যোগবাশিষ্ঠে ত্যাগের একটি গল্প আছে। কোন ব্রহ্মচারী আপনাকে ত্যাগী মনে করে সমস্ত বাহ্যিক ত্যাগ করে অতি সামান্য বস্ত্র, আসন, কমণ্ডলু লয়ে থাকত। তাহার গুরু তাহার চৈতন্য করাবার জন্য তাকে বললেন, তুমি কি ত্যাগ করেছ? কিছুই তো ত্যাগ কর নাই। ব্রহ্মচারী ভাবলে, আমার তো কিছুই নাই, মাত্র পরিধানবস্ত্র, আসন ও কমণ্ডলু আছে। গুরুদেব কি এই সকল মনে করিতেছেন? এই ভাবিয়া ব্রহ্মচারী ঐ সকল ত্যাগ করিবার ইচ্ছা করতঃ সম্মুখে অগ্নি প্রজ্জ্বালিত করিয়া তাহাতে একে একে ঐ সমস্ত বস্তু অর্পণপূর্বক বলিল, এইবার আমার সমস্ত ত্যাগ হইয়াছে। গুরু বলিলেন, তোমার কি ত্যাগ হইয়াছে? বস্ত্র? উহা তো তুলা হইতে নির্মিত; এইরূপ আসন, কমণ্ডলু প্রভৃতি—উহারাও বিভিন্ন বস্ত হইতে নির্মিত, উহাদের ত্যাগ করিয়া তোমার কি ত্যাগ করা হইল? তখন ব্রহ্মচারী ভাবিল, আমার কি আছে? অবশ্য আমার শরীর আছে। আচ্ছা, এই শরীরকে অগ্নিতে আহুতি দিব। এই স্থির করিয়া যখন ব্রহ্মচারী সম্মুখস্থ অগ্নিতে আপনার শরীর অর্পণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইল, তখন তাহার গুরুদেব বলিলেন—অপেক্ষা কর, কি করিতেছ বিচার কর দেখি, এ শরীরে তোমার কি আছে? ইহা তো পিতামাতার শুক্রশোণিতে উৎপন্ন এবং আহার দ্বারা বর্ধিত ও পুষ্ট, ইহাতে তোমার কি? তখন ব্রহ্মচারীর চক্ষু উন্মীলিত হইল। গুরুকৃপায় তখন সে বুঝিতে পারিল যে, মাত্র অভিমানই যত অনিষ্টের মূল। এই অভিমান ত্যাগ করিতে পারিলেই ঠিক ঠিক ত্যাগ হয়, নচেৎ বাহ্যিক বস্তু, এমন কি শরীর পর্যন্ত ত্যাগ করিলেও কিছুই ত্যাগ করা হয় না। অতএব গ্রহণ, ত্যাগ—এই সমস্তই মন্দ; প্রভুর শরণ—ইহাই সার। তাঁহার চরণে একান্ত ভক্তি, তাঁহার ভক্তে প্রীতি, তাঁহার নামে রুচি—এই সব আসল প্রার্থনা।...মানুষ অন্যায় করিবে না, এইরূপ হওয়া অতিশয় বিরল ও দুর্ঘট, কিন্তু অন্যায় জানিয়া তাহা হইতে বিরত হইতে পারিলে মনুষ্যত্ব প্রকাশ হয়। গত বিষয় স্মরণ না করিয়া বর্তমান ও ভবিষ্যতে সাবধান হইতে পারিলে প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়; শরীর ও মন সবল, সুস্থ ও পবিত্র রাখিবার যত্ন করা একান্ত আবশ্যক, কারণ তাহা না হইলে কোন শুভ কার্যের অধিকারী হওয়া যায় না। ধ্যান করিবার পূর্বে ধ্যান করিবার যোগ্যতা লাভ করিতে হয়। একেবারে ধ্যান-অভ্যাস অতি কঠিন ব্যাপার। প্রথমে মনকে বিষয় হইতে প্রত্যাবৃত্ত করিয়া একটি বিশেষ চিন্তায় আনিবার চেষ্টা করা উচিত—ইহার নাম প্রত্যাহার। এই প্রত্যাহার অভ্যস্ত হইলে মনকে শরীরের কোন বিশেষ স্থানে—যেমন নাসিকাগ্র, ভ্রূমধ্য অথবা হৃদয়ে, যেখানে সুবিধা হয় এক স্থানে রাখিতে পারিলে তাহাকে ধারণা বলে। যখন এই ধারণা-অভ্যাস দৃঢ় হয় তাহার পর ধ্যান করিবার চেষ্টা হওয়া উচিত। এক বস্তুতে অথবা ভাবে চিন্তাপ্রবাহ তৈলধারার ন্যায় অবিচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত করিতে পারিলে তাহাই ধ্যান নামে কথিত হয়। তৈলধারার ন্যায় অবিচ্ছিন্ন বলিবার হেতু এই যে, মধ্যে কোনরূপ ব্যবধান থাকিবে না। চিন্তাস্রোত নিয়তভাবে ধ্যেয় বস্তুতে প্রবাহিত করিতে হইবে। দীর্ঘকাল এইরূপ অভ্যাস করিতে পারিলে মনের সংযম-শক্তি বৃদ্ধি পাইয়া ধ্যান করিবার সামর্থ্য লাভ করিতে পারা যায়।
উদ্বোধনের ‘ধ্যান শান্তি আনন্দ’ থেকে