যখনই একজন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, তাকে কেবল একজন মানুষ বলেই মনে করি। কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে কোন স্পষ্ট ধারণা হয় না। তাকে কি মনে হয়? দেহ? না মন? না আত্মা? না। আমাদের ধারণা হচ্ছে— তিনটি বস্তুর সংমিশ্রিত পিন্ড বিশেষ। আমাদের প্রয়োজন তাকে আত্মারূপে দেখা। কিন্তু এটি সহজ কর্ম নয়। যুগ যুগ ধরে কতগুলি ধারণাযুক্ত করে একজন মানুষরূপে অনুভব করতে অভ্যস্ত হয়েছি। আমাদের বিবেচনায় তার একটি আকৃতি আছে, একটি মন আছে যেটা ভাল বা মন্দ, প্রীতি বা অপ্রীতিকর হতে পারে, আর তার পশ্চাতে রয়েছে একটি অনির্ণেয় বস্তু। মানুষ সম্পর্কীয় আমাদের ধারণা বিশ্লেষণ করলে বুঝতে পারব, সেই অনির্ণেয় বস্তুটিই আমাদের প্রকৃত সত্তা। আকৃতি ও মনের বৃত্তি সবই যেন বাইরের আবরণ। আর এই বহিরাবরণই আমাদের বুদ্ধিতে প্রাধান্যলাভ করে। তারপর আছে নাম। মনে কর, তোমার বন্ধু হরির সঙ্গে দেখা হল। এই নামের সঙ্গে তার শরীর, মন ও আত্মা জড়িত যার সমষ্টিকে তুমি মানুষহরি বল। এখন বিশ্লেষণ কর। যখন দেখা হয়, হরিকে কি তুমি শুধু শরীর মাত্র জ্ঞান কর? নিশ্চয় বলবে— না। তাই যদি হল, তবে হরি সম্বন্ধীয় ধারণাকে শুধু একটি বিশেষ শরীরের সঙ্গে যুক্ত কর কেন? তোমারই ভাল জানা আছে যে এটা জড়, একসময় ছোট ছিল, এখন বড় হয়েছে এবং ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। তাছাড়া এটি খুবই সীমিত। কিন্তু তুমি তো হরিকে সীমাবদ্ধ মনে কর না। বরং তোমার মতে সে একটি আত্মা, মূলতঃ অসীম, শাশ্বত, আনন্দময়, চৈতন্যস্বরূপ। এই দুই বিপরীত প্রান্তবর্তী— শরীর ও আত্মাকে একীভূত করা কি সম্ভব? যখনই হরির সঙ্গে দেখা হয়, তখন তার শরীর সম্বন্ধীয় ধারণাটি মন থেকে বার করে দাও। যদি চাও, প্রথমে তাকে একটি মন বলে ভাবতে শেখ। যখন তার সঙ্গে কথা বল, বা ব্যবহার কর, মনে মনে অনুভব করতে চেষ্টা কর যে, তুমি একটি মনের সঙ্গে ব্যবহার করছ, দেহের সঙ্গে নয়— বর্তমানে প্রকৃতপক্ষে যেরূপ করছ। কিন্তু এটি আরম্ভ মাত্র। মনও তো বাইরের ব্যাপার। লক্ষ্য কর, বাইরের পরিবেশ হরির মনকে কিরূপ পরিবর্তিত করেছে। শৈশব হতে যৌবন পর্যন্ত মন কত পরিবর্তিত হয়েছে এবং প্রতি মুহূর্তে এটি কিভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। মনের অনন্ত ভাব। এরমধ্যে কোনটি হরি? অবশ্য তুমি বলতে পার, বিভিন্ন মানসিক ভাবের মধ্যে যেগুলি অধিক স্থায়ী, সেগুলি তার ব্যক্তিত্ব গঠনে দায়ী। কিন্তু তুমি কি কখনও ভেবে দেখেছ যে অধিক স্থায়ী ভাবগুলি প্রকৃতপক্ষে স্থায়ী নয়? আমরা হিন্দুরা জন্মান্তরে বিশ্বাসী। আমরা জানি ব্যক্তিত্ব বদলায়। তাই হরির ব্যক্তিত্ব শাশ্বত নয়। তাই যদি হল, তবে হরিকে কতগুলি মানসিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তি বলে মনে কর কেন? তাকে মনের সঙ্গে যুক্ত কর কেন? এর পারে যাও। এখন তাকে কিভাবে দেখ? সমস্ত সীমা ও গুণের পারে সে কি? সে আত্মা; স্বয়ং ভগবান। যাকে তুমি এতদিন ব্যক্তি বলে জেনেছিলে, প্রকৃতপক্ষে সে স্বয়ং ভগবান, অনন্ত, শাশ্বত, সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম।
স্বামী অশোকানন্দের ‘দেবত্বের সন্ধানে’ থেকে