‘তিনিই আস্তিক, তিনিই নাস্তিক; তিনিই ভাল, তিনিই মন্দ; তিনিই সৎ তিনিই অসৎ; জাগা, ঘুম এ সব অবস্থা তাঁরই; আবার তিনি এসব অবস্থার পার।’ এই তত্ত্বে স্থিতি থাকতে পারলে সব গোল মেটে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এই মায়ার রাজ্যে আছি, পার্থক্যের অনুভব করছি, দ্বৈতবুদ্ধি রয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সব হিসাব মেলে না। নানান রকমের প্রশ্ন ওঠে। ভগবান কেন এই জগৎটাকে সৃষ্টি করেছেন, কেনই বা কাকেও ভাল, কাকেও মন্দ করলেন? কর্মফল যদি বলি, কর্মফলই বা তিনি করলেন কেন? তিনিই যদি সব কিছু স্রষ্টা তাহলে এরকম নিগূঢ় কর্মের বন্ধনে তিনি মানুষকে বাঁধলেন কেন? এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না। যার যেমন বিশ্বাস সে সেই অনুসারে ধারণা করে। কিন্তু পরিষ্কার করে কেউ বলতে পারে না কেন তিনি এইরকম করেন। তাই এককথায় বলে তাঁর লীলা অচিন্ত্য, তা বোঝার সাধ্য আমাদের নেই। সুতরাং গোল রয়েই যায়। ঠাকুর বলতেন, সব গোল মেটে যদি ‘তিনিই সব’ এই বুদ্ধি হয়। তিনিই যদি সব হয়ে থাকেন তাহলে তিনি কেন ভালমন্দ করলেন এ প্রশ্ন আসে না। কার ভাল, কার মন্দ? তিনি নিজেই সব হয়েছেন।
তারপর ঠাকুর বললেন, ঈশ্বরই কর্তা, তাঁর ইচ্ছাতেই সব হচ্ছে। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা আমরা বুঝতে পারি না। আমরা যতক্ষণ আমাদের ইচ্ছাকে ভগবৎ ইচ্ছা থেকে পৃথকরূপে বোধ করছি, যতক্ষণ আমরা নিজেদের একটি সীমিত গণ্ডীর ভিতর আবদ্ধ করে রেখেছি, ততক্ষণ ভগবৎ ইচ্ছাকে বোঝা আমাদের সাধ্যে নেই। তাই আমরা ঠাকুরের এই কথাটির তাৎপর্য বুঝতে পারি না। হাজরা তাই বললেন, ঈশ্বরের ইচ্ছাতে সব হচ্ছে, হতে পারে, কিন্তু বোঝা বড় শক্ত। তারপরে হাজরা নিজের কথাটির সমর্থনে একটি ঘটনা বললেন। ভূকৈলাসের সাধুকে কত কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা হল। সমাধিস্থ সাধু, নানারকম ভাবে তাঁর চৈতন্য আনবার জন্য কষ্ট দেওয়া হয়েছিল। শেষপর্যন্ত সাধুটি দেহত্যাগ করলেন। এর দুটি কারণই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে—লোকে যন্ত্রণা দেওয়ার ফলে তিনি মারা গেলেন, আবার ঈশ্বরের ইচ্ছাতে সব কর্ম, সুতরাং ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই মারা গিয়েছেন এও বলতে পারা যায়। কোন্টি যে ঠিক তা কেউ জানে না।
ঠাকুর আর একটি কথা বললেন, ‘যার যা কর্ম, তার ফল সে পাবে। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছায় সে সাধুর দেহ-ত্যাগ হ’ল কেন? না, দেহটা একটা যন্ত্র। এই যন্ত্রটা আমরা গ্রহণ করি তা দিয়ে কাজ করবার জন্য। আমরা কোদাল তৈরী করি মাটি কাটবার জন্য, মাটি কাটা হয়ে গেলে সেই কোদালের আর কোন উপযোগিতা থাকে না। উপমা দিয়েছেন ঠাকুর, কূয়া খোঁড়বার জন্য ঝুড়ি কোদাল দরকার, খোঁড়া হয়ে গেলে সেই ঝুড়ি কোদাল কেউ ফেলে দিতে পারে আবার কেউ রেখে দেয় যদি অপরের কাজে লাগে। তেমনি দেহও একটা যন্ত্র, আত্মজ্ঞান লাভের জন্যই দেহের প্রয়োজন। এই কাজ সিদ্ধ হবার পর দেহটার আর কোন প্রয়োজন থাকে না। আত্মজ্ঞান লাভ হয়ে গেলে দেহটা থাকল আর গেল তাতে কিছু আসে যায় না। একটা উপমা দিলেন ঠাকুর, বোতলের ভিতরে মালমশলা দিয়ে মকরধ্বজ তৈরী করা হয়, মকরধ্বজ হয়ে গেলে পুরো বোতলটাকে ভেঙে ফেলে, ওর আর কোন দরকার নেই। ঠিক সেইরকম আত্মজ্ঞান লাভের জন্য দেহটার প্রয়োজন আছে তাই তাকে যত্ন করতে হবে।
স্বামী ভূতেশানন্দের ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-প্রসঙ্গ’ থেকে