ঈশ্বরের স্বরূপ বোঝাতে ঠিক সেই রকম আমরা বলি “তিনি চৈতন্য-স্বরূপ; সচ্চিদানন্দ-স্বরূপ”—কত কি গালভরা শব্দ। যদি কেউ প্রশ্ন করে ‘সচ্চিদানন্দ বলতে কি বোঝ?’ তখন বড় জোর বলতে পারি ‘সৎ-চিৎ-আনন্দ’; কিন্তু তখনও যদি কেউ প্রশ্ন করেন ‘সৎ-চিৎ-আনন্দ মানেটা কি?’ তখন আর এগোনো যায় না। শ্রুতি বলেছেন ‘তিনি বাক্য-মনের অগোচর’। সুতরাং এই শব্দগুলি তাঁকে প্রকাশ করতে পারে—এ-রকম প্রগল্ভতা শ্রুতিও সহ্য করবেন না। বাক্যমনের অগোচর যিনি, তাঁকে যে নামই দিই, তাতে কি তাঁকে প্রকাশ করা যায়? যায় না। এই কথাটাই আমরা কিছুতেই বুঝতে পারি না; আর যত বুঝতে পারি না, তত বেশী তর্ক বিচার করি। হয়তো বললাম, “সৎ মানে চিরস্থায়ী কোনও জিনিস কি আমরা দেখেছি? দেখিনি। যা আমরা কখনও দেখিনি, তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে কি ক’রে আমাদের ধারণা হবে?” দার্শনিকরা বলেন, “সৎ মানে কি?—না, তিনি অসৎ নন। অসৎ মানে কি?—না, অনস্তি, সত্তাশূন্য। চিৎ মানে কি?—না, তিনি অপ্রকাশ নন। আনন্দ মানে কি?—না, তিনি দুঃখরূপ নন।” শাস্ত্রও এই রকম ক’রে বলেছেন: অস্থূলম্, অনণু, অহ্রস্বম্, অদীর্ঘম, অচ্ছায়ম্ ইত্যাদি। কিন্তু এর দ্বারা তিনি কি, তা কি বলা হ’ল? ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য যখন বোঝাচ্ছেন, ব্রহ্ম বস্তুটি কি, তখন এই রকম হেঁয়ালির মধ্য দিয়ে বোঝাচ্ছিলেন: তিনি দূরে থেকেও কাছে; তাঁর গতি আছে, আবার নেই। তখন একজন ঋষি বললেন, “এই রকম হেঁয়ালির মধ্যে দিয়ে বললে চলবে না। এটা একটা ‘গরু’, এটা একটা ‘ঘোড়া’ এই ভাবে বললে যেমন বস্তুকে স্পষ্ট বোঝা যায়; সেইভাবে বোঝাতে হবে।” তখন যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন, “ন দৃষ্টের্দ্রষ্টারং পশ্যের্নশ্রুতেঃ শ্রোতারং শৃণুয়াঃ”—দৃষ্টির যিনি দ্রষ্টা তাঁকে তুমি দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে জানতে চেও না; শ্রুতির যিনি শ্রোতা, তাঁকে শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়ে জানতে চেও না; সেই রকম মনের পিছনে যিনি মন্তা, তাঁকে মনের সাহায্যে জানতে চেও না। তা হ’লে আমরা সেই বস্তুকে জানব কি ক’রে? অথচ তাঁকে না জেনে ঝুড়ি ঝুড়ি গ্রন্থ লিখছি তাঁকে নিয়ে। বিদ্যাসাগর-মশাই মহাপণ্ডিত হয়েও ভগবান সম্বন্ধে কোন কথাই বলতেন না। কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, “আপনি এত বিদ্যা অর্জন করেছেন, কিন্তু ভগবান সম্বন্ধে কোন জায়গায় কিছু বলেন না কেন?” তিনি উত্তর দিলেন “বাপু, আমার চাবুক খাবার ভয় আছে।” অর্থাৎ যে বস্তু নিজে বুঝি না, সেই বস্তু সম্বন্ধে বলতে গেলে চাবুক খেতে হবে। কিন্তু তবু বন্ধু-বান্ধবরা ছাড়েন না। তখন নেহাত ধরাধরির জন্য “বোধোদয়” বই-এর গোড়াতেই লিখলেন “ঈশ্বর নিরাকার, চৈতন্যস্বরূপ”। এখন এই ‘নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ ঈশ্বর’ লিখে তিনি ছাত্রদের কি উপকার করলেন জানি না, কিন্তু মাস্টারদের একেবারে বিপর্যস্ত করলেন।
স্বামী ভূতেশানন্দের ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-প্রসঙ্গ’ থেকে