পরামর্শে নোভা আইভিএফ ফার্টিলিটি সেন্টারের আইভিএফ স্পেশালিস্ট ডাঃ সুপর্ণা ভট্টাচার্য
সম্প্রতি ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকশন (ইশার) এক তথ্য প্রকাশ করেছে। সেই তথ্য অনুসারে, এখন ১০-১৪ শতাংশ ভারতীয় নাগরিক ভুগছেন বন্ধ্যাত্বের সমস্যায়। শহরের প্রতি ছয় দম্পতির মধ্যে এক দম্পতি ভুগছেন ইনফার্টিলিটিজনিত সমস্যায়। এক সমীক্ষায় প্রকাশিত, পশ্চিমী দেশে যেখানে মহিলাদের মেনোপজ আসার গড় বয়স ৫২ বছর, সেখানে ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে মেনোপজ আসার গড় বয়স ৪৭ বছর! অর্থাৎ ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে ‘ফার্টিলিটি’-র হার কমে যাচ্ছে যা উদ্বেগজনক। তবে চিকিৎসক হিসেবে বলতে পারি, বর্তমানে বন্ধ্যত্বের সমস্যার জন্য পুরুষ ও মহিলা উভয়েই সমানভাবে দায়ী। এখন প্রশ্ন হল, আগের তুলনায় বন্ধ্যত্বের সমস্যা বাড়ছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, গুরুতর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের প্রভাবও পড়ছে ‘ফার্টিলিটি’তে। আধুনিক জীবনযাত্রা কীভাবে সন্তান আসার পথে বাধা তৈরি করছে—
কেরিয়ার: মেয়েদের সাধারণত ১২-১৩ বছর বয়সে মেনস্ট্রুয়েশন শুরু হয়। আর তা বন্ধ হয় মোটামুটি ৪০-৪৫ বছর বয়সের পর। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে সন্তানধারণের উপযুক্ত বয়স হল ২২ থেকে ৩০ বছর। কারণ ৩০ বছর বয়সের পর ওভামের গুণগত মানে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। তবে অনেকেই আছেন যাঁরা কেরিয়ারকে প্রাধান্য দিতে চান। আর এই কারণেই তাঁরা সন্তানধারণ করতে চান ৩৫ কিংবা ৪০ বছর বয়সের পরে! মুশকিল হল, এই বয়সে তাঁদের ওভাম দুর্বল থাকে। ফলে ভ্রূণও কমজোরি হয়। সেক্ষেত্রে বারবার মিসক্যারেজ ঘটার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই আমরা বলি, প্রথম সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করুন ৩০ বছর বয়সের মধ্যেই। অন্যদিকে, পুরুষের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রের টেনশন প্রভাব ফেলছে স্পার্মের স্বাস্থ্যে! দীর্ঘদিন মাত্রাতিরিক্ত স্ট্রেসে ভোগার কারণে স্পার্মকাউন্ট কমে যাওয়া সহ স্পার্মের সচলতা হ্রাস পাওয়ার সমস্যাও দেখা দেয়। বন্ধ্যত্বের সমস্যা তৈরি হচ্ছে এভাবেও। আর এক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, দেশের প্রধান শহরগুলিতে প্রতি ৩ জন পুরুষের মধ্যে ১ জন স্পার্ম কাউন্ট কম থাকার সমস্যায় ভুগছেন। এখানেই শেষ নয়। কেরিয়ারকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে স্বামী-স্ত্রী সঠিকভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পান না! সন্তান সুখও থাকছে অধরা!
নেশা: ধূমপান, মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান নিশ্চিতভাবে বন্ধ্যত্ব ডেকে আনে। বর্তমানে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের মধ্যে নেশা দ্রব্য সেবনের হার বেড়ে গিয়েছে, যা ওভ্যুলেশনের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্যদিকে পুরুষের মধ্যে স্পার্মকাউন্ট কমে যাওয়ার পিছনে সরাসরি ধূমপান ও মদ্যপানের প্রভাব রয়েছে।
খাদ্যাভ্যাস: হাতে সময় কম! ফলে বাড়িতে তৈরি খাবার খাওয়ার চাইতে প্যাকেটজাত ‘রেডি টু কুক’ খাবার খাওয়ার প্রবণতা আমাদের সকলেরই! অথচ এই ধরনের খাবারে থাকে প্রচুর পরিমাণে ট্রান্স ফ্যাট! এই ধরনের ট্রান্স ফ্যাট সমগ্র শরীরের পক্ষেই খারাপ। এছাড়া সময়ে পুষ্টিকর খাবার না খেয়ে অসময়ে হোটেল থেকে বিরিয়ানি, নুডলসের মতো খাবার আনিয়ে খেলে স্থূলত্ব যেমন বাড়ে, তেমনই বাড়ে হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা। এই ধরনের অসুখ স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের বন্ধ্যত্বের অন্যতম কারণ।
স্থূলত্ব: মাত্রাতিরিক্ত দৈহিক ওজন এমনিতেই সন্তানধারণের অন্তরায়। ওবেসিটির কারণে মহিলাদের শরীরে নানা ধরনের হরমোনের মাত্রার গণ্ডগোল হয়। এই হরমোনের ভারসাম্যে গণ্ডগোলের প্রভাব পড়ে ফার্টিলিটিতে। অথচ আজকাল কারও কাছেই এক্সারসাইজ করে শরীর ফিট রাখার সময় নেই! দেখা গিয়েছে, প্রায় ৪০ শতাংশ মহিলা আজকাল ওবেসিটির সমস্যায় ভুগছেন। এমনকী এও দেখা গিয়েছে, বহু স্থূলকায়া মহিলার পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (পিসিওএস) রয়েছে! প্রাকৃতিকভাবে গর্ভধারণের জন্য একটি পরিপক্ব ওভাম প্রয়োজন যা পিসিওএস-এর রোগীদের মধ্যে তৈরি হয় না। ফলে সন্তানধারণ করা সম্ভব হয় না। তবে জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে ওজন কমাতে পারলে পিসিওএস সমস্যাও কমে যায় বলে দেখা গিয়েছে।
ডায়াবেটিস ও থাইরয়েডের সমস্যা: স্থূলত্ব, কাজের চাপ, খাদ্যাভ্যাস ডেকে আনছে ডায়াবেটিসের সমস্যা। পুরুষের ক্ষেত্রে স্পার্ম কাউন্ট কমে যাওয়া, সেক্সুয়াল ডিসফাংশনের সমস্যা ডেকে আনতে পারে ডায়াবেটিস। অন্যদিকে মহিলাদের পক্ষে প্রিম্যাচিওর ওভারিয়ান ফেলিওরের সমস্যা তৈরি করতে পারে সুগার। দেখা গিয়েছে অলস, অসংযমী জীবনযাত্রার প্রভাব পড়ছে থাইরয়েড গ্রন্থিতেও। এই সমস্যাও বন্ধ্যত্ব ডেকে আনতে পারে!
বিভিন্ন দূষণ: ফসলে কীটনাশকের বিপুল ব্যবহারও শরীরে কুপ্রভাব ফেলছে। এমনকী ডেকে আনছে বন্ধ্যত্ব!
ল্যাপটপ-মোবাইল: কিছু কিছু সমীক্ষায় দাবি করা হচ্ছে, কোনও পুরুষেরই কোলে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করা উচিত নয়। কারণ ল্যাপটপ থেকে যে তাপ বেরয় তার প্রভাবে কমে যেতে পারে স্পার্ম কাউন্ট। এছাড়া পকেটে মোবাইল রাখা ও তার থেকে বেরনো তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গের প্রভাবেও স্পার্ম কাউন্ট কমতে পারে। এমনকী মহিলাদের ওভ্যুলেশনেও প্রভাব ফেলতে পারে মোবাইলের তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ। তাই ল্যাপটপ, মোবাইলের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমাতে হবে।
সমাধান কী?
আশাহত হওয়ার কিছু নেই। চিকিৎসাপদ্ধতি এখন এতটাই আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর, যে কোনও সমস্যাই আর সন্তানধারণের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। তবে হ্যাঁ, সন্তান নেওয়ার কথা মাথায় এলে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। পরিকল্পনা করে এগন। তাঁর কথা মতো জীবনযাত্রায় কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসুন। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও রুটিনে ফিরুন। দরকার পড়লে কিছু পরীক্ষা করান ও শারীরিক সমস্যা থাকলে তার চিকিৎসা করান। ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।
অনুলিখন: সুপ্রিয় নায়েক
আগে বন্ধ্যত্বর চিকিৎসায় নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। চিকিৎসা হতো ডাক্তারের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। তবে বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে অত্যাধুনিক। এখন বিভিন্ন রকম হরমোনাল টেস্ট করা হয়। চলে এসেছে বহু আধুনিক ওষুধ, যার মাধ্যমে স্পার্মের সমস্যা দূর হচ্ছে। এমনকী স্পার্মের অবস্থা খারাপ হলেও শুধুমাত্র তার হরমোনের মাত্রা ঠিক থাকলে প্রয়োজন পড়ছে না ডোনার স্পার্মের। এটা চিকিৎসার এক যুগান্তকারী ঘটনা! অপরদিকে মহিলাদের টিউব বন্ধ থাকলে আইভিএফ করা হচ্ছে। ওভারিয়ান ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এগ সংরক্ষণ করে সন্তান ধারণ করা যাচ্ছে। তাই ধৈর্য ধরে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় এখন সাফল্যের হার বেশি। তবে বয়স কম থাকতে থাকতে চিকিৎসা করালে ভালো। ডাঃ দেবলীনা ব্রহ্ম,
স্পর্শ ইনফার্টিলিটির কর্ণধার
গত ৪০-৫০ বছরে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। এখন যে কোনও দম্পতি চাইলেই সন্তান ধারণ করতে পারেন। অবশ্য মাথায় রাখতে হবে যে, বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা ম্যাজিক নয়। প্রথমবারের চিকিৎসায় সাফল্য নাও আসতে পারে। সফল হতে পরপর কয়েকবার প্রয়াস করতে হতে পারে। প্রয়োজন মতো ধাপেধাপে সাধারণ থেকে উন্নত চিকিৎসা করা হয়। চিকিৎসা হয় ওষুধ, ইঞ্জেকশন, ল্যাপারোস্কোপি ও হিস্টেরোস্কোপি এবং সহায়ক বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা (অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকটিভ থেরাপি)-র মাধ্যমে। দম্পতির প্রয়োজন অনুযায়ী এই চিকিৎসাপদ্ধতির ব্যবহার করা হয়। এখানে একটি ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকেই ভাবেন, বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা করাতে গেলেই বোধহয় আইভিএফ করা হবে। এমনটা একেবারেই নয়। চিকিৎসক বুঝেই সিদ্ধান্ত নেন। কারও ওষুধে সমস্যা কমার হলে ওষুধই দেওয়া হয়। বন্ধ্যাত্বের অত্যাধুনিক চিকিৎসা বেশ খরচ ও সময়সাপেক্ষ। সর্বশেষ কথা হল, বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা লজ্জার নয়। তাই সমস্যা হলে চিকিৎসা করান।
ডাঃ গৌতম খাস্তগীর
কর্ণধার, বার্থ ফার্টিলিটি ক্লিনিক