বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
অমৃতকথা
 

শ্রীকৃষ্ণের লীলা

শ্রীকৃষ্ণের লীলা একটি খেলার মতন তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। আমাদের লৌকিক খেলাতেও চারিটি পক্ষ থাকে। সপক্ষ, বিপক্ষ, সুহৃৎপক্ষ ও তটস্থ পক্ষ। মনে করুন ফুটবল খেলা হইতেছে। ইহাতে সপক্ষ ও বিপক্ষ আমরা সকলেই বুঝি। সুহৃৎপক্ষ একটু বোঝানো দরকার। সুহৃৎপক্ষ থাকে দর্শকদের মধ্যে। সুহৃৎপক্ষ দুইভাগ। কাহারও এই পক্ষের জয়ে আনন্দ। কাহারও বা অপর পক্ষের জয়ে আনন্দ। তটস্থ পক্ষ কোনও পক্ষেরই জয়-পরাজয়ে আনন্দ বা বিষাদ নাই—খেলা দেখিতেছে আনন্দ, জয়-পরাজয়ে কোনও পক্ষপাতিত্ব নাই। খেলার সময়ে অতি প্রিয়জনও বিপক্ষে যাইতে পারে। খেলার শেষে আর বিপক্ষ ভাব থাকে না। সেইরূপ শ্রীরাধা ও চন্দ্রাবলী সহোদরা ভগ্নীর মতন। খেলার সময়ে তাঁহারা দুইপক্ষ। খেলার অন্তে তাঁহাদের বিরুদ্ধভাব থাকে না। শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন ছাড়িয়া যখন মথুরা যান তখন তাঁহাদের দুইজনের পরস্পরের প্রতি বিরোধভাব আর থাকে না।লীলা একটি খেলা বা অভিনয়ের মতন। অভিনয় অভিনয়ের মতন করিয়া দেখিলে আনন্দ হয় না। অভিনয় তন্ময় হইয়া দেখিতে হয়। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ অভিনয় দেখিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় অভিনয় দেখিতে দেখিতে এত তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন যে একবার রাগ করিয়া মঞ্চে জুতা ছুড়িয়া মারিয়াছিলেন। নীলচাষের অভিনয়ে সাহেবের প্রতি এত অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে, মঞ্চে সাহেবের উদ্দেশ্যে জুতা ছুড়িয়া মারিয়াছিলেন। পরে অনেক কষ্টে তাঁহাকে ইহা অভিনয় এইরূপ বুঝাইয়া তাঁহার ক্রোধ উপশম করানো হইয়াছিল। লীলার কথা বলিতে ও শুনিতে অনেক যোগ্যতার প্রয়োজন। অযোগ্য হইয়া যদি বলি বা শুনি তাহাতে কল্যাণ না হইয়া বরং বিপরীত কিছু হইবার সম্ভাবনা।
মানলীলা—শ্রীকৃষ্ণের সকল লীলা বোঝা কঠিন, তন্মধ্যে মানলীলা সর্বাপেক্ষা কঠিন। স্বপক্ষ ও বিপক্ষ—শ্রীরাধা ও চন্দ্রাবলী পরস্পর বিপক্ষ। যাহারা পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন তাহাদিগকে পরস্পরের বিপক্ষ পক্ষ বলা হয়। বিপক্ষের দু’টি কাজ—ইষ্টহানি ও অনিষ্ট সাধন। শ্রীরাধার অপেক্ষায় শ্রীকৃষ্ণ কুঞ্জে বসিয়া আছেন। ইহা জানিতে পারিয়া চন্দ্রাবলীর সখী পদ্মা চন্দ্রাকে লইয়া শ্রীকৃষ্ণের নিকটে আসিয়াছেন। সুবলের নিকট শ্রীরাধা এই বিবরণ শুনিয়া কী অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন বৃন্দা তাহা শ্রীকৃষ্ণকে বলিতেছেন—হে মুকুন্দ! সুবল শ্রীরাধারানীর নিকট গিয়া বলিলেন—“পদ্মা চন্দ্রাকে শ্রীকৃষ্ণের কাছে নিয়াছেন।” সুবলের মুখে এই কথা শোনামাত্র শ্রীরাধা স্তব্ধতা প্রাপ্ত হইলেন। পরদিন প্রাতঃকাল পর্যন্ত শ্রীরাধার স্তব্ধতা বিরাজমান ছিল। ইহার নাম ইষ্টহানি। অনিষ্টকারীঃ শ্রীরাধার শাশুড়ী জটিলা চন্দ্রাবলীর সখী পদ্মাকে দেখিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন—“তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?” পদ্মা বলিলেন—“আমি গোবর্ধনের তটদেশ হইতে আসিয়াছি।” জটিলা বলিলেন—“আমার বধূকে কি দেখিয়াছ? পদ্মা বলিলেন—“হাঁ দেখিয়াছি। সূর্য মন্দিরের দুয়ারে সূর্য পূজার জন্যে বসিয়া আছে।” জটিলা বলিলেন—“অনেকক্ষণ গিয়াছে—এখনও ফিরিতেছে না কেন?” পদ্মা বলিলেন—“পথে শ্রীকৃষ্ণ যাইতে তাহাকে বাধা দিয়াছে। রাধা কেবল তোমার পথ চেয়ে আছে। দ্রুত চলিয়া যাও।” পদ্মা সখী এইভাবে শ্রীরাধার অনিষ্ট সাধন করিলেন।
