বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ
 

জনগণের দমবন্ধ হলেও জাগে না যাঁদের অন্তরাত্মা 
তন্ময় মল্লিক

একটা প্রশ্ন অনেকের মাথার মধ্যে ঘুরছে, ‘দমবন্ধ’ হতে বসা তৃণমূল নেতারা ‘অক্সিজেন’-এর জন্য বিজেপিতে ছুটছেন কেন? বিজেপি ছাড়াও তো কংগ্রেস, সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক, এসইউসি সহ অনেক দল রয়েছে। কিন্তু সেদিকে কেউ পা বাড়াচ্ছেন না। শ্বাসকষ্টে ভোগা সকল নেতার অভিমুখ এবং বয়ান এক, ‘মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। কিন্তু তৃণমূলে দমবন্ধ করা অবস্থা। তাই...’। একেবারে বাঁধা ছক। প্রথমে বেসুরো, তারপর পদত্যাগ এবং শেষে দলত্যাগ। কিছুদিন অপেক্ষার পর ঘটা করে যোগদান। বিজেপিতে অক্সিজেনের অভাব নেই। রয়েছে পিএম কেয়ার্স ফান্ড। তাই ‘অক্সিজেনে’র জোগানও অঢেল। যত লাগে ‘অক্সিজেন’ দেবে ‘গৌরী সেন’।
করোনা আবহে অক্সিজেনের চাহিদা তুঙ্গে 
উঠেছিল। করোনায় আক্রান্ত রোগীর অবস্থা একটু জটিল হলেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাচ্ছিল। শ্বাসকষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র অক্সিজেন। ঢালাও অক্সিজেন। তাই অক্সিজেনের চাহিদাও উঠেছিল তুঙ্গে। তার জন্য দু’গুণ, তিনগুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছিল অক্সিজেন সিলিন্ডার।
বঙ্গে নির্বাচন এগিয়ে আসতেই অনেক তৃণমূল নেতার ‘শ্বাসকষ্ট’ বেড়ে গিয়েছে। তাঁদের নাকি ‘দমবন্ধ’ অবস্থা! তা থেকে মুক্তি পেতে দরকার অক্সিজেন। কোনও উপসর্গ নেই, তবুও দীনেশ ত্রিবেদীর দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। অবস্থা এতটাই নাকি সঙ্কটজনক যে, তিনি দল ছাড়তে বাধ্য হলেন।
বিশিষ্টজনরা করোনায় আক্রান্ত হলেই ট্যুইট করে সংবাদ মাধ্যমকে তাঁদের অসুস্থতার কথা জানাচ্ছিলেন। সকলকে সতর্ক করাই ছিল উদ্দেশ্য। দীনেশবাবুও বিশিষ্টজন। তাঁর ‘দমবন্ধ’ হওয়ার কথাও বেশি সংখ্যক মানুষের জানা দরকার! সেই কারণেই তিনি রাজ্যসভার মঞ্চকে কাজে লাগালেন এবং অবশ্যই নজিরবিহীনভাবে। ভোটে জেতার ক্ষমতা না থাকলেও প্রাক্তন রেলমন্ত্রী বলে কথা! নীরবে তৃণমূল থেকে সরে দাঁড়ানোটা তাঁর জন্য বড়ই অসম্মানের। তাই  তিনি দেশের সর্বোচ্চ কক্ষকে পদ ছাড়ার মঞ্চ হিসেবে বেছে নিলেন। অবশ্য খাজনার চেয়ে বাজনার আওয়াজ সব সময় বেশিই হয়!
