গল্পের পাতা

অতীতের আয়না: হারিয়ে যাওয়া হাড়গিলে পাখি
অমিতাভ পুরকায়স্থ

নিউ মার্কেটের পূর্ব ও পশ্চিম গেটের একটু উপরের দিকে সবুজ বৃত্তাকার জায়গাটার দিকে কখনও নজর করেছেন? খেয়াল করলে দেখবেন একটি এমব্লেম বা প্রতীক। কলকাতা পৌরসংস্থার এই মোহরচিহ্ন শহরের প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। এই সাবেক প্রতীকের মধ্যে সারস গোত্রের দু’টি পাখিকে চিনতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু সঠিকভাবে পাখিগুলির পরিচয় আজ হয়তো অনেকেই বলতে পারবেন না। কারণ উনিশ শতকেও কলকাতার অন্যতম পরিচিতি এই ‘হাড়গিলে’ আর তাদের দেখা যায় না। হাড়-গিলে খেয়ে হজম করার গুণ থেকে নাম হলেও ঔপনিবেশিক শহরের পুর পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল হাড়গিলে।
কলকাতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের পাওয়া যায় মিসেস ফ্যানি পার্কসের ডায়েরি থেকে। ১৮২২ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার ময়দানে সকাল-সন্ধ্যা ভ্রমণের সময় হাড়িগিলেদের ঝাঁক তাঁরও নজরে পড়েছিল। মেমসাহেব লিখেছেন যে, প্রায়ই  লাট সাহেবের বাড়ির গেটের মাথায় সিংহের মূর্তির উপর হাড়গিলেদের সার বেঁধে বসে থাকতে দেখতেন। তার মনে হতো যেন সিংহের মতন পাখিগুলোও বাড়ির স্থাপত্যের অঙ্গবিশেষ। জেমস ফ্রেজার বেইলির জলরঙে আঁকা কলকাতার দৃশ্য থেকে তৈরি করা লিথোগ্রাফ সহ বিভিন্ন প্রাচীন ছবিতে শহরের অলিখিত ম্যাসকট হিসেবে হাড়গিলে পাখির উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের চোখ এড়ায় না।  
অবশ্য এই শহরে হাড়গিলের সচিত্র ডকুমেন্টেশন আরও পুরনো। ১৭৭৩ সালে কলকাতার তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে যোগ দিলেন স্যর এলিজা ইম্পে। মিসেস মেরি ইম্পে কয়েক বছরের মধ্যেই এদেশীয় নানা পশুপাখি জোগাড় করে গড়ে তুললেন এক বড় চিড়িয়াখানা। তারপর এদেশের গুণী কয়েকজন মিনিয়েচার