ঈশ্বর সম্বন্ধে যেরূপ মতভেদ, এরূপ মতভেদ বোধহয় আর কোনো বিষয়ে নয়। ঈশ্বর আছেন কি না, তিনি সাকার বা নিরাকার এবং কোন্ সাকার মূর্তি তাঁহার স্বরূপ-মূর্তি, অজ্ঞানবশতঃ ইহা লইয়া বাদানুবাদ নিয়তই চলিতেছে। ম্যাকস্মুলার বলেন যে, প্রধানত আট প্রকার ধর্ম প্রচলিত আছে। [আরও] অধিক থাকুক বা না-থাকুক, দেখা যায়, প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর মধ্যে নানাপ্রকার সম্প্রদায়; ও প্রতি সম্প্রদায় যেন বিরোধী ধর্মাবলম্বী। প্রতি সম্প্রদায়ই অপর সম্প্রদায়ের জন্য নরক বন্দোবস্ত করিয়াছেন। হিন্দুধর্মেও এইরূপ বিরোধ। এক সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের [মধ্যেও] উপাসনা লইয়া পরস্পরে এইরূপই বিরোধ। কিরূপে ভগবান রামকৃষ্ণ পরমহংস এই সকল বিরোধ মীমাংসা করিয়াছেন, তাহা যিনি পরমহংসদেব সম্বন্ধে কোনো কথা কিছু শুনিয়াছেন, তাঁহার অগোচর নাই। কিন্তু সে বিষয় উপস্থিত আমাদের আলোচ্য নয়। পরমহংসদেব সকল প্রকার উপাসনার কথাই বলিয়াছেন। তাঁহার মতে, মনুষ্য-মাত্রেই স্বীয় আধ্যাত্মিক অবস্থা অনুসারে উপাসনা করিয়া থাকে, সেই উপাসনাই প্রশস্ত। মনুষ্যের আধ্যাত্মিক অবস্থা সম্বন্ধে যাহা তিনি বলিতেন ও সেকথা আমার যেরূপ বুঝিয়াছি, বর্তমান প্রবন্ধে আমি তাহাই প্রকাশ করিবার চেষ্টা পাইব। ঈশ্বরলাভের উপায় সম্বন্ধে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন অভিপ্রায় প্রকাশিত করেন। কেহ মনে করেন, ঈশ্বর কি সহজে পাওয়া যায়? একজন বড় লোকের [সঙ্গে] দেখা করিতে হইলে কত লোকের উমেদারী, কত প্রকার পরিশ্রম, কত লোকের কত প্রকার স্তব-স্তুতি করিতে হয়। এইসকল উমেদারী ও পরিশ্রমের ফলেও সেই বড় লোকের দেখা পাইবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু এরূপ কষ্ট ব্যতীত যে, দেখা পাইবে না, ইহা নিশ্চিত। কেহ মনে করেন, ঈশ্বর নির্গুণ, শত উপাসনা করো, কিছুতেই কিছু হইবে না; আপনাকে নির্গুণ অবস্থায় লইয়া যাইবার চেষ্টা করো, বহু সাধনার পর সেই নির্গুণ অবস্থা প্রাপ্ত হইবে। কেহ মনে করেন, তাঁহার উপাসনার প্রথাসকল রহিয়াছে, সেই প্রথা অনুসারে কার্য করো, পুষ্পে, নৈবেদ্য প্রভৃতি দিয়া অর্চনা করো, শুদ্ধরূপে মন্ত্রসকল উচ্চারণ করো—এই সকল কার্য করিতে-করিতে যদি ত্রুটি না হয়, তাঁহার কৃপাদৃষ্টি পড়িলেও পড়িতে পারে। কেহ-বা বলেন, ও-সকল বাহ্যপূজায় কি ঈশ্বরের তৃপ্তি হয়? ও-সকল বাহ্যপূজা নিম্ন অধিকারীর নিমিত্ত। তাঁহার নাম করো, ধ্যান করো, কীর্তন করো, ক্রমে ক্রমে উন্নতি হইতে থাকিবে। কেহ বলেন, অতি শুদ্ধাচারে থাকিতে হইবে, প্রত্যহ স্নান করিয়া শুচি হও, সকাল বিকাল সন্ধ্যাহ্নিক করো, হবিষ্যান্ন আহার করো, আগে দেহশুদ্ধি করো, তারপর সে কথা। কেহ-বা বলেন প্রাণায়াম করিয়া আগে মনস্থির করো, নেতি ধৌতি করিয়া দেহশুদ্ধি করো—উপাসনার কথা পরে। কেহ তাঁহাদের কথায় আপত্তি করিয়া বলেন যে, সংসারে থাকিয়া নানা সাংসারিক কার্য করিয়া—ও-সকল কার্য কিরূপে হইবে? তাহার উত্তরে যোগপন্থী বলেন—“সত্যই তো, তাহা হইবার নয়, অতএব সন্ন্যাস আশ্রম অবলম্বন করো।” সে কথার প্রত্যুত্তরে তাঁহার প্রতিবাদী বলেন, “কেন, গার্হস্থ্যধর্ম কি ধর্ম নয়? গার্হস্থ্যধর্মে কি হয় না?”
‘ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ, গিরিশচন্দ্র ঘোষ’ থেকে