এটা হয় পূর্ণ শরণাগতির কথা, নয়তো সুবিধাবাদীর কথা। পূর্ণ শরণাগতির ভাব নিয়ে যে বলবে, সে কিন্তু কোনও চেষ্টাই করবে না। ত্রৈলঙ্গস্বামীকে কাশীর নরেশ হীরের বালা পরিয়ে দিয়েছিলেন। একটি চোর এসে খুলে নিয়ে গেল। ওঁর দুটোতেই সমান। কোনটিতেই চেষ্টা নেই। এটি পূর্ণ শরণাগতি, কিন্তু যতক্ষণ অন্য চেষ্টা রয়েছে, চাকরি করছে, দোকান বাজার করছে, বায়োস্কোপ দেখছে, হাত পা নাড়ছে, সব কিছুই করছে নিজের চেষ্টায়, শুধু তাঁর বেলাতেই বলছে—তিনি করিয়ে নিন, আমি বলবো কেন? তা বললে তো হবে না। তিনি তো অহংরূপ সম্পত্তিটি দিয়েই দিয়েছেন। দেখছেন কতটুকু বাজে খরচ আর কতটুকু তাঁর জন্য। মানুষ এই অহংটুকু নিয়ে কিছুটা সংসারে দিয়ে কিছুটা তাঁকে দিতে পারে। সংসারীদের অনেক সুবিধা। ঠাকুর জানেন, বিশ মণ বোঝা ঠেলে তাকে ডাকতে হচ্ছে, তাই অল্পতেই সন্তুষ্ট। তিনি সকলের দরজায় কাঙাল হয়ে ঘুরছেন কিন্তু আমরা তাঁকে সেটুকুও দিতে পারি না। ঈশ্বরকে ডাকার কথা বললেই বলবে— দাঁড়াও, সময় হোক, তিনি না ইচ্ছা করলে তো হয় না, তিনি যেদিন ডাকবেন সেদিন হবে। কিন্তু আসলে সে-ই চায় না। তিনি ঠিকই দিয়ে যাচ্ছেন। সকলকেই সমানভাবে দিয়ে যাচ্ছেন। যে চাচ্ছে, যে চাচ্ছে না, সবাই একই আকাশের নীচে একই আলো, একই বাতাস পাচ্ছে। কার্পণ্য তাঁর নয়, কার্পণ্য আমাদের দিক থেকে, এটা বুঝতে হবে।
সংসারজীবনে কিভাবে চললে সিদ্ধি লাভ সম্ভব? যন সাধন তন সিদ্ধি— সাধনা করলে তবে তো সিদ্ধি লাভ হবে! এখন আমরা সংসারের জন্য আমাদের চোখের জল সমস্ত খরচ করে ফেলি। ছোটবেলা পড়াশুনো, তারপর চাকরী, বিবাহ, ছেলেমেয়ে, এইভাবে বাড়তে বাড়তে জীবনের অর্ধেক সময় চোখের জল বেকার চলে যায়। আকুলআগ্রহ যদি হয় তাহলে উপায়ও মিলে যায়। সংসার করছো কর কিন্তু তার মোড় ফিরিয়ে আনতে হবে ভগবানের দিকে বা ইষ্টের দিকে। মনটাকে রাখতে হবে ঈষ্টমুখী ক’রে। যে তারামায়ের ভক্ত সে তারামায়ের প্রতি, যে বৈষ্ণব তার শ্রীকৃষ্ণের প্রতি, অথবা যার ইষ্ট নির্দিষ্ট ক’রে দিয়েছেন গুরু, তার ইষ্টের প্রতি মনটাকে রাখতে হবে। যেমন সাধনা তেমন সিদ্ধি। মনকে ইষ্টমুখী করাই সাধনা। তাই প্রথম দরকার মোড় ফিরিয়ে দেওয়া। কথামৃতে যেটি আছে। সংসারের দিকে মন ছুটছে, চাহিদা জাগছে নানান রকমের। কিন্তু কেন? সব চাহিদা সব আকুলতা সংসারকে দেবে কেন? এটা তো ঠিক যে, আমরা কিছুটা অংশ অন্ততঃ ভগবানের দিকে দিতে পারি। কাজেই সেটা দিয়েই শুরু করতে হবে। “তোমায় আমি পাইনি যেন সে কথা রয় মনে।” সংসার ভগবানই দিয়েছেন, কাজেই করতে হবে। সংসার করতে গেলে কিছুটা মনের খরচ হবেই কিন্তু কিছুটা অংশ রাখতে হবে তাঁর জন্য।
শ্রীঅর্চনাপুরী মাতার ‘ছড়ানো মুক্তো’ থেকে