সদ্গুরুর কাছে উপদেশ লইতে হয়। সদ্গুরুর লক্ষণ আছে। যে কাশী গিয়েছে আর দেখেছে, তার কাছেই কাশীর কথা শুনতে হয়। শুধু পণ্ডিত হলে হয় না। যার সংসার অনিত্য বলে বোধ হয় নাই, সে-পণ্ডিতের কাছে উপদেশ লওয়া উচিত নয়। পণ্ডিতের বিবেক-বৈরাগ্য থাকলে তবে উপদেশ দিতে পারে। সংসারীদের লোক-শিক্ষা দিবার অধিকার নেই। ত্যাগী না হ’লে লোক-শিক্ষার অধিকারী হয় না। গৃহস্থ হ’লে ক-জন তার কথা শুনবে? সংসারী লোকের অবসর কই? একজন একটি ভাগবতের পণ্ডিত চেয়েছিল। তার বন্ধু বললে—একটি উত্তম ভাগবতের পণ্ডিত আছে, কিন্তু তার একটু গোল আছে; তার নিজের অনেক চাষবাস দেখতে হয়; চারখানা লাঙ্গল, আটটা হেলে গরু। সর্বদা তদারক করতে হয়, অবসর নাই। যার পণ্ডিতের দরকার, সে বললে—আমার এরূপ ভাগবত পণ্ডিতের দরকার নাই, যার অবসর নাই। লাঙ্গল হেলেগরু-ওয়ালা ভাগবত পণ্ডিত আমি খুঁজছি না। আমি এমন পণ্ডিত চাই, যে আমাকে ভাগবত শোনাতে পারে।
আচার্যের কাজ বড় কঠিন। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ আদেশ ব্যতিরেকে লোক-শিক্ষা দেওয়া যায় না। যদি আদেশ না পেয়ে উপদেশ দাও, লোক শুনবে না। সে উপদেশের কোনও শক্তি নাই। আগে সাধন ক’রে, বা যে কোনরূপে হোক, ঈশ্বর লাভ করতে হয়। তাঁর আদেশ পেয়ে লেক্চার দিতে হয়। ওদেশে হালদারপুকুর বলে একটা পুকুর আছে। পাড়ে রোজ সকালবেলা লোক বাহ্যে ক’রে রাখত। যারা সকালবেলা আসে, খুব গালাগালি দেয়। আবার পরদিন সেইরূপ। বাহ্যে করা আর থামে না। লোকে কোম্পানিকে জানালে। তারা একটা চাপরাসি পাঠিয়ে দিলে। সে যখন একটা কাগজ মেরে দিলে, ‘এখানে বাহ্যে করিও না’, তখন সব বন্ধ।
গুরু, কর্তা আর বাবা—এই কথাতে আমার গায়ে কাঁটা বেঁধে। সচ্চিদানন্দই গুরু। তিনিই শিক্ষা দিবেন। সকলেই গুরু হ’তে চায়, শিষ্য হ’তে কেউ চায় না। লোক-শিক্ষা দেওয়া বড় কঠিন। তিনি যদি সাক্ষাৎ দেখা দিয়ে আদেশ দেন, তবে হ’তে পারে। আদেশ না হ’লে কে তোমার কথা শুনবে? নারদ, শুকদেব, শঙ্করাদির আদেশ হয়েছিল। আবার মনে মনে আদেশ হ’লে হবে না। তিনি সত্য সত্যই দেখা দেন, কথা কন। সে কথার জোর কত? পর্বত টলে যায়। শুধু লেক্চার? দিন কতক লোক শুনবে, তারপর ভুলে যাবে। সে-কথা অনুসারে কাজ করবে না। লোক-শিক্ষা দেবে তার চাপরাস চাই, না হ’লে হাসির কথা হ’য়ে পড়ে। আপনারই হয় না, আবার অন্য লোক। কানা কানাকে পথ দেখিয়ে যাচ্ছে। হিতে বিপরীত। ভগবান্ লাভ হ’লে অন্তর্দৃষ্টি হয়, কার কি রোগ বোঝা যায়, উপদেশ দেওয়া যায়। আদেশ না থাকলে ‘আমি লোক-শিক্ষা দিচ্ছি’ এই অহঙ্কার হয়। অহঙ্কার হয় অজ্ঞানে। অজ্ঞানে বোধ হয়—আমি কর্তা। ‘ঈশ্বরই সব করছেন, আমি কিছু করছি না’, এ-বোধ হ’লে তো সে জীবন্মুক্ত। ‘আমি কর্তা’ এই বোধ থেকেই যত দুঃখ, অশান্তি। যদি আদেশ হ’য়ে থাকে, তাহলে লোক-শিক্ষায় দোষ নাই; আদেশ পেয়ে যদি কেউ লোক-শিক্ষা দেয়, তাকে কেউ হারাতে পারে না।
স্বামী রঘুবরানন্দের ‘গুরুতত্ত্ব ও গুরুগীতা’ থেকে