ছোটদের তিনি কবি দাদু। তিনি রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তাঁর ছেলেবেলার অনেক মজার গল্প আছে। তিনি নিজেই তাঁর লেখা ‘ছেলেবেলা’ আর ‘জীবনস্মৃতি’ বই দু’টিতে সেই গল্প শুনিয়েছেন।
সেই রকমই কিছু গল্প আজ আমরা জানব। ছোটবেলায় ঠাকুরবাড়ির তিনটি বালক একসঙ্গে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের দাদা সোমেন্দ্রনাথ, তাঁদের বড়দিদি সৌদামিনী দেবীর ছেলে সত্যপ্রসাদ আর বালক রবি— তিনি ছিলেন এই তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট।
সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদ স্কুলে ভর্তি হলেন, ছোট্ট রবি তখনও ভর্তি হননি। তিনি তখন খুবই ছোট। রবি দেখেন, ওরা দু’জনে গাড়ি করে স্কুলে যায়, পথে কত কী দেখে। সেসব গল্প শুনে রবির মন খারাপ হয়ে যায়— সে তো একদিনও বাইরে যায়নি, গাড়ি চড়েনি। তখন স্কুলে যাওয়ার জন্য কান্না আর থামে না। বাড়ির মাস্টারমশাই কিছুতেই তাকে শান্ত না করতে পেরে চপেটাঘাত করে বললেন— ‘আজ যেমন ইস্কুলে যাওয়ার জন্য কাঁদছ— একদিন না যাওয়ার জন্য কাঁদতে হবে।’
রবীন্দ্রনাথ পরে লিখেছিলেন মাস্টারমশাই-এর কথা যে এমন সত্যি হবে— তা কি তখন জানতুম?
তোমরা জানো তো পরে রবীন্দ্রনাথ কোনওদিন স্কুলে যেতে ভালোবাসতেন না। তিনি ওরিয়েন্টাল সেমিনারি নর্মাল স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়েছিলেন। চার দেওয়ালের মধ্যে বন্ধ ঘরে বসে থেকে শিক্ষকদের বকুনি আর বেতের শাসনে স্কুল ছিল তাঁর কাছে বিভীষিকা। এ জন্যই পরে তিনি শান্তিনিকেতনে খোলা মাঠে, আকাশের তলায় ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
একমাত্র সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের একটি স্মৃতি তাঁর মনে উজ্জ্বল হয়েছিল। সেখানকার ফাদার ডি পেনেরানডার স্মৃতিকে তিনি ‘পবিত্র স্মৃতি’ বলে মনে রেখেছিলেন আজীবন। একদিন ফাদার ছাত্রদের একটি বিষয়ে লিখতে দিয়েছিলেন। সব ছেলেরা লিখছে— শুধু বালক রবীন্দ্রনাথ কিছু না লিখে চুপ করে বসেছিলেন। ফাদার কয়েকবার দেখে রবির পিঠে হাত রেখে অত্যন্ত স্নেহভরে জিজ্ঞেস করেন— ‘টেগোর, তোমার কী শরীর ভালো নাই’— এসব ক্ষেত্রে মাস্টারমশাইরা ছাত্রদের তিরস্কার করেন শাসন করেন। অনেক সময় শাস্তি দেন। কিন্তু ফাদার পেনেরানডার সস্নেহ আচরণ বালক কবিকে বিস্মিত অভিভূত করেছিল। সেই ঘটনাকে পরে তিনি এক ‘পবিত্র স্মৃতি’ বলে বর্ণনা করেছেন।
আমরা জেনেছি পরে শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে শিক্ষকরা কখনও ছাত্রদের কঠোর শাস্তি দিতেন না। রবীন্দ্রনাথ পাঠ দানের সঙ্গে স্নেহ-আদরে তাদের ভোলাতেন। ছোটবেলার বিদ্যালয়ের স্মৃতি তাঁর মনে অন্যরকম ভাবেও দেখা দিত। নিজে মাস্টারমশাই সেজে হাতে একটি ছড়ি নিয়ে বাড়ির বারান্দার রেলিংগুলোকে ছাত্র ভেবে প্রায়ই শাসন করতেন। ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন,
‘একটা কাঠি হাতে করিয়া চৌকি লইয়া তাহাদের
সামনে বসিয়া মাস্টারি করিতাম,’
