রোগীর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিত? পেশাদার, খিটখিটে নাকি হাসিখুশি, বন্ধুর মতো? উত্তর দিলেন এই সফ্টস্কিলে পারদর্শী দু’জন চিকিৎসক— প্রফেসার ডাঃ অরুণাভ সেনগুপ্ত ও ডাঃ যোগীরাজ রায়।
প্রশ্ন: রোগীর সঙ্গে ডাক্তারের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত?
অরুণাভ: ৪০ বছর এই পেশায় রয়েছি। আমার মনে হয়, ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হওয়া উচিত।
যোগীরাজ: আমার ধারণা রোগী ও ডাক্তারের মধ্যে পেশাদার সম্পর্ক হওয়াই ভালো।
প্রশ্ন: রোগীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা কেন জরুরি?
অরুণাভ: রোগীরা অনেক আশা নিয়ে আসেন ডাক্তারের কাছে। চিকিৎসকদের ঈশ্বরতুল্য মনে করেন অনেকে। তা ভেবে তাঁরা অনেক মনের কথা বলতে আরম্ভ করেন। তখন যদি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলা হয়, তাড়াতাড়ি বলুন। তাহলে কখনওই রোগী খোলামেলাভাবে নিজের সমস্যা সম্পর্কে বলতে পারবেন না। আর তা না জানতে পারলে ডাক্তারের পক্ষে তাঁকে সরিয়ে তোলা সম্ভব হবে না। ভালো ব্যবহার ৮০ শতাংশ কাজ করে দেয়।
যোগীরাজ: একজন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কোনও মানুষ তো সচরাচর দুর্ব্যবহার করেন না, এটাই তো আমাদের শিক্ষা। একজন রোগী আমার থেকে পেশাদার সাহায্য নিতে আসছেন, তাঁকে সাহায্য করাই আমার কাজ। একজন পেশাদার চিকিৎসক কখনওই রোগীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন না। অনেক ডাক্তার রাশভারী, মুডি হন। বাড়ির লোক অনেক সময় একই কথা বারবার বলতে থাকেন। এতে ডাক্তাররা বিরক্ত হন। তাই অনেক সময় চিকিৎসকের ব্যবহার খারাপ লাগে। তবে ইচ্ছাকৃত খারাপ ব্যবহার কেউ করেন না। একটা সমস্যা অনেকক্ষেত্রে হয়, ডাক্তারবাবু কী বলছেন, রোগী বুঝতে পারেন না। কমিউনিকেশন গ্যাপ তৈরি হয়। এই সমস্যাটা দূর করতে পারলে রোগী ও তাঁর পরিবার খুশি হন।
প্রশ্ন: ভালো ব্যবহার কি রোগ সারাতে পারে?
অরুণাভ: রোগীর প্রতি ডাক্তারের ব্যবহার যদি ভালো হয়, সেক্ষেত্রে এমনিতেই সিংহভাগ রোগ সেরে যায়। কারণ তাতে রোগীকে বুঝতে সুবিধা হয়। ভালো ব্যবহারের পাশাপাশি প্রয়োজন রোগীকে সময় দেওয়া। আর ভালো ব্যবহার করলে মানসিকভাবেও রোগী অনেক আশ্বস্ত থাকেন। ভাবেন ভরসাযোগ্য কেউ সঙ্গে রয়েছেন। রোগী এলেই যদি ধাতানি দেওয়া হয় তাহলে রোগী নিজের সমস্যা জানাতে সঙ্কোচ বোধ করবেন। বন্ধুর মতো আচরণ হলে মন খুলে সব কথা বলতে পারেন।
যোগীরাজ: আমি এমন অনেক চিকিৎসককে চিনি, যাঁরা পেশেন্টের পরিবার যেমন চাইছেন সেভাবে চিকিৎসা করেন। এমন ভালো ব্যবহারে কতখানি লাভ হয় আমার জানা নেই। প্রথমত পুরো কাজটাই পেশাদার ভঙ্গিতে করা উচিত। সবার আগে বুঝতে হবে যে রোগী আমার কাছে এসেছেন, তাঁর আদৌ আমাকে প্রয়োজন নাকি অন্য কোনও বিভাগের ডাক্তারকে দরকার। তারপর তাঁকে সঠিকভাবে চিকিৎসা করতে হবে। রোগীর পরিবারের প্রতি ভালো ব্যবহার অবশ্যই থাকবে, তবে তা যেন সত্যি জানানোর অন্তরায় না হয়। রোগীর যে সমস্যা হয়েছে, তা সরাসরি জানিয়ে রাখতে হবে। ইমোশনের পরিবর্তে এক্সপ্রেসিভ হওয়াই ভালো। ডাক্তারিতে আবেগের কোনও জায়গা নেই। তবে কীভাবে খারাপ কথাটা বলবেন, সেটাও জানা দরকার।
প্রশ্ন: রোগীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় থাকলে কি দুর্ঘটনা পরবর্তী ঝঞ্ঝাট এড়ানো সম্ভব?
