নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই হল ভারতের অন্তরাত্মার কথা। এদেশে নানা ধর্মের নানা মতের মানুষের বসবাস। বিবিধের মধ্যে রয়েছে মেলবন্ধন। আমরা সকলেই মানুষ, ভারতবাসী। মনুষ্যত্বই আমাদের আসল ধর্ম। অপরের প্রতি সহিষ্ণুতা ও ভালোবাসা আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে সাহায্য করে। এই দেশে বিভিন্ন মতাবলম্বীর মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ভিন্নতা থাকলেও তা বৈচিত্র্যে ভরপুর। তাই আজও একসূত্রে গাঁথা ভারতবাসীর স্বপ্ন আত্মা। মোদিবাহিনী কি তা মানে? না-হলে কেন ভোটের স্বার্থে একতার সেই মূলেই আঘাত করতে উদ্যত হয়েছেন আজকের স্বঘোষিত বিশ্বগুরু! ভোটের মুখে তাঁর আস্তিন থেকে বেরিয়ে পড়েছে সেই পুরনো অস্ত্রটিই, যা মেরুকরণের কথা বলে, বিভেদ বিভাজনের রাজনীতিকেই সঙ্গত করে। হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্থানের এজেন্ডাতেই শান দিচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের এই সরকার! অর্থাৎ মোদি সরকার। ভোটের দিন ঘোষণা না-হলেও মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যত ভোট প্রচারের কাজ শুরু করে দিলেন। হিন্দুত্বই যে গেরুয়া শিবিরের ভোটের অস্ত্র, তা বুঝিয়েও দিলেন রাখঢাক না করে। অস্ত্রটি অবশ্যই ভোঁতা এবং পুরনো। সরাসরি ভোটারদের কাছে তাঁর আকুতি—হিন্দুধর্ম বাঁচান। সনাতন হিন্দুধর্ম। এবং, এর জন্য টেনে আনলেন স্বামী বিবেকানন্দকে! ভোটের রাজনীতির ময়দানে দেশের মনীষীদের ভাবাবেগকে কাজে লাগানোর অভ্যাস বা নির্লজ্জ প্রয়াস এর আগেও বারবার দেখা গিয়েছে। বলা বাহুল্য, অতীতে কোনও সরকারের আমলে এমন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কি না সন্দেহ। কিন্তু কেন্দ্রের এই বিজেপি জমানায় দেখা যাচ্ছে ভোট এলেই মনীষীদের প্রসঙ্গ টেনে বৈতরণী পেরনোর চেষ্টা করে পদ্মশিবির। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। কখনও রবীন্দ্রনাথ, কখনও নেতাজি, কখনও-বা স্বামীজি কিংবা গান্ধীজির প্রসঙ্গ ঘুরে-ফিরে টেনে আনে তারা, অথবা আসে অন্যকোনও মনীষীর কথা। ‘ইন্ডিয়া’ আতঙ্কে ভোগা দিল্লীশ্বর এবার বিরোধী জোটকে নিশানা করতে শেষপর্যন্ত সনাতন ধর্ম বিতর্ককেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে উস্কে দিলেন—যা বললেন তা প্রকারান্তরে বিরোধীদের প্রতি অসৌজন্যেরই বহিঃপ্রকাশ। বললেন, ‘সনাতন ধর্মকে ধ্বংস করাই ওই জোটের লক্ষ্য’। এমনকী, সরকারি অনুষ্ঠানকে তিনি অবলীলায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণের মঞ্চ করে তুললেন!
’২৪-এর লোকসভার ভোটের আগে হিন্দু ভোটের মেরুকরণের কৌশল নিয়ে যে পদ্মশিবির এগচ্ছে, তা কারও অজানা নয়। ধর্মীয় মেরুকরণের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিজেপি। শুধু হিন্দু রাষ্ট্রের এজেন্ডা পূরণের স্লোগানই নয়, হিন্দিভাষা নিয়েও অবস্থান স্পষ্ট করেছে তারা। নানা ভাষাভাষীর দেশ ভারতবর্ষে তারা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, হিন্দি নিছক একটি ‘সরকারি ভাষা’ নয়, এটি ভারতের ঐক্যসাধনের হাতিয়ারও। অর্থাৎ লক্ষ্যে স্থির থেকেই এগচ্ছে পদ্মশিবির। তাই ভোটের মুখে গেরুয়া খোলস থেকে বেরিয়ে পড়ছে তাদের আসল স্বরূপ। কিন্তু প্রশ্ন হল, কোন সনাতন ধর্মের কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি? স্বামী বিবেকানন্দ যে সনাতন ধর্মের কথা বলেছিলেন, তাকে কি মান্যতা দেয় তাঁর ভক্তকুল? স্বামীজি তো বলেছিলেন, কুসংস্কার মানুষের শত্রু বটে, কিন্তু ধর্মান্ধতা আরও খারাপ। মোদি জমানায় ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, চলছে জাতপাত বিভাজন বিভেদের রাজনীতি। তাহলে? স্বামীজি তো মানবধর্মের কথা বলেছেন, বলেছেন সহনশীলতার কথা। মোদি জমানায় সেই সহনশীলতার বড়ই অভাব। আর মানবধর্ম? তাঁর জমানায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। গোমাংস রাখা বা ভক্ষণের ‘অপরাধে’ নিগ্রহের শিকারও হয়েছেন কেউ কেউ। মানবধর্ম আর রক্ষা হচ্ছে কই?
আসলে, বিভিন্ন জনমত সমীক্ষা বলছে, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি আদৌ সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে নেই—বলা যায় ব্যাকফুটে। বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ যত শক্তিশালী হচ্ছে ততই আতঙ্ক তাড়া করছে গেরুয়াবাহিনীকে। তাই বিরোধীদের উপর আক্রমণের শান তীক্ষ্ণ করতে হিন্দুত্বের পুরনো ফর্মুলাকেই কাজে লাগাতে মরিয়া শাসক শিবির। কিন্তু তা করতে গিয়ে কখনও-বা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ছে তারা। ‘সনাতন ধর্মের সঙ্কট’ প্রসঙ্গটি তাই মোদির প্রচারের সিংহভাগ জুড়ে থাকল। এল সনাতন ধর্মের প্রেরণা স্বামীজির প্রসঙ্গ। কিন্তু যে সনাতন ধর্মের কথা স্বামীজি বলেছেন, তা কতটা মেনে চলে গেরুয়া শিবিরের ধর্মান্ধ ধ্বজাধারীরা? চলছে ভণ্ডামি। এবার ভোটে বাঁচতে শেষ ভরসা হিসেবে বেছে নেওয়া হল স্বামীজিকে! কিন্তু বিদ্বেষের যে বীজ তারা বপন করেছে, তাতে শেষ রক্ষা হবে তো?