তৃণমূলছুট কিছু নেতার ‘দমবন্ধ’ হওয়ার কারণটা এখন মানুষের কাছে জলের মতো পরিষ্কার। কিন্তু দীনেশবাবুর? তাঁর তো দমবন্ধ হওয়ার কথা ছিল না। তাই অনেকেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। তবে, সবচেয়ে বেশি বিস্ময় জেগেছে তাঁর ‘মানুষের জন্য কাজ’ করার ইচ্ছাপ্রকাশে। কারণ দীনেশবাবুকে কাজ করার সুযোগ বারাকপুরের মানুষ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কাজের বহর দেখে বারাকপুরের ভোটাররা আর তাঁকে সেই সুযোগ দিতে রাজি হননি। নাচতে না জানলে উঠোনকে দোষ দেওয়ার অভ্যেস মানুষের বরাবরের। নিজের অক্ষমতা, দুর্বলতা ঢাকার জন্য অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপালেও মানুষ সব বুঝতে পারে। মুখে কিছু বলে না, কিন্তু মুচকি হাসে।
চায়ের দোকানের আড্ডায় যখন দীনেশবাবুর শ্বাসকষ্টের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা চলছে তখন তিনিই জানিয়ে দিলেন, নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের সঙ্গে তাঁর বহু বছরের সম্পর্ক। বিজেপিতে গেলে ভালো থাকবেন বোঝাতে গিয়ে নিজেই ফাঁস করে দিলেন ‘দমবন্ধে’র আসল কারণ। দীনেশজি গুজরাতের মানুষ। তাই প্রধানমন্ত্রীর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দেশ পরিচালনায় স্বজাতি মোদিজির ‘বলিষ্ঠ’ নেতৃত্বে তিনি মুগ্ধ হতেই পারেন। বিজেপিতেও যেতে পারেন। বিজেপির দরজা তো হাট করে খোলা। সেখানে এন্ট্রি নেওয়ার জন্য এত গৌরচন্দ্রিকার কি খুব দরকার ছিল? নাকি ‘চিচিং ফাঁক’ এর মতো বিজেপির দরজা খোলার জন্য ‘তৃণমূলে দমবন্ধ পরিস্থিতি’ বলাটা বাধ্যতামূলক?
ইদানীং বেশিরভাগ নেতা তো মল-মূত্র ছাড়া আর বিশেষ কিছু ত্যাগ করেন না। তাই বিষয়টি যখন পদত্যাগ তখন একটু জাঁকজমক না হলে হয়? তাই দীনেশবাবু তাঁর এই পর্বকে গৌরবান্বিত করার জন্য ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনলেন একটি অসাধারণ শব্দ, ‘অন্তরাত্মার ডাক’। তিনি জানিয়েছেন, ‘যেভাবে বাংলায় কাজ হচ্ছে, তা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। তাই এতদিনে তিনি অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দিয়েছেন।’ সাব্বাস দীনেশজি, সাব্বাস! মানতেই হবে, বাংলার চেয়ে গুজরাত অনেক এগিয়ে! আপনি আপনার ‘জাত’ চিনিয়েছেন।
‘অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দেওয়ার’ কথা বলে দীনেশজি প্রায় দেড় যুগ আগের একটি স্মরণীয় ঘটনা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ২০০৪ সালে সোনিয়া গান্ধী ‘অন্তরাত্মা’র কথা বলেই প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়েছিলেন। ‘বিদেশিনী’ প্রসঙ্গ ওঠায় সোনিয়াজি বলেছিলেন, ‘গত ছ’বছরে রাজনীতিতে থাকার মধ্য দিয়ে আমার কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার যে প্রধানমন্ত্রীর পদ আমার লক্ষ্য নয়, আমি অনেকবার সে কথাটি বলেছিও। ক্ষমতা আমাকে কখনও আকৃষ্ট করে না বা সেটি আমার লক্ষ্যও নয়। আজ আমি অন্তরাত্মার ডাক শুনতে পেয়েছি এবং বিনয়ের সঙ্গে এই পদ নিতে অস্বীকার করছি। আমি আপনাদের অনুরোধ করছি, আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিন, এটা আমার অন্তরাত্মার ডাক, আমার চেতনার প্রকাশ। আমার সব সময় উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত মজবুত করা এবং দেশের গরিবদের সুরক্ষা দেওয়া।’
সোনিয়াজি একথা বলে মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারের দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সেই ত্যাগ সমগ্র ভারতবাসীর হৃদয় জয় করেছিল। এক লহমায় মুছে গিয়েছিল তাঁর ‘বিদেশিনী’ তকমা। ভারতবাসী সেদিন নতুন করে উপলব্ধি করেছিলেন, কেন সোনিয়াজি বলেছিলেন, ‘Although born in a foreign land, I choose India as my country and would remain an indian till my last breath. India is my motherland, dearer to me than my own life.’