অরুণাভ: কোনও রোগী এলে তাঁর পরিবারকে ভালো করে বোঝানো দরকার আসল সমস্যা কোথায়। কোনও আশ্বাসবাণী নয়। পেশেন্ট পার্টিকে সরাসরি সত্যিটা বলা উচিত। তাহলেই ডাক্তারও মার খান না আর রোগীও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন। রোগী দেখাতে এলেই যদি তাড়াহুড়ো করা হয়। যদি বলি, যাও, যাও, ওষুধ দিয়ে দিয়েছি। তাহলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই থাকে। তাই ভালো ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।
যোগীরাজ: অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগী পরিবারের রাগ ক্যারি ফরওয়ার্ড হয়। ধরা যাক, আমার আগে যিনি ডিউটি করে গিয়েছেন, তিনি কোনও গণ্ডগোল করেছেন। সেই রাগটা আমার উপর এসে পড়ে। এবার ওই পরিস্থিতিতে যাঁকে সামলাতে হচ্ছে, তিনিও পুরো বিষয়টা জানেন না। এতে সমস্যা তৈরি হয়। ওই সময় মাথা ঠান্ডা রেখে রোগীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সমস্ত প্রবলেম হয় কমিউনিকেশন গ্যাপের জন্যই।
প্রশ্ন: রোগীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা কি পেশাগত এথিক্সের বিরোধী নয়? কাজের ক্ষেত্রে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দেয় নিশ্চয়ই?
অরুণাভ: না, না। রোগী যখন আসবেন, মনে করা উচিত নিজের আত্মীয়। বাড়ির লোকের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করা হয়, তেমনই ব্যবহার করা উচিত। তাতে রোগী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা অনেক স্বস্তি পান। আমি তো মনে করি, এটাই পেশাগত এথিক্স হওয়া উচিত। তবে আবেগপ্রবণ হওয়া চলবে না। খোলাখুলি রোগের কথা জানাতে হবে রোগী বা তাঁর পরিবারকে। আর কঠোর সিদ্ধান্ত যদি নেওয়ার থাকে, তাহলে নিতেই হবে।
যোগীরাজ: ডাক্তারের উপর মানসিক প্রভাব অবশ্যই ফেলে। অনেক চেষ্টার পর যদি রোগীকে বাঁচানো সম্ভব না হয়, তাহলে খারাপ লাগে। ব্যক্তি জীবনেও প্রভাব ফেলে। বিষয়টা হল রোগী দেখে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মানসিকভাবে সেটা ভুলে যাওয়াই উচিত। এটা আমার কাজ, এখানে আবেগের কোনও জায়গা নেই।
প্রশ্ন: রোগীর সঙ্গে কেমন ব্যবহার, এটা তো একটা সফ্টস্কিল। বর্তমানে শেখানো হয় অনেক প্রতিষ্ঠানে। আপনাদের সময় এমনটা ছিল না। আত্মস্থ করেছেন কীভাবে?
অরুণাভ: আমরা রোজ প্রায় ১ হাজার রোগী দেখি। দূরদূরান্ত থেকে আসেন কত আশা নিয়ে। আর আসার সঙ্গে সঙ্গে যদি ডাক্তারের থেকে খিটখিটে ব্যবহার পান, তাহলে ওঁর মনে খারাপ প্রভাব পড়বে। দু’মিনিট রোগীর কথা শুনে তারপর ওষুধ প্রেসক্রাইব করাই ভালো। অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে এই স্কিলগুলিও বাড়ে। আমার ছাত্রদেরও এটাই শেখাই। রোগীর সঙ্গে ব্যবহারই সবথেকে বড়।
যোগীরাজ: রোগীর সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে, ঝামেলার সময় কীভাবে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে— এই স্কিলগুলো নিজেকেই আত্মস্থ করতে হয়। অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে শিখতে হয়। তবে এই বিষয়গুলি নিয়ে চর্চা খুব কম হয়। মেডিক্যাল ওয়ার্কশপ হওয়া উচিত এগুলির উপর।