বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
সম্পাদকীয়
 

চেনা মরণফাঁদ

সেই চেনা ছবিটা আবার ক্যামেরার ফ্রেমে উঠে এল। শুক্রবার সন্ধ্যায় হাড়হিম করা দুর্ঘটনার পর রেলমন্ত্রক ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেনা-পুলিস-দমকল-বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের কর্মীরা আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে উদ্ধার কাজে নেমে পড়েছেন। উল্টে যাওয়া, দুমড়ে যাওয়া কামরার দরজা-জানালা কেটে আটকে পড়া মৃত বা আহত যাত্রীদের উদ্ধার করা হচ্ছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। ফলে সময় যত এগচ্ছে নিহত আহতের সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। অভিশপ্ত রেলের যাত্রীদের খোঁজখবর নিতে হাওড়া স্টেশন থেকে বালেশ্বর, সর্বত্র আত্মীয় পরিজনদের থিকথিকে ভিড়। ঘটনাস্থল বাহানাগা বাজার স্টেশন যেন মৃত্যুপুরী। সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে যাচ্ছে, দেহের জন্য হাহাকার। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের বিধ্বস্ত কামরার গায়ে চাপ চাপ রক্তের দাগ, দেহের স্তূপ, ছেঁড়া জামাকাপড়, হাওয়াই চপ্পল, ব্যাগপত্র, খাবারের সঙ্গে গড়াগড়ি খাচ্ছে কবিতার খাতা। সেই কবিতার গায়ে ভালোবাসার কথা লেখা। এত বড় দুর্ঘটনা, তাই রীতি মেনে রেলমন্ত্রী শনিবার সকালে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছেই উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের কথা শুনিয়েছেন। রেলের তাবড় কর্তাব্যক্তিরা সকাল থেকে চিন্তিত মুখে এমাথা-ওমাথা চষে ফেলছেন, এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি আবার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে বৈঠকও করেছেন। ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থলে পৌঁছে সমস্তরকম সহযোগিতা করছেন। তবে এই চেনা ছবি অনেকের স্মৃতি উস্কে দিচ্ছে। কোথাও যেন অদৃশ্য মিল খুঁজে পাচ্ছেন নেটিজেনরা।
সাল ১৯৮১। বিহারের সহরসায় ঘূর্ণিঝড়ের কবলে রেলসেতু ভেঙে প্যাসেঞ্জার ট্রেন পড়ে যায় বাগমতী নদীতে। সেদিন কমপক্ষে ৫০০ জনের সলিল সমাধি ঘটে। ১৯৯০ সালে উত্তর দিনাজপুরের গাইসালে অবধ-অসম এক্সপ্রেস ও ব্রহ্মপুত্র মেলের সংঘর্ষে প্রাণ হারায় ২৮৫ জন। পাঁচ বছর পর ১৯৯৫ সালে উত্তরপ্রদেশের ফিরোজবাদে কালিন্দী এক্সপ্রেসের ধাক্কায় পুরুষোত্তম এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হলে মৃত্যু হয় ৩৫৮ জনের। ১৯৯৮ সালে পাঞ্জাবে লাইনচ্যুত ফ্রন্টিয়ার গোল্ডেন টেম্পল মেলকে ধাক্কা মারে শিয়ালদহগামী জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেস। ফল ২১২ জনের মৃত্যু। মৃত্যু কেড়ে নেয় ১৯৯৯ সালে অসমের গাইসালে মুখোমুখি সংঘর্ষে ২৯০ জনের প্রাণ। ২০০২ সালে গয়ার কাছে রফিগঞ্জে হাওড়া-দিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হলে মৃত্যু ঘটে ১৪০ জনের। ২০১০-এ মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রামের কাছে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়ে ধাক্কা মারে মালগাড়িকে। মৃত্যু হয় ১৭০ জনের। ওই বছরেই বীরভূমের সাঁইথিয়ায় উত্তরবঙ্গ ও বনাঞ্চল এক্সপ্রেসের সংঘর্ষে মারা যান ৬৩ জন। প্রায় ৩০ বছরে এই বৃহৎ আকারের