বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
সম্পাদকীয়
 

চাই মানবিক মুখ

দানা মাঝিকে মনে আছে? ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট ভোর রাতে ওড়িশার কালাহান্ডির ভবানী-পাটনার হাসপাতালে মৃত স্ত্রীকে ঘাড়ে চাপিয়ে বাড়ি ফিরতে হাঁটা শুরু করেছিলেন। সঙ্গী ছিল কিশোরী কন্যা চাঁদনি। হতদরিদ্র দানার দাবি ছিল, সারারাত হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স ও শবযানের খোঁজ করেও পাননি। বেসরকারি শবযানের মালিকও বিশাল ভাড়া হেঁকে বসেন। অগত্যা স্ত্রীকে কাপড়ে বেঁধে কাঁধে চাপিয়ে দশ কিমি পথ অতিক্রম করেন। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ওড়িশার মালকান গিরিতেও ঘটে সেই একই ঘটনা। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ছ’বছরের শিশুকন্যার মৃত্যু হয় অ্যাম্বুলেন্সে। চালক তা জানতে পেরে মাঝপথে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে দেয় পরিবারটিকে। অগত্যা অসহায় বাবা দীনবন্ধু খেমদু মেয়ের মৃতদেহ কোলে নিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরেন। গতবছর ওড়িশার সীমানা ছাড়িয়ে এমন ঘটনার সাক্ষী হয় ছত্তিশগড়ও। সেই রাজ্যের গুরগুজা জেলার ঘটনাতেও কিশোরী মেয়ের মৃতদেহ কাঁধে করে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল বাবা ঈশ্বর দাসকে। দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যি, কোনও কোনও বেসরকারি সংস্থার অমানবিকতার ‘সৌজন্যে’ যেন কালাহান্ডি কিংবা ছত্তিশগড়ের ছায়া এসে পড়ছে আমাদের রাজ্যে। মাত্র কয়েকমাস আগে গত জানুয়ারিতে জলপাইগুড়িতে মায়ের দেহ কাঁধে নিয়ে হেঁটে চলেছেন পুত্র রামপ্রসাদ—এই দৃশ্য দেখেছে বাংলা। তাঁর সঙ্গী ছিলেন বাবা জয়কৃষ্ণ দেওয়ান। এবারের অকুস্থল শিলিগুড়ির উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বর। অভিযোগ, পাঁচমাসের শিশুর মৃতদেহ আগলে সারারাত হাসপাতালে কাটানোর পর সন্তানকে একটি ব্যাগে ভরে কালিয়াগঞ্জে পৌঁছান বাবা অসীম দেবশর্মা। হেঁটে নয়, তিনি ফেরেন বাসে। কালাহান্ডি, ছত্তিশগড়, পশ্চিমবঙ্গ—প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযোগের আঙুল উঠেছে কখনও সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, কখনও বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স সংস্থা ও তার চালকদের বিরুদ্ধে। দরিদ্র অসহায় পরিবারগুলো চাহিদামতো শবযান বা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার মোটা অর্থ দিতে পারেনি বলেই এই মর্মান্তিক দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে হয়েছে গোটা দেশকে। সন্দেহ নেই, এ এক লজ্জার ইতিবৃত্ত। এমন ঘটনা বারবার চোখের সামনে চলে আসায় সব পক্ষই মর্মাহত, বেদনাহত। এই নিয়ে ঠিক-ভুল, নিয়ম-অনিয়ম, মানবিক-অমানবিকতার প্রশ্নকে সামনে রেখে চাপানউতোর রয়েছে ঠিকই, কিন্তু একটা সভ্যসমাজে এমন ঘটনা বন্ধ হবে কবে, কীভাবে—সেই প্রশ্নের উত্তর অধরা।
আরও লজ্জাজনক বিষয় হল, মাত্র আট হাজার টাকা ভাড়া দিতে অক্ষম অসহায় বাবার সন্তানের দেহ ব্যাগে নিয়ে বাড়ি ফেরার ঘটনাটি নিয়ে বিরোধী রাজনীতির কারবারিরা ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন! তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, রাজ্যটি পশ্চিমবঙ্গ। এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য পরিষেবাকে অগ্রাধিকার দেন। গরিব মানুষের জন্য নিখরচায় চিকিৎসারও ব্যবস্থা করেন। যে বা যাদের অমানবিকতার কারণে এমন একটি হৃদয়বিদায়ক ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে নিশ্চয়ই তদন্ত হবে। আশা করা যায়, বন্ধ করা হবে রোগীর পরিবারের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে বেসরকারি সংস্থার গাড়ির চালকের চড়া ভাড়া হাঁকার বিষয়টিও। কারণ তাদের এমন অমানবিকতা স্বাস্থ্য পরিষেবাকে নানা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।  এরাজ্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করতে আসা রোগী ও রোগীর পরিবারকে কেন্দ্র করে অমানবিক ঘটনার উদাহরণ মাঝেমধ্যে শোনা যায়। এনিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও পরিকাঠামো বাম আমলের চেয়ে তৃণমূল জমানায় অনেক উন্নত ও আধুনিক হয়েছে। কিন্তু প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে একটি দুষ্টচক্র সক্রিয় থাকায় পরিষেবা ক্ষেত্রে অমানবিক ঘটনা এড়ানো যাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালে একশ্রেণির দালাল রোগী ভর্তি থেকে ট্রলি ঠেলার মতো প্রায় সব কাজে ‘অর্থ’ দাবি করেন। এই কারণে যতটা না চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ ওঠে, তার চেয়ে বেশি অভিযোগ শোনা যায় এই দালালচক্রের বিরুদ্ধে। জলপাইগুড়ি বা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরের ঘটনার ক্ষেত্রেও অভিযোগ মূলত অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা নিয়ে। এর সত্য-মিথ্যা যাচাই করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। 
কিন্তু কোনও আপ্তবাক্য দিয়ে মরদেহ কাঁধে হাঁটার মতো অমানবিক দৃশ্যকে অস্বীকার করা যাবে না। এই প্রসঙ্গেই এসে পড়ে বেসরকারি হাসপাতালের কথা। প্রায়ই শোনা যায়, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসারত কোনও রোগীর মৃত্যুর পর বিলের বিপুল অঙ্ক মেটাতে পারছে না পরিবার। এসব ক্ষেত্রে মরদেহ আটকে রেখেছে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ—এমন ঘটনাও ঘটেছে এই কলকাতাতেই। এই নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বারবার ‘মানবিক’ হওয়ার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মূল প্রশ্নটা এখানেই। পদ্ধতিগত ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা চলতেই পারে। মৃত সন্তানকে বাড়ি নিয়ে যেতে অসীম দেবশর্মা ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছেছিলেন কি না—সেই প্রশ্নও তোলা যেতেই পারে। কিন্তু মৃত্যুর মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে একটি অসহায় দরিদ্র পরিবারের পাশে দাঁড়াবেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে অ্যাম্বুলেন্স বা শবযানের চালক—সভা সমাজে সেটাই সকলে আশা করে। জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ির উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরের ঘটনায় সেই সহমর্মিতার অভাব স্পষ্ট।

16th     May,   2023
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