জাগ্রৎ-অবস্থায় মানুষ নিজেকে পৃথক্ ব্যক্তি-সত্তা বলে ভাবে। তার আত্মসচেতনতা লক্ষ্মণীয়—সে জানে সে কোথায় আছে, সে কী করে এবং তার জন্য বলে—‘আমি পুরুষ’, ‘আমি ফর্সা’, ‘আমি কালো’, ‘আমি লম্বা’ বা ‘আমি বেঁটে’, ‘আমি অমুক বংশজাত’, ‘আমি অমুক দেশীয়’ প্রভৃতি। সে তার বর্তমান অবস্থাটি মাত্র জানে। তার এই ‘আমিত্ব’ই হল অহংকার। জাগ্রৎ অবস্থায় মানুষ বিশেষভাবে অহংকারে বদ্ধ থাকে। কিন্তু এই অহংকার মানুষের আসল স্বরূপ নয়। এটি হল শরীর মনের সঙ্গে অভেদ কল্পিত আসল মানুষ। অহংকারবশতই মানুষ যারই সংস্পর্শে আসে তার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম ভাবে।
তাহলে আসল মানুষটি কে? দেহবোধযুক্ত আসল মানুষটি দেহের জ্ঞাতা, নিজে দেহ নয়। আমরা যেমন আমাদের চারিপাশের জগৎ সম্বন্ধে অবহিত, তেমনি আমাদের শরীর-মনের অবস্থা সম্বন্ধেও অবহিত। দেহ-মনের জ্ঞাতা হওয়ায় আমরা দেহ-মনের অতীত সত্তা। আমরা মূলতঃ জ্ঞাতা। জ্ঞাতার মধ্যে চৈতন্য বিদ্যমান। চৈতন্যই তার আসল সারবস্তু। আলো নিজেকে জানে না, কোন বস্তুকেই জানে না; কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরস্থ আধ্যাত্মিক জ্যোতি নিজেকে জানে এবং সমস্ত কিছুকেই জানে। আধ্যাত্মিক জ্যোতির সঙ্গে পার্থিব আলোর মধ্যে মূলগত এই প্রভেদ বর্তমান। ঐ জ্যোতি সর্বদাই আমাদের মধ্যে আছে আর ঐটিই হল আমাদের সত্তার সারবস্তু। মন বিষয়ীভূত হয় বলে মন স্বপ্রকাশক নয়। যা কিছু বিষয়ীভূত হয় তার নিজস্ব কোন আলো নাই। মহান্ দার্শনিক এবং মনস্তত্ত্ববিদ্ পতঞ্জলি একথা উল্লেখ করেছেন। অনেক পাশ্চাত্য দার্শনিকের মতে চৈতন্যের অধিষ্ঠান মনে। কিন্তু মানসিক অবস্থা-সকল নিজেদের সম্বন্ধে সচেতন নয়। মনের একজন জ্ঞাতা আছে। আত্মাই সেই জ্ঞাতা, আত্মাই আসল মানুষ। বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বভাব আত্মা সদা জ্যোতির্ময় এবং পরিণাম রহিত। পরিণামের জ্ঞাতা পরিবর্তিত হন না। পরিণামগুলিই প্রমাণ করে একজন অপরিণামী জ্ঞাতা আছেন। আত্মা সেই জ্ঞাতাঃ অপরিণামী, শুদ্ধ, মুক্ত, অমৃতস্বরূপ, ক্ষয়-বৃদ্ধির অতীত পূর্ণ পরম সত্তা। এই পূর্ণতা আমাদের মধ্যে সবসময়েই আছে। মনের গুণে সেই সারবস্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য লাভ করে, ‘অহং’-বোধ-বিশিষ্ট হয়, যার জন্য আমরা যা কিছু বুঝি এই ‘অহং’-এর মধ্য দিয়ে তা বুঝি। এই ‘অহং’- বুদ্ধি ছাড়া আমরা আমাদের বুঝতে পারি না, যদিও ‘অহং’-বুদ্ধিটি আসল আমি নই। আসল আমি অহং-বোধের অতীত। সদা প্রোজ্জ্বল সারবস্তু মনের গুণে অহং-রূপে প্রকাশিত হয়। এই ভাবে আসল মানুষের দেহাত্মবুদ্ধি আসে। জাগ্রৎ-অবস্থায় আমরা দ্বিবিধ ঘটনা সম্বন্ধে অবহিত থাকি—একদিকে বাহ্যজগৎ দেখি অন্যদিকে আন্তর-রহস্য সম্বন্ধে অবহিত হই। কিন্তু আমরা সমগ্র মনটি দেখতে পাই না, তার উপরের অংশটুকু দেখি। কখনও সুখ অনুভব করি, কখনও ভয় পাই, কখনও আশার আলো দেখি কখনও বা অসুখী হই। কিন্তু আমাদের মধ্যে নানান প্রবণতা, বাসনা, স্মৃতি, সংস্কার থেকেই যায়। অহংচেতনার কাছে তার অংশমাত্র প্রকাশিত হয়। মনের এই অংশটিকে সাধারণতঃ “চেতন মন” বলা হয়।