার ভিত্তিটা কী? ২০২১-২২ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে মন্দা কেটে যাবে ধরে
নেওয়া গেল। প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলেও কি জিডিপির পর্যাপ্ত বৃদ্ধি হবে, যার দরুন কর রাজস্বের ১৪.৯ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটবে?
২. পৃর্ববর্তী বছরে বিলগ্নিকরণ থেকে সংগ্রহ বা আয়ের ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১,৭৮,০০০ কোটি টাকা। তাহলে ২০২১-২২ সালের এস্টিমেট ১,৭৫,০০০ কোটি টাকা ধরার যুক্তি কী?
৩. এটা কি সত্যি যে ২০২০-২১ সালের মোট ব্যয়ের সংশোধিত হিসেবের (রিভাইজড এস্টিমেটস) ভিতর এফসিআইকে মেটানো ২,৬৫,০৯৫
কোটি টাকাও ধরা ছিল—যে টাকাটা ভারত সরকারের হয়ে এফসিআই ঋণ করেছিল? যদি সেটাই হয়ে
থাকে তবে কীভাবে এটাকে অর্থনীতিকে চাঙ্গা
করার পক্ষে সহায়ক ‘সরকারি ব্যয়’ বলা যাবে?
৪. অনুরূপভাবে, ২০২১-২২ সালের মোট ব্যয়ের বাজেট বরাদ্দের (বাজেট এস্টিমেট) ভিতরে
কি এফসিআইকে মেটানো মোটা অঙ্কের অর্থটাও
ধরা আছে?
৫. ‘প্রতিরক্ষা’ খাতে সামান্য ৩,২৬৬ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং স্বাস্থ্য খাতে
বরাদ্দ কমানো হয়েছে ৭,৮৪৩ কোটি টাকা (বাজেট এক নজরের পৃষ্টা ১০)। অর্থমন্ত্রী কি
এইভাবে ২০২১-২২ সালের মোট ব্যয়কে চূড়ান্তরূপে ‘আন্ডার-এস্টিমেটেড’ করে
ফেললেন না? ‘প্রতিরক্ষা’ এবং ‘স্বাস্থ্য’-এর
মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টি খাতের জন্য
আরও বেশি অর্থ বিশেষভাবে বরাদ্দ করার দরকার ছিল না কি?
৬. শিক্ষা, শক্তি (এনার্জি), একশো দিনের কাজের প্রকল্প এবং পুষ্টির মতো কিছু ডিপার্টমেন্ট—অর্থ বরাদ্দের প্রশ্নে এই বাজেটে অবহেলিত (আন্ডার-প্রোভাইডেড) রয়ে গেল না কি?
৭. যদি মোট রাজস্বকে অতিরঞ্জিত করে
(ওভার-এস্টিমেটেড) এবং মোট ব্যয়কে চূড়ান্তভাবে কমিয়ে (গ্রসলি আন্ডার-এস্টিমেটেড) দেখানো
হয়ে থাকে, তবে ২০২১-২২ সালের জন্য
ঋণ গ্রহণের পরিমাণটা (১৫,০৬,৮১২ কোটি
টাকা) বিপথগামী করে দেওয়ার মতো এবং বিপজ্জনক এক আন্ডার-এস্টিমেট নয় কি?
৮. রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং অন্য বিশেষজ্ঞদের এস্টিমেটের বিরুদ্ধাচারণ করে, অর্থমন্ত্রী কি প্রকারান্তরে বলছেন যে ২০২১-২২ সালে গড় মুদ্রাস্ফীতি হবে মাত্র ৩.০ শতাংশ? যদি সেটাই তাঁর বক্তব্য হয়ে থাকে তবে তাঁর এমন অনুমানের ভিত্তিটা কী?
৯. অর্থমন্ত্রী কেন এমন একটি সহজ পথ (গ্লাইড পাথ) বেছে নিলেন, যেটি ২০২৫-২৬ সালে রাজকোষ ঘাটতি (ফিসকাল ডেফিসিট) ৪.৫ শতাংশে পৌঁছলে রুদ্ধ হয়ে যাবে? রাজকোষ ঘাটতি ৩ শতাংশ বা তার নীচে নামিয়ে আনার লক্ষ্য
থেকে কি সরকার সরে গেল?
এর মানে এটাই দাঁড়াচ্ছে না কি যে ফিসকাল রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট (এফআরবিএম) অ্যাক্ট শুধু আপাতত মুলতুবি রাখা হল না, তাকে বিশ বাঁও জলে সমাধিস্থই করা হল?
১০. অর্থবর্ষ ২০২১-২২-এর অনুমিত জিডিপির (স্থির মূল্যে) নিরিখে, সরকার কি ২০২৪-২৫ সালের ভিতরে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি হয়ে ওঠার লক্ষ্য থেকে সরে এল?
২০১৩-১৪ সালের পর ইউপিএ যখন ক্ষমতা থেকে সরে গেল, তখন স্থির মূল্যে ১০৫ লক্ষ কোটি টাকার জিডিপি রেখে এসেছিল। ২০০৩-০৪
সালে ইউপিএ ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় জিডিপির
যে অঙ্ক ছিল, ছেড়ে যাওয়ার সময়ের অঙ্কটা
ছিল তার থেকে তিনগুণ বেশি। তার পর
থেকে জিডিপি বৃদ্ধির গতি ভয়ানক মন্থর হয়ে
গিয়েছে। জিডিপি বেড়ে হয়েছে ২০১৭-১৮ সালে ১৩১ লক্ষ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ সালে ১৩৯
লক্ষ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ সালে ১৪৫ লক্ষ
কোটি টাকা। আর ২০২০-২১ সালে সেটা কমে
গিয়ে ১৩০ লক্ষ কোটি টাকা হতে চলেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। অর্থাৎ অঙ্কটা ২০১৭-
১৮ সালের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। অযোগ্য
পরিচালকের হাতে পড়ে অর্থনীতি তিন বছর
পিছনে ফিরে গেল!
বাজেটের সংখ্যাগুলি সত্যিই এস্টিমেটস
বা অনুমান। যুক্তিনির্ভর অনুমানের উপর ভিত্তি
করে তৈরি এস্টিমেটও ভুল হতে পারে।
তা সত্ত্বেও আমি বলব যে, সংখ্যার কারিকুরি-
সহ তথাকথিত ‘বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাজেট’ পেশ
হল কুপরামর্শে গৃহীত একটা পদক্ষেপ—এই অন্যায় ক্ষমার অযোগ্য। এর চড়া মাশুল কেবল মানুষকেই গুনতে হবে।
লেখক সংসদ সদস্য ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত