হয়ত আপনি নতুন বাড়িতে সবে উঠে এসেছেন। কিন্তু যে জল আসছে, তার স্বাদ ভালো নয়। তার ওপর দেখছেন যে সাদা বেসিনে লাল দাগ পড়ছে, সাদা জামাকাপড় কাচার পরেও লাল দাগ। অর্থাৎ, আপনি বুঝলেন যে জলে আয়রন সল্ট আছে। এই সমস্যা আপনার একার নয়। কলকাতার চারপাশের অনেক আবাসনেই এই সমস্যা। বিশেষ করে যাদের বোরওয়েল করে বাড়িতে জল তোলা হয়, তাদের এই সমস্যা বেশি। বেসিনে বা মেঝেতে পড়া লাল দাগ না হয় ঘষে দিলে উঠে যাবে। কিন্তু এই জল যে আপনি রোজ পান করছেন, তার শারীরিক প্রভাব কী? আপনাকে কী অবিলম্বে আয়রন ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসাতে হবে না কী এই জল পান করা নিরাপদ? এই নিয়েই আজকের আলোচনা।
জলে আয়রন সল্ট ফেরাস বা ফেরিক, এই দুই রূপে থাকতে পারে। ফেরিক সল্ট রূপে থাকলেই তখন আপনার জলের কলসি, বালতি, বেসিন সবের মধ্যে লাল তলানি জমা হয়। ফেরাস সল্ট জলে দ্রবীভূত হয়ে যায়। চোখে দেখে বোঝা যায় না। সামান্য আয়রন খাবার জলে থাকলে খুব যে ক্ষতি হয়, তা নয়। কিন্তু জলে একটা মেটালিক স্বাদ আসে, যেটা অনেকের সহ্য হয় না। এই জল দিয়ে রান্না করলে অনেক সবজির মধ্যেই কালো কালো দাগ পড়ে এবং স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। এটা দেখে অনেকের খাবার ইচ্ছে চলে যায়।
এখানে প্রশ্ন হতেই পারে যে ভারতে মানুষের শরীরে আয়রনের অভাব এত বেশি দেখা যায়। তাহলে যদি খাবার জলে একটু বেশি আয়রন থাকে, ক্ষতি কী? এর ফলে শরীরে তো বেশি আয়রন ঢুকতে পারবে! কিন্তু এই খাবার জলের আয়রনে লাভ খুব বেশি হয় না। এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থাকে ফেরিক সল্ট রূপে। এই সল্ট সহজে হজম হয় না। আর আমাদের এখানে যে ভাত, সবজি ইত্যাদি সারাদিন খাওয়া হয়, তাতে ফাইটেট বা অক্সালেট নামক নানারকম রাসায়নিক থাকে যেগুলি এই আয়রনের সল্টের শোষণ আটকে দেয়। ফলে জলের আয়রন পেটে ঢুকলেও রক্তে আর প্রবেশ করতে পারে না। বরং খাবার জলে এরকম অতিরিক্ত আয়রন থাকলে পাকস্থলীতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং বমি বমি ভাব হতেই পারে।
যাদের হিমোক্রোম্যাটোসিস নামক অসুখ রয়েছে, তাদের এরকম অতিরিক্ত আয়রন যুক্ত জল খেলে শরীরে আয়রনের পরিমাণ অতিরিক্ত হয়ে গিয়ে লিভারের সমস্যা হতে পারে বা ত্বকের রঙ কালো হয়ে যেতে পারে। এই রোগ বিরল, কিন্তু যাদের আছে, তাদের কিন্তু এই ধরনের জল পান করা একদম বারণ।
আয়রন সল্ট বেশি খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হতে পারে। কেউ যদি দিনের পর দিন এই সমস্যায় ভোগেন, তাহলে এর থেকে অর্শ, ফিসার ইত্যাদি নতুন অসুখ দেখা দিতে পারে। যদি নতুন কোন জায়গায় গিয়ে (যেমন কলকাতা থেকে কোন গ্রামে বদলির পর) আপনার এরকম সমস্যা শুরু হয়, তাহলে চিকিৎসা করানোর সঙ্গে এটাও দেখুন যে আপনার খাবার জলে আয়রন বেশি আছে কি না। এটা যদি হয়, তাহলে সেই দিকটির দিকে নজর না দিলে অন্য সব ওষুধ খেয়েও কিন্তু সমস্যা পুরো মিটবে না।
আর সবশেষে আর একটা তথ্য জানা উচিত। আমাদের শরীরে এরকম অনেক ব্যাকটেরিয়া আছে যাদের খাদ্য হল আয়রন। এইসব ব্যাকটেরিয়া যত আয়রন সল্ট পাবে, তত এদের বংশবৃদ্ধি হবে। যদি রোজ আপনার পানীয় জলে আয়রন সল্ট থাকে, তাহলে পেটের মধ্যে এইসব ব্যাকটেরিয়া কিন্তু দ্রুত সংখ্যায় বাড়বে। এর থেকে নানারকম সংক্রমণ হতেই পারে। অথবা আপনার অন্য কোন সংক্রমণ যদি থাকে, তাহলে পেটে অতিরিক্ত আয়রন গেলে কিন্তু সেইসব ব্যাকটেরিয়া আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। হয়ত আপনার বার বার নানা সংক্রমণ হচ্ছে; আপনি বার বার অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সংক্রমণের উৎস না বুঝতে পারলে সমাধান হবে না।
সুতরাং পানীয় জলে অতিরিক্ত আয়রন ভালো নয়। যদি আপনার সন্দেহ থাকে, উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ দিয়ে জল পরীক্ষা করান। তারপর যদি তাতে অতিরিক্ত আয়রন পাওয়া যায়, তখন জলের উৎস পরিবর্তন করতে হবে।