রেল দুর্ঘটনাগুলিকে ঘিরে প্রতিবারই প্রচুর উদ্বেগ, বজ্রআঁটুনি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজা, উচ্চপর্যায়ে তদন্ত, রেলমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবির কথা শোনা গিয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই রেলমন্ত্রকের তরফে অজস্র প্রতিশ্রুতির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনাগুলির কিছুদিন পরেই রহস্যজনক কারণে আবার সব যেন ‘স্বাভাবিক’ হয়ে গিয়েছে! মোদি জমানায় রেলমন্ত্রকের দাবি, প্রতিবারই রেল বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। যাত্রী সুরক্ষা এবং রেললাইন ও পরিকাঠামো উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এ যেন ছেলে ভোলানো কথা। করমণ্ডলের দুর্ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। তাই অতীতকে অনুসরণ করে বলা যায়, এবারও যে তদন্ত কমিটি গঠিত হবে কিছুদিন পর তা মন্ত্রকের ঠান্ডা ঘরে চলে যাবে না তো? আমরা কি অপেক্ষা করব আরও একটা বড় দুর্ঘটনা ও তারপর মন্ত্রী-নেতাবর্গের ‘নাটক’ দেখার জন্য? সত্যিই কি যাত্রী নিরাপত্তা ও পরিষেবায় যথোচিত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? হচ্ছে কি উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার? ন্যূনতম পরিকাঠামোর উপর জোর দেওয়া হচ্ছে?
করমণ্ডলের দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে বিস্তর ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। কী করে তিনটি ট্রেন দুর্ঘটনায় জড়িয়ে পড়ল তা নিয়েই যাবতীয় ধন্দ। তবে রেল দুর্ঘটনা এড়াতে গত বছর যে প্রযুক্তি এনেছিল রেলমন্ত্রক, করমণ্ডলের দুর্ঘটনার পর তাও প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়েছে। পোশাকি নাম ‘কবচ’। একটি সংঘর্ষ বিরোধী প্রযুক্তি এটি। দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়াতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুর্ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে দাবি করেছিল রেলমন্ত্রক। শরীরে যেমন ‘কবচ’ ধারণ করলে বিপদ-আপদ কেটে যায় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন, তেমনই এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ট্রেনে থাকলে যাত্রীরা রক্ষা পাবেন বলে মনে করে মোদি সরকার। ট্রেনে এই প্রযুক্তি লাগানো থাকলে এক লাইনে দুটো ট্রেনের উপস্থিতি টের পেয়ে যাবেন চালক। তাতে আগেই সতর্ক হয়ে যাবেন তিনি। এই ‘কবচের’ আরও অনেক গুণের কথা শুনিয়েছে রেলমন্ত্রক। গত বছর কবচকে পরীক্ষায় বসানো হয়। সে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়। প্রশ্ন উঠেছে, রেলের কাছে এমন ধরনের উন্নত, ঝুঁকিহীন প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও কী করে করমণ্ডলে দুর্ঘটনা ঘটল? রেলসূত্রে খবর, শুক্রবারে দুর্ঘটনাগ্রস্ত তিনটি ট্রেনের একটিতেও ‘কবচ’ প্রযুক্তি লাগানো ছিল না। তবে যাত্রী-বাহী দুটি ট্রেনে এলএইচবি কোচ ব্যবহার করা হয়েছিল। এই ধরনের অপেক্ষাকৃত হালকা কোচ লাইনচ্যুত হলে কাপলিং আলগা হয়ে দু’পাশে ছড়িয়ে পড়ে। এই এলএইচবি বৈশিষ্ট্যই করমণ্ডলের দুর্ঘটনা ডেকে আনল কি না, এখন তার কাটাছেঁড়া হচ্ছে।

4th     June,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