কিন্তু পরে শান্তিনিকেতনে কোনওদিন কোনও ছাত্রকে শাসন করেননি। শান্তিনিকেতন সত্যিই শান্তির আশ্রয় ছিল।
ছোটবেলার স্মৃতিতে অনেকখানি জুড়ে আছে জোড়াসাঁকোর ভৃত্য মহল। ছেলেবেলায় তাঁরা থাকতেন একতলার ঘরে চাকরদের অধীনে। তিনি পরিহাস করে এই পর্বকে নাম দিয়েছেন— ‘ভৃত্যরাজকতন্ত্র’ অর্থাৎ ভৃত্য বা চাকররাই ছিল সেই মহলের রাজা। তাদের অধীনে প্রজা ছিল ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলেরা।
শ্যাম আর ব্রজেশ্বর বলে দুই ভৃত্যের গল্প শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। শ্যামের অল্প বয়স, সে খুলনার ছেলে। তার ভাষাও ছিল মজার। সে বলত ‘কুলির অম্বল’, ‘মুগির ডাল’। ছোট্ট রবিকে রামায়ণের গল্প বলে শ্যাম চারধারে খড়ির গণ্ডি এঁকে ভয় দেখাত, ‘এর বাইরে বেরিও না। তাহলে সীতার মতো রাবণ এসে ধরে নিয়ে যাবে।’ ছোট্ট রবি ভয়ে ভয়ে বসে থাকত আর শ্যাম তার দুপুরের আড্ডা দিতে বেরিয়ে যেত।
আবার ব্রজেশ্বর বা ঈশ্বর ছিল অন্যরকম। সে নাকি গ্রামের পাঠশালার পণ্ডিত ছিল। সাধু ভাষায় কথা বলত আর ছেলেদের শাসন করত। তার উপর ছিল ছোট ছেলেদের খাবারের ভার। ছোট্ট রবির স্মৃতিকথায় দেখি বারকোশ (কাঠের থালা) ভর্তি লুচি থাকলেও ঈশ্বর ছেলেদের খাওয়ার ব্যাপারে ছিল অতি কৃপণ। অনেক কষ্টে একখানা লুচি দিয়েই চলে যেত— দ্বিতীয়বার আর অনুরোধ করত না। আর বিকেলের জলখাবারের জন্য ছোট্ট রবিদের বরাদ্দ ছিল একটু বাদাম বা ছোলাভাজা। ঈশ্বর তাদের জন্য বরাদ্দ পয়সা নিজের পকেটে ভরত। আবার তার ছিল আফিমের নেশা। তাই ছেলেদের ভাগের দুধ নিজে খেয়ে নিয়ে বলত, ‘বেড়ালে দুধ খেয়েছে।’ ছোট্ট রবি বুঝেও চুপ করে থাকত।
খাওয়ার ব্যাপারে রবির দুঃখ ছিল না, কিন্তু দুঃখ ছিল অন্য ব্যাপারে। তাঁদের পোশাক পরিচ্ছদ ছিল খুব সাধারণ মানের। ঠাকুরবাড়ির উপযুক্ত দামি পোশাক তাঁরা ছোটবেলায় পরেননি। সেজন্য রবির মন খারাপ হত না, কিন্তু তাঁর আফশোস ছিল অন্য কারণে। দর্জি তাঁদের জামায় কোনও পকেট রাখত না। আর কে না জানে ছোট ছেলেদের সবচেয়ে প্রিয় তাদের পকেট, যেখানে তারা তাদের প্রিয় মার্বেল, গুলি, জমিয়ে রাখে। একটু বড় হতেই অবশ্য সে দুঃখ ঘুচে গিয়েছিল। তখন বালক রবীন্দ্রনাথের পকেটে থাকত নীলরঙের একটি ছোট খাতা। যেটিতে লেখা হতো অনেক ছড়া, কবিতা।
সে কথা বলার আগে দেখি একটু বড় হতে এই ভৃত্যদের মহল থেকে তাদের রেহাই মেলে। তখন অবশ্য তাদের শুরু হল লেখাপড়া চর্চা। সঙ্গে শরীর চর্চাও। নিয়মমতো স্কুলে না গেলেও পড়াশোনার কমতি ছিল না। ভোরবেলা পালোয়ানের কাছে ব্যায়াম— তারপর নানা রকমের পড়াশোনা। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ইতিহাস, বিজ্ঞান সব বিষয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হতো। রবির সবচেয়ে অপছন্দ ছিল সন্ধেবেলায় ইংরেজি শিক্ষার সময়টা। তিনি কৌতূকছলে বলেছেন— ‘সমস্ত দুঃখ দিনের পর সন্ধেবেলায় টিমটিমে বাতি জ্বালাইয়া বাঙালি ছেলেকে ইংরেজি পড়াইবার ভার যদি স্বয়ং বিষ্ণুদূতের উপরেও দেওয়া যায়, তবু তাহাকে যমদূত বলিয়া মনে হইবেই, তাহাতে সন্দেহ নাই।’