সোনিয়া গান্ধী বিদেশে জন্মালেও তিনি ভারতবর্ষকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। তাই ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা ও গরিবদের সুরক্ষা দেওয়ার আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করাই তাঁর লক্ষ্য। তার জন্য তিনি অনায়াসেই ছেড়ে দিতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি। সেদিন শুধু ভারতবর্ষ নয়, গোটা বিশ্ব তাঁকে কুর্নিশ জানিয়েছিল।
দীনেশজি, তার ঠিক ১৭ বছরের মাথায় আপনিও ‘অন্তরাত্মার ডাকের’ কথা বললেন। পদ ছাড়লেনও। কিন্তু, তাতে রাজ্যের মানুষ আপনাকে কী বলছে জানেন? ‘গাজরটি’ কী? 
যাঁরা নিজেদের ‘দমবন্ধ’ হওয়ার কথা বলে বিজেপিতে যাচ্ছেন, তাঁরা কি বুঝতে পারছেন না, গোটা দেশের মানুষের দমবন্ধ হয়ে আসছে। করোনায় বিধ্বস্ত দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। এই অবস্থায় কেন্দ্রের সরকার প্রতিদিন পেট্রল, ডিজেলের দাম বাড়িয়ে চলেছে। ছ’মাসের মধ্যে পেট্রলের লিটার ৭২ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা। ডিজেল সেঞ্চুরির দোরগোড়ায়। দু’মাসে গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় ২০০ টাকা। এভাবে চলতে থাকলে হেঁশেলে আর গ্যাস লাগবে না, এমনিতেই আগুন জ্বলবে।
নয়া কৃষি আইনে মজুতদারদের পোয়া বারো। নিয়ন্ত্রণের বালাই নেই। তাই সর্ষের তেল, ডাল সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম একেবারে আগুন। এক বছর আগে ৮০০ টাকা কেজির পোস্ত এখন ১৬০০ টাকা। মূল্যবৃদ্ধি কাকে বলে, মানুষ হাড়ে হাড়ে বুঝছে। পেটে ভাত না থাকলে মানুষ শ্বাসপ্রশ্বাস নেবে কী করে? তাই নেতাদের নয়, জনগণের ‘দমবন্ধ’ হওয়ার অবস্থা। সেদিক থেকে নজর ঘোরাতেই কি একযোগে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘দমবন্ধ’ হওয়ার অভিযোগ? 
কাচের ঘরে বাস করে ঢিল ছুড়ে নিজেকে বাঁচানোর কৌশল বহু পুরনো। মানুষ এখন সব কিছুই অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করেন। কারণ অভিজ্ঞতাই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। সেই অভিজ্ঞতার আলোয় মানুষ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কাজের বিচার করেন। একদিকে বিজেপি সরকারের ক্রমবর্ধমান সেস ও মূল্যবৃদ্ধির চাপ, অন্যদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আবাস যোজনা, বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, কৃষক বন্ধু, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী প্রকল্প। বেনিফিশিয়ারির সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, যা সাধারণ মানুষকে টিকে থাকার লড়াইয়ে শক্তি জোগাচ্ছে। বিনা পয়সায় রেশনের পাশাপাশি চালু করেছেন ‘মা’ প্রকল্প। পাঁচ টাকায় ডিম ভাত। হতে পারে ভোটের কথা মাথায় রেখে চালু করা হয়েছে এই প্রকল্প। তবুও তো উনুন জ্বালতে অক্ষম মানুষগুলো ক’টা দিন পেটভরে ভাত খেতে পাচ্ছেন। সেটাই বা কম কীসের? 
তৃণমূল ‘অক্সিজেন-বার’ খুললেও ‘শ্বাসকষ্টে’ ভোগা নেতাদের কিছু঩তেই ধরে রাখতে পারত না। কারণ ‘দমবন্ধ’টা অজুহাতমাত্র। সত্যিটা হল, বিজেপির ক্ষমতার আকাশে ডানা মেলার হাতছানি। তাই আকাশের দিকে নয়, নজরটা থাক মাটির পানে। সেখানে লড়াইটা টিকে থাকার। মানুষের সেই চোয়ালচাপা লড়াইয়ে মা, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথীই বেঁচে থাকার রসদ। মূল্যবৃদ্ধির চাপে ‘দমবন্ধ’ হতে বসা গরিবগুর্বোদের জীবনে তা এক বুক ‘অক্সিজেন’।

20th     February,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