আমাদের ঠাকুর শ্রীসত্যানন্দদেব ছিলেন বিশ্বপিতার প্রতিমূর্তি। বলতেনঃ “আমি জমিটা তৈরী ক’রে দেবো, পারিপার্শ্বিকটা তৈরী ক’রে দেবো, তারপর তারা নিজের নিজের originality নিয়ে ফুটবে।” যেমন, বিশ্বপিতা সব সাজিয়ে দিয়েছেন—আলো বাতাস জমি—সব থরে থরে সাজিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। এখন আপনিই ফুল ফুটবে, ফল ফলবে, সবই হবে। আমাদের ঠাকুরের ছিল ঠিক ওই একই process বা পদ্ধতি। দেখ না, ভগবান, যিনি সৃষ্টিকর্তা, তিনি স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে পরিবেশ সৃষ্টি ক’রে দিয়েছেন। সবাই নিজের নিজের আধার অনুসারে চরমের দিকেই এগিয়ে চলেছে। তারি মধ্যে মৃত্যু আসছে—একটা যবনিকা পড়ছে, আবার নতুন জন্ম হচ্ছে, আবার নতুন পোশাক প’রে নতুন জীবন সুরু করছে মানুষ। আমরা তাকে বলছি জন্মান্তর। কিন্তু তাঁর কাছে এর সবটুকুই একটা অভিনয়ের অঙ্ক মাত্র। তিনি কিন্তু সম্পূর্ণ নিবির্কার। সেই সবের মাঝে থেকেও নিস্পৃহ ভাবটি ঠাকুরের মধ্যেও দেখেছি। এক এক সময় সেটি বিশেষভাবে ফুটে উঠত। রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা শ্রীঠাকুর প্রায়ই বলতেন—
“সবলে কারেও ধরিনে বাসনা মুঠিতে
দিয়েছি সবারে আপন বৃন্তে ফুটিতে।”
ঠাকুর সত্যানন্দদেব ছিলেন ভক্ত-প্রতিপালক। শুধু দীক্ষা দিয়েই দায়িত্ব শেষ নয়, শুধু যে আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ তা নয়, ভক্তদের সবরকম প্রয়োজনের দিকে, অভাব-অনটনের দিকেও ঠাকুরের দৃষ্টি ছিল। কোনও ভক্তের বাড়িতে শুনেছেন দুধ জোটে না, অথচ তাদের দুধের খুবই দরকার। আশ্রম থেকে ভালো দুধ মহাপ্রসাদ ক’রে বড় গেলাস ভর্তি ক’রে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কাউকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন, কাউকে জামা-কাপড় দিয়েছেন। কী বলবো, কী উপমা দেব, বুঝতে পারছি না। ঠিক যেমন রাজা। প্রজাপ্রতিপালক রাজা যেমন তার প্রজাদের সবরকমে প্রতিপালন করে, তেমনি আমাদের ঠাকুর তাঁর ভক্ত-শিষ্যদের প্রতিপালন ক’রে গেলেন সারাজীবন। যাদের অহোভাগ্য তারা সে করুণার কথা আজও মনে রেখেছে।
ঠাকুর সত্যানন্দদেব ছিলেন পূর্ণতম সত্তা। আশ্রমের সব কাজের মধ্যেই ছিলেন ঠাকুর। ধ্যান-জপ, পূজো-পাঠ, গান-বাজনা, অভিনয়, সেলাই-এর কাজ, রান্নাবান্না, ঘরঝাঁট সবই ছিল ঠাকুরকে ঘিরে, ঠাকুরের জন্যে। তাই ঠাকুরকে একটা শুধু পূজার জিনিস, সেবার জিনিস করে রাখা হয়নি; নানান বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে চলেছে আমাদের জীবন। ঠাকুর গান লিখতেন, আমরাও লিখতাম। কত সুরবৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের সমস্তই হয়েছে ঠাকুরের আশ্রয়ে এসে। নাটক লিখেছি, সেগুলো আমাদেরই ছেলেমেয়েরা অভিনয় করেছে। ঠাকুর সেগুলো দেখে কত আনন্দ করতেন। আমাদের মেয়েদের থিয়েটার নামকরা থিয়েটারের চেয়ে কিছু কম ছিল না।
অর্চনাপুরী মায়ের ‘ছড়ানো মুক্তো’ থেকে