সৌম্যজিৎ সাহা দক্ষিণ ২৪ পরগনা: একের পর এক প্রলয় এলেও টলাতে পারেনি গোসাবার এই ডাকঘরকে। দীর্ঘ ষাট বছর ধরে একাধিক ঘূর্ণিঝড়, ফি বছরের দুর্যোগ, প্লাবনকে সহ্য করেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মাটির দেওয়াল ঘেরা ডাক অফিস। প্রকৃতি একটা আঁচড়ও কাটতে পারেনি খড়ের ছাউনি দেওয়া এই ঘরকে। যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রথমেই প্রকৃতির রোষে পড়ে গোসাবা। তছনছ হয়ে যায় গোটা দ্বীপ। নদীর জল দুয়ারে এসে ধাক্কা দেয় প্রতি বর্ষায়। আর জলোচ্ছ্বাস হলে ডুবে যায় দ্বীপাঞ্চল। একইভাবে ত্রাস সৃষ্টি করে ঘূর্ণিঝড়। বিপুল ক্ষতিকে সঙ্গী করে প্রশাসনের সহায়তায় ফের জেগে ওঠে এই দ্বীপ। দুর্যোগপ্রবণ এই দ্বীপে কীভাবে বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই ডাকঘর? এ নিয়ে রহস্যের অন্ত নেই। লোকমুখেও এই ডাকঘর নিয়ে নানা কথা প্রচলিত।
গোসাবার লাহিড়ীপুরের লাক্সবাগানে চীনের প্রাচীরের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই প্রাচীন ডাকঘর। স্থানীয় মহলে এটি ডাকঘর হলেও আসলে শাখা পোস্ট অফিস। আর পাঁচটি কাঁচা বাড়ির মতোই বাঁশ ও মাটির দেওয়াল এবং খড়ের ছাউনি দিয়ে গড়ে উঠেছে এই ডাক অফিস। অফিসের সামনে কয়েকটি বাঁশের খুঁটি পোতা। সেগুলি অবশ্য কী কাজে লাগে, কেউ জানে না। উনবিংশ শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে সুন্দরবনের প্রান্তিক এলাকার মানুষের বার্তা বয়ে চলছে এই শাখা ডাকঘর। ঠাট্টা করে অনেকেই একে জীবন্ত ফসিল বলেও সম্বোধন করেন।
গত ছ’দশকে কম দুর্যোগ দেখেনি গোসাবা। আইলা, ফনি, বুলবুল, উম-পুন, সর্বশেষ যশ— তারও আগে বিভিন্ন নামের ঘূর্ণিঝড় এই দ্বীপকে লণ্ডভণ্ড করেছে। প্রাণহানির ঘটনা যে একেবারে হয়নি, তা বলা যাবে না। তবে সম্পত্তি, ধানের জমি, বাড়িঘর নষ্ট হয়েছে প্রচুর। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও যেন পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে শাখা ডাকঘরটি। এখানকার পোস্টমাস্টার মনোরঞ্জন মণ্ডল বলেন, এত ঝড়-জল গিয়েছে, কিন্তু এই মাটির ডাকঘর ভেঙে পড়েনি। আইলার সময় দেওয়ালে সামান্য ফাটল ধরেছিল বটে, তবে তা মেরামত করা হয়েছে। যশের সময় ক্ষতি বলতে উড়ে গিয়েছিল খড়ের ছাউনির একটি অংশ। নতুন খড় বিছিয়ে ঢাকা দেওয়া হয়েছে তা। হয়তো এই এলাকায় জল জমে না বলেই টিকে রয়েছে এটি।
এই শাখা ডাকঘরের উপর নির্ভরশীল অন্তত বারো-তেরোশো মানুষ। এখানে নিয়মিত টাকা জমা ও তোলার কাজ হয়। পোস্টমাস্টারের কথায়, লাগোয়া দু’টি দ্বীপে অন্তত সাত হাজার মানুষের বাস। তাঁদের চিঠি-চাপাটিও আসে এখানে। দু’জন কর্মী নিয়ে চলে এই অফিস। ঘরটি ভাড়ায় নেওয়া। মাসে ভাড়া গুনতে হয় ১৫০ টাকা। পাকা ঘর তৈরি জন্য আবেদন করা হলেও দপ্তর তাতে সায় দেয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, গত তিন-চার বছরে একের পর এক ঘূর্ণিঝড় এসেছে। জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। তাও জলের তোড়ে ভেসে যায়নি এই শাখা ডাকঘর। আসলে এই ঘরকে স্পর্শ করে না প্রকৃতি। আজ, মঙ্গলবার ফের বিরূপ হবে আকাশ। শঙ্কা ভারী বৃষ্টির, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। স্থানীয়দের দাবি, দেখবেন, এবারও অক্ষতই থাকবে এই মাটির ডাক অফিস। সেই ডাকঘর। -নিজস্ব চিত্র