সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, বারুইপুর: সময়ের সঙ্গে অতীতের পাতায় জমিদারি প্রথা। বয়সে প্রবীণ বারুইপুরের রায়চৌধুরী জমিদার বাড়ি। শরীরজুড়ে শিরার মতো জেগে বট-অশ্বত্থ। সোনালি দিন গিয়েছে—তবু আভিজাত্যের অলঙ্কার অমলিন। পরিবারের সনাতন রীতিনীতি মেনেই আজও পালিত হয় দুর্গোৎসব। দশমীতে মা দুর্গার আগমনের বার্তা কৈলাসে পৌঁছে দিতে ওড়ানো হয় নীলকণ্ঠ পাখি।
ঐতিহ্যের বয়স সাড়ে তিনশো বছর পার। পলাশি যুদ্ধের পর পর জমিদার রাজবল্লভ রায়চৌধুরীর হাত ধরে সূচনা হয় দুর্গাপুজোর। তারপর থেকে বংশ পরম্পরায় এই পুজো হয়ে আসছে। রাসমাঠে রায়চৌধুরীদের দুর্গা দালানে এখন প্রস্তুতি তুঙ্গে। চারিদিকে সাজ সাজ রব। দালানের শরীরে পড়ছে রঙের প্রলেপ। পরিবারের সদস্য অমিয়কৃষ্ণ রায়চৌধুরীর কথায়, এই পুজো দেখতে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন। করোনা-কালে সুরক্ষা বিধি মেনে চলা হচ্ছে গত বছর থেকেই। বাধ্যতামূলক করা হয়েছে মাস্ক, স্যানিটাইজার। এমনকী, অষ্টমীর অঞ্জলির সময়ে পরিবারের সদস্যরাও সামাজিক দূরত্ব মেনেই পুজোয় যোগ দেন।
রথের দিন শুরু হয় কাঠামো বাঁধার কাজ। প্রতিমা তৈরিতেও রয়েছে পরম্পরার ছোঁয়া। কৃষ্ণনগরের ওই মৃৎশিল্পী পরিবারের সদস্য বিশ্বনাথ পাল বর্তমানে প্রতিমা নির্মাণের কাজে যুক্ত। প্রতিপদে শুরু হয় বোধন। প্রথা অনুযায়ী তিন পুরোহিত পুজো করেন। দুর্গা দালানে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত পাঁঠাবলি ও নবমীর দিন একইসঙ্গে শস্যবলিও হয়। কর্মসূত্রে পরিবারের অনেক সদস্যই এখন আমেরিকা-লন্ডন-দিল্লিবাসী। পুজোর ক’টা দিন সকলে আসেন বারুইপুরে—শিকড়ের টানে।
এই পুজোর আরও একটি আকর্ষণ—মহাষ্টমীর ভোগ। কথিত আছে, ওইদিন ভোগ খেলে সুখ-শান্তি আসে সংসারে। পরিবারের মহিলারা একসঙ্গে মহাষ্টমীর ভোগ খান। প্রতিমা বিসর্জন হয় বারুইপুরের সদাব্রত ঘাটে। রায়চৌধুরী পরিবারের প্রতিমা বিসর্জনের পর অন্য সমস্ত প্রতিমার বিসর্জন হয়। অমিয়বাবু বলেন, ‘৪০ জন বাহক খালি পায়ে প্রতিমা কাঁধে নিয়ে যান বিসর্জনে। রুপোর চামর, পাখা সহযোগে নিয়ে যাওয়া হয় উমাকে। থাকে ঢোল, কাঁসি সহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র। বিসর্জনের আগে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর প্রথাও রয়েছে। কিন্তু গত বছরে তা সম্ভব হয়নি।’ এবার কী হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি বলেও জানিয়েছেন তিনি। পাখি শেষ পর্যন্ত না উড়লেও ঢাকের তালে ইতিহাসের স্বাদাস্বাদনে তৈরি বারুইপুর।