কেহ বলিতে পারে—ব্রজে কৃষ্ণের সকলেই প্রিয়জন। সকলেই চাহে শ্রীকৃষ্ণের সুখ। তাঁহারা নিজের সুখ কিছুই চাহেন না। তারই মধ্য বিপক্ষতা কিরূপে সম্ভব? তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে ঈর্ষাদৃষ্টি কিরূপে সম্ভব? শ্রীরূপ গোস্বামী তাহার উত্তরে বলিতেছেন—শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধান সকলেরই কাম্য ইহা ঠিক, তথাপি শ্রীকৃষ্ণই রসের বৈচিত্র্য সম্পাদনের জন্য গোপীসুন্দরীদের মধ্যে স্বপক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি করিয়া থাকেন—শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধির জন্যেই বিপক্ষতাই সৃষ্টি করিয়া থাকেন। প্রেমের স্বাভাবিক গতি অত্যন্ত কুটিল। এই কুটিলতা শ্রীকৃষ্ণের সুখের জন্যই হয়। অসংখ্য ব্রজসুন্দরী শ্রীকৃষ্ণের সুখের জন্য, তাহাদের প্রত্যেকেই শ্রীকৃষ্ণের সান্নিধ্যের নিমিত্ত প্রবলবাসনা। নরলীলায় শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে একই সময়ে সকলের বাসনা পূরণ সম্ভব নয়। মধুর রসে একটি সঞ্চারী ভাব আছে—তাহার নাম ঈর্ষা। শ্রীকৃষ্ণ এই ঈর্ষারূপ সঞ্চারীভাবকে কোনও কোনও ব্রজসুন্দরীতে নিক্ষেপ করেন। ইহা দ্বারা তাহাদের পরস্পরের বিপক্ষরূপ সম্পাদন করেন। ইহাতে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিকূলতা করা হয় না। বরং আনুকূল্যই করা হয়। ঈর্ষার ফলে বিপক্ষ সখীদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণে অনুরাগ পরিপুষ্টতা লাভ করে। শ্রীকৃষ্ণ পরিতুষ্ট হন।
    শ্রীকৃষ্ণের সহিত সংযোগ সময়ে (অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ যখন ব্রজে ছিলেন, তখন) শ্রীরাধা ও চন্দ্রাবলীর মধ্যে পরস্পর বিপক্ষ ভাব, পরস্পরের প্রতি পরস্পরের ঈর্ষাদি জন্মে কিন্তু বিয়োগ দশায় (অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ যখন মথুরায় চলিয়া গেলেন, তখন) তাঁহাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি ঈর্ষাদির পরিবর্তে স্নেহই পরিদৃষ্ট হয়। ইহাতেই জানা গেল—সংযোগকালের ঈর্ষাদ্বেষাদি কেবল বাহ্যবৃত্তিতেই উদিত হয়, অন্তর্বৃত্তিতে  উদিত হয় না। অন্তঃস্থিত কৃষ্ণরতিকে ভেদ করিতে পারে না। বস্তুত ঈর্ষাদ্বেষাদি সঞ্চারিভাব সমূহও কৃষ্ণরতিরই বৃত্তি বিকাশ, কৃষ্ণরতির বিজাতীয় বস্তু নহে। এই বিষয়ে দুইটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। (১) শ্রীকৃষ্ণের মথুরা অবস্থানকালে দিব্যোন্মাদগ্রস্ত শ্রীরাধা একসময়ে গোবর্দ্ধনস্থিত স্ফটিক শিলায় প্রতিফলিত নিজ প্রতিবিম্ব দেখিয়া তাহাকে চন্দ্রাবলী মনে করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতেছিলেন—চন্দ্রাবলী, তুমি বহুবার শ্যামসুন্দরের অঙ্গস্পর্শ লাভ করিয়া ধন্য হইয়াছ—তোমার দেহ মঙ্গলযুক্ত হইয়াছে। তোমার সেই মঙ্গলময় দেহ সৌভাগ্যবশতঃ আমার দৃষ্টিগোচর হইল। তুমি তোমার মঙ্গলময় শীর্ণ বাহু দ্বারা আমার কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া আমাকে প্রাণদান কর। (২) শ্রীশ্রীপ্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দরের ভক্ত শ্রীরমেশচন্দ্র কঠোর ব্রহ্মচারী ছিলেন। তিনি মানলীলা কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছিলেন না। শ্রীশ্রীপ্রভু চম্পটিকে আদেশ করিলেন—তুমি রমেশকে মানলীলার মাধুর্য বুঝাইয়া দাও। তোমাকে কাশীর উত্তরবাহিনী গঙ্গাকে দিয়া যেভাবে বুঝাইয়াছিলাম সেইভাবে বুঝাইয়া দাও। তোমরা দুইজনই উচ্চ ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত। ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিতরা প্রায়ই তার্কিক হয়। তর্কটা বুদ্ধির ফল। অনুভূতিটা বোধির ফল। তোমার একটু বোধি জন্মিয়াছে। রমেশের এখনও জন্মায়নি।
                                                                                                                                                                                                      ‘শ্রীমহানামব্রতপ্রবন্ধাবলী’ থেকে

13th     September,   2021
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