বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
অমৃতকথা
 

ব্রহ্মসূত্র

বৈষ্ণাবাচার্য শ্রীজীব গোস্বামী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু-প্রবর্তিত দার্শনিক মতকে অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ নামে অভিহিত করিয়াছেন। শ্রীমন্মহাপ্রভু ‘শ্রীমদ্ভাগবত’কেই তাঁহার মতবাদের সর্বোত্তম গ্রন্থজ্ঞানে অপর কোন গ্রন্থ প্রণয়ন করা আবশ্যক মনে করেন নাই। শ্রীজীব গোস্বামী প্রণীত ‘ষট্‌সন্দর্ভে’ অচিন্ত্যভেদাভেদ মতবাদের পরিচয় প্রদত্ত হইয়াছে। পরে শ্রীবলদেব বিদ্যাভূষণ বৃন্দাবনের শ্রীগোবিন্দজীর আদেশে শ্রীচৈতন্যদেব-প্রচারিত অচিন্ত্যভেদাভেদমতে ‘ব্রহ্মসূত্রে’র ভাষ্য লিপিবদ্ধ করেন, এইরূপ প্রসিদ্ধি আছে। এইজন্য বলদেবের ‘ব্রহ্মসূত্র’-ভাষ্য বলদেব-ভাষ্য বা গোবিন্দ-ভাষ্য নামে পরিচিত।
শ্রীবলদেবও শ্রীমদ্ভাগবত’কেই শ্রীচৈতন্য-অনুমোদিত ‘ব্রহ্মসূত্র’-ভাষ্য বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহার মধ্যে অদ্বিতীয় তত্ত্ব পরমাত্মস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণের উপাসনাই মুক্তি লাভের উপায়। তিনি বলেন, ব্রহ্ম নির্গুণ এবং নির্গুণ ব্রহ্মই বেদ-প্রতিপাদ্য কিন্তু তাঁহার সিদ্ধান্তে নির্গুণ শব্দের অর্থ—গুণাতীত, গুণবর্জিত নয়। ব্রহ্ম জগতের নিমিত্ত ও উপাদান উভয়বিধ কারণ হইয়াও সকল বস্তু হইতে স্বতন্ত্র, আবার তিনি সকলের অন্তর্নিহিত সত্তাও বটেন। তিনি সকল বিষয়ে পূর্ণ এবং সকল মাঙ্গলিক গুণযুক্ত।
গোবিন্দ-ভাষ্যে ঈশ্বর জীব প্রকৃতি কাল ও কর্ম এই পঞ্চতত্ত্ব স্বীকৃত। ঈশ্বর (শ্রীকৃষ্ণ) প্রথম তত্ত্ব, তিনি অসীম সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান এবং জীব নামক দ্বিতীয় তত্ত্ব সসীম অল্পজ্ঞ ও অল্পশক্তিবিশিষ্ট; উভয়েই শাশ্বত ও অনাদি। ঈশ্বরেচ্ছায় জীব প্রকৃতি কাল ও কর্ম এই তত্ত্বচতুষ্টয় সক্রিয় হইয়া পরিচালিত হইতেছে। ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করিয়া ইহার অন্তর্নিহিত থাকিয়া ইহাকে পরিচালন করিতেছেন বলিয়া তাঁহাকে অন্তর্যামী বলা হয়।
শ্রীবলদেব-সিদ্ধান্তে জগৎ ও জীব সত্য। জীব শ্রীকৃষ্ণের নিত্যদাস। সৃষ্টি ঈশ্বরের লীলা-বিলাস। ঈশ্বর ও জীবে ভেদ নিত্য। কারণ, জীব ক্ষুদ্র ও ঈশ্বর বৃহৎ। তবে জীব ঈশ্বরের চৈতন্যাংশ বলিয়া ভক্তগণ উভয়ের মধ্যে অচিন্ত্যভেদাভেদ কল্পনা করেন। জীব ও ঈশ্বরে চৈতন্যাংশে সমতা থাকিলেও জীবগণের কর্মফল-বিষয়ে আসক্তি এবং সাধনাদির তারতম্যের জন্য তাহাদের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। ঈশ্বর অদ্বিতীয় হইলেও তাঁহার বহু রূপ ও ভাব আছে। তিনি অরূপ হইয়াও ভক্তের প্রতি কৃপাবশে নানা রূপ পরিগ্রহ করিয়া তাঁহাকে দর্শন দেন।
শ্রীবলদেব-মতে অপরোক্ষ জ্ঞান বা পরা ভক্তিই মোক্ষের হেতু। শ্রীকৃষ্ণের কৃপালাভই মোক্ষ।
বৈষ্ণবাচার্য বিষ্ণুস্বামী বিশুদ্ধ দ্বৈতবাদের প্রবর্তক এবং তাঁহার প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়ের নাম রুদ্র-সম্প্রদায়। বিষ্ণুস্বামীর শিষ্যপরম্পরাক্রমে আচার্য বল্লভ শুদ্ধ দ্বৈতবাদ প্রবর্তন করিয়া বল্লভ-সম্প্রদায় স্থাপন করেন।
তাঁহার সিদ্ধান্তে ব্রহ্ম নির্বিশেষ ও বিশেষ, নিরাকার ও সাকার এবং নির্গুণ ও সগুণ উভয়ই। তিনি বলেন মায়াধীশ ব্রহ্ম সজাতি-বিজাতি-স্বগত-ভেদশূন্য এবং দেশ-কাল-বস্তু-স্বরূপ-ভেদ-বর্জিত। তাঁহার মতে জগৎ সত্য। জীব অণুতুল্য চিৎ পরিচ্ছিন্ন ও আনন্দ-স্বরূপ। অজ্ঞান-জন্য জীব তাহার স্বরূপ বিস্মৃত হইয়া সংসার-মোহে নিপতিত। দ্বৈতবাদী বল্লভ জীবাত্মা ও পরমাত্মার শুদ্ধস্বরূপ স্বীকার করেন।
বল্লভাচার্যের সিদ্ধান্তে গোলোকপতি শ্রীকৃষ্ণই পরমব্রহ্ম। তিনি বলেন, গোপীদের ন্যায় ভক্তিরসে সিক্ত হইয়া ফলরূপা ও সাধনরূপা সেবা-সহায়ে শ্রীকৃষ্ণের কৃপালাভই মোক্ষ। এই সম্প্রদায়ে বাৎসাল্যরসে বালগোপালের পূজা ও উপাসনা প্রচলিত। বল্লভের মতো কায়মনোবাক্যে শ্রীকৃষ্ণের আত্মনিবেদনই প্রকৃত ভক্তি।
বৈষ্ণবশাস্ত্রে শান্তাদি পঞ্চভাবে বিষ্ণু রাম কৃষ্ণ প্রভৃতির উপাসনার মাহাত্ম্য যেমন কীর্তিত, আগমশাস্ত্রে জগৎকারণ শিবকে দাস্যভাবে বা পিতৃভাবে এবং তন্ত্রশাস্ত্রে জগজ্জননী শক্তিকে মাতৃভাবে ভক্তিযোগে উপাসনা করিবার মহিমাও তেমনিই বর্ণিত। শৈবশাস্ত্র বলেন, ব্রহ্মরূপী শিব চিৎস্বরূপে নির্গুণ নিষ্কল ও নিষ্ক্রিয় এবং ক্রিয়াস্বরূপে স্বগুণ স-কল ও সক্রিয় উভয়রূপী। প্রথমোক্ত অবস্থায় শিবের মধ্যে শক্তি সুপ্ত বলিয়া তিনি অব্যক্ত। তাঁহার এই বাক্যমনাতীত অব্যক্তস্বরূপ জ্ঞানযোগগম্য। শেষোক্তাবস্থায় শিবের মধ্যে শক্তি সক্রিয় বলিয়া তিনি ব্যক্ত। তাঁহার এই ব্যক্ত সগুণস্বরূপ ভক্তিযোগে ভক্তের উপাস্য। শৈব ভক্তগণ এই সগুণ শিবকে পিতা বা প্রভুজ্ঞানে দাস্যভাবে ভক্তিযোগে উপাসনা করেন। এই উপাসনার চরমাবস্থায় রাগাত্মিকা ভক্তির আধিক্যে শৈব ভক্ত আপনার শিবস্বরূপ প্রত্যক্ষ করেন এবং সর্বভূতে শিবকে প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়া থাকেন।
তান্ত্রিক ভক্তগণ শিবরূপী ব্রহ্মের সক্রিয় শক্তিকে প্রধানতঃ কালি তারা দুর্গা প্রভৃতি দেবীরূপে ভক্তিযোগে উপাসনা করেন। তাঁহাদের দৃষ্টিতে অগ্নি ও উহার দাহিকা শক্তির ন্যায় ব্রহ্ম ও শক্তিতে কোন ভেদ নাই। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলিয়াছেন, “ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী। একই বস্তু। যখন তিনি নিষ্ক্রিয়—সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কোন কাজ করছেন না, এই কথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন তিনি এই সব কাজ করেন, তখন তাঁকে কালী বলি। একই ব্যক্তি, নামরূপ ভেদ।” শাক্ত ভক্তগণ বৈদান্তিকদের ন্যায় নামরূপাত্মক জগৎকে মিথ্যা বা মায়িক বলিয়া উড়াইয়া দেন না। পরন্তু, নামরূপাত্মক জগতের সকল ভূতকে শক্তির প্রকাশমূর্তি জ্ঞানে সত্য বলিয়া মনে করেন। তন্ত্রশাস্ত্র বলেন, “শক্তি নিত্যস্বরূপা, এই জগৎ তাঁহার মূর্তি, তিনি অখিল ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া অবস্থিত।” তান্ত্রিক ভক্তের মতে শক্তিঅচিৎ নহেন। “তিনি প্রকৃতিরূপা হইয়াও চিদানন্দস্বরূপা”। ব্রহ্মশক্তি মাতার ন্যায় এই বিশ্ব প্রসব করিয়া ইহাকে ধারণ ও পালন করিতেছেন। এইজন্য শাক্ত ভক্ত তাঁহাকে জগন্মাতারূপে ভক্তিযোগ উপাসনা করেন। এই সাধনায় মাতার প্রতি সন্তানের ঐকান্তিক শ্রদ্ধা ও ভালবাসামিশ্রিত দাস্যভাব আরোপিত হইয়া থাকে। সর্ববাসনাবিমুক্ত হইয়া সর্বস্বরূপিণী জগন্মাতার নিরন্তর স্মরণ মনন করার ফলে শাক্ত ভক্ত বৈধী ভক্তি অতিক্রম করিয়া রাগাত্মিকা ভক্তির স্তরে উপনীত হন। এই অবস্থায় তিনি প্রত্যক্ষ দেখেন যে, বিশ্বেশ্বরীর ইচ্ছায়ই বিশ্বের সকল কার্য—এমন কি তাঁহার নিজ দেহ-মনের কার্যও পরিচালিত হইতেছে। তিনি রাগাত্মিকা ভক্তির প্রাবল্যে স্পষ্ট দেখিতে পান—“জগন্মাতাই সর্বভূতে শক্তিরূপে বিরাজিতা।”
স্বামী সুন্দরানন্দের ‘যোগচতুষ্টয়’ থেকে

4th     July,   2022
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