যে যেমন ভাবে অর্থাৎ চিন্তা করে, সে তেমনই দেখে ও বোঝে। প্রতিটি মানুষই তার নিজের নিজের জগতে (ধারণার জগতে) বাস করে, তাই তোমার জগৎ আমার জগৎ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘Ism’ বা ‘বাদ’-তথা অভিমতগুলো যেন এক-একটা চশমা বা কাঁচের পরকোলা,—নীল, লাল, সবুজ, হল্দে—নানান্ রকমের। তুমি যদি নীল-চশমা দিয়ে দেখ তো দুনিয়ার সকল জিনিসই তোমার কাছে নীল ব’লে মনে হবে। লাল চশমা দিয়ে দেখ্লে দেখ্বে সবকিছু লাল। অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, দ্বৈতবাদ, শাক্ত্যাদ্বৈতবাদ অথবা জড়বাদ, মায়াবাদ, ব্রহ্মবাদ ও পাশ্চাত্যের realism, idealism, materialism, monism, pantheism, parallelism, phenomenalism, absolutism এই সমস্তই মানুষের মনের ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা বা ধারণা, আর এইগুলোই মতবাদ হ’য়ে দাঁড়ায়। যে যেমনভাবে জগৎ ও ঈশ্বরকে বুঝেছে, সে তেমনিভাবে তাদের বর্ণনা করে। তাই বস্তু আসলে একটা হলেও বর্ণনায় ভিন্ন-ভিন্ন মনে হয়। ‘Ism’ বা ‘বাদ’ বা মতবাদ কোনটারই পারমার্থিক-সত্তা নেই, তারা এক-একটি মানুষের নিজস্ব মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি-ছাড়া অন্য-কিছু নয়’।
‘শ্রীশ্রীঠাকুর (শ্রীরামকৃষ্ণ) সে অন্ধদের হাতী দেখার গল্পটা বলেছেন—তা’ জানতো? যে ল্যাজে হাত দিয়েছিল সে বল্লো হাতী সাপের বা দড়ির মতো। যে দিয়েছিল পায়ে হাত, সে বল্লো-হাতী গাছের গুঁড়ির মতো। যে হাত দিয়েছিল কাণে, সে বল্লো-হাতী কুলোর মতো। আসলে হাতী সাপ নয়, দড়ি নয়, গাছের গুঁড়ি বা কুলোও নয়, হাতী হাত-পা-নাক-মুখ-চোখওয়ালা একটি জন্তুবিশেষ। পরমবস্তু ভগবানকে সেই রকম ইজিমের (দৃষ্টিভঙ্গির) ভিতর দিয়ে বিভিন্ন মনীষী বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন, আসলে কিন্তু তিনি অখণ্ড ও একই। তাই সত্যকারভাবে যিনি ভগবানকে দেখেছেন, তিনিই তাঁর যথার্থস্বরূপ বুঝ্তে ও বলতে পারেন, আর যারা কেবল কল্পনা করে, তারা নানান্ রকম কথা বলে, অথচ নানার কোনটাই সত্য নয়, সত্য যা—তা’ উপলব্ধির বস্তু, চাক্ষুষ-প্রত্যক্ষের-জিনিস। তাই সত্যকারের শান্তি ও মুক্তিকামী যাঁরা—তাঁরা দুনিয়ায় আসল কারণকে খুঁজে বার করতে চেষ্টা করেন। এই চেষ্টার নামই সাধনা। সাধনায় সিদ্ধির অর্থ হ’ল সৃষ্টির মূলে যে সত্য ও শাশ্বত বস্তু আছে তাকে ঠিকঠিকভাবে খুঁজে বার করা। বলতে বা বর্ণনা করতে না পারলেও সত্যদ্রষ্টা পুরুষ সত্যকে জানেন ও বোঝেন। সত্যের উপলব্ধিই মনুষ্য-জীবনের চরমলক্ষ্য। সত্য-ছাড়া অন্য যা-কিছু, সমস্তই সত্যস্বরূপ লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় বা পথমাত্র। ‘Ism’ বা ‘মতবাদ’-গুলো তাই পথেরই সামিল’। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তখন একটু চঞ্চল হয়েছে ব’লে মনে হ’ল। স্বামীজী মহারাজ তা’ লক্ষ্য করেছেন। তিনি একজনের দিকে তাকিয়ে বল্লেন: ‘হ্যাঁ, ‘শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠত্যগ্রে, আর নীরসঃ তরুবরঃ পুরত ভাতি’—এই দু’রকম কথা। জিনিষও দু’রকমঃ একটা নীরস আর একটা সরস। আমার কথাগুলো তোমাদের কাছে একটু শুক্নো লাগ্ছে,—ক্যামন?’—এই ব’লে তিনি উচ্চহাস্য ক’রে উঠ্লেন। আমাদের মধ্যেও একটা হাসির রোল উঠ্লো। স্বামীজী মহারাজের অনুমান যে ঠিক তা লক্ষ্য করতেই বুঝ্লাম, কারণ আমাদের মধ্যে সে’দিন দু’তিনজন আগন্তুক নূতন ভদ্রলোক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে থেকে একজন সংযমের পরাকাষ্ঠা রক্ষা করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও দু’একবার হাই না তুলে পারেন নি’।
স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের ‘মন ও মানুষ’ (৩য় ভাগ) থেকে