একদিন সন্ধ্যাবেলা মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। রবিরা তিনজন ভেবেছিলেন আজ আর মাস্টারমশাই আসবেন না। কিন্তু গলির মোড়ে হঠাৎ দেখা গেল মাস্টারমশায়ের কালো ছাতা, তখনই তিনটি বালকের আশা ভঙ্গ হল। এমন অনেক ছোট ছোট মজার গল্প ছোট রবির স্মৃতিতে লিপিবদ্ধ আছে।
এমনই একটা কৌতুককর ঘটনা— কবির দিদির ছেলে সত্যপ্রসাদ মাঝে মাঝে রবিকে ভয় দেখিয়ে ডাকত— পুলিসম্যানকে। ছোট্ট রবি পুলিসের নাম শুনেই ভয়ে লুকিয়ে পড়ত। তার নিরাপদ আশ্রয় ছিল অন্দরমহলে মার ঘরে। জননী সারদাদেবী ছোট ছেলেটিকে কাছে ডেকে নিতেন। তার ভয় পাওয়া কচি মুখটি দেখে তাঁর মায়া হতো।
আগেই বলেছি, একটি নীল ছোট খাতাতে চলত তাঁর পদ্য লেখা। অল্পবয়সি দাদা সোমেন্দ্রনাথ ছোট ভাই রবির কবিতার গুণমুগ্ধ ছিলেন। সকলকে ডেকে ভাইয়ের কবিতা শোনাতেন। স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের কাছেও সে খবর পৌঁছে গিয়েছিল। এমন একটি কবিতা ছোটদের খুব প্রিয় ছিল, হয়তো তোমরাও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালে লেখা এই কবিতাটি পড়েছ।
‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি তাহাতে কদলী দলি
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ
পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।’
একবার ছোট্ট রবির শখ হল গাছ পুঁতবে। কোথা থেকে আতার বীজ এনে রান্নাঘরের পাশের মাটিতে তা পুঁতে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে কখন আতা গাছে আতা ফলবে।
অতি উৎসাহে প্রতিদিন জল দিয়েও শেষ পর্যন্ত গাছ হল না। ছোট্ট রবি আতা গাছের শোকে মুহ্যমান রইল কিছুদিন।
আসলে ছোটবেলায় ভৃত্য মহলে একতলার ঘরে বন্দি শিশু রবির কাছে জানলা দিয়ে দেখা বাগানের টুকরো ছবি ছিল মনোরম। সেই বাগানের প্রতিটি গাছের সঙ্গে ছিল তাঁর মিতালি। ‘জীবনস্মৃতি’-তে সেই বাগানের একটি প্রাচীন বট গাছের কথা বলেছেন। বড় হয়ে স্মৃতি-দূরবিনে চোখ দিয়ে সেই গাছকে দেখে লেখেন—
‘নিশিদিন দাঁড়িয়ে আছ মাথায় লয়ে জট
ছোটো ছেলেটি মনে কি পড়ে, ওগো প্রাচীন বট’
প্রকৃতির সঙ্গে বাল্যকাল থেকেই ছিল তাঁর বন্ধুত্ব। সেই প্রকৃতিমগ্ন মানস পূর্ণ প্রকাশিত হল তাঁর স্বপ্নের বাসভূমি শান্তিনিকেতনে। অনেক অনেক বাল্যস্মৃতি তাঁর লেখাতে পড়ে আমরা মুগ্ধ হই। যিনি একদিন বিশ্ব জয় করবেন কবিতা লিখে, তাঁর ছোটবেলা ছিল নানা রসে কৌতুকে পূর্ণ। তখন তো তিনি বিশ্বকবি হননি। তখন তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য— শিশু রবি, পরে বিশ্ববন্দিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
একদিন বটগাছকে নিয়ে মনে মনে কবিতা লিখত যে শিশু, আবার একদিন আতার বীজ পুঁতে যে ছোট্ট ছেলেটি গাছের স্বপ্ন দেখত, সে বড় হয়ে তার সাধের শান্তিনিকেতনে গাছপালার শ্যামল ছায়ায়, বনে বনান্তরে প্রকৃতির ছায়ায় জীবন কাটিয়েছে। শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলায় প্রার্থনারত তাঁর সেই দেবমূর্তিতে আমাদের প্রণতি নিবেদন করি।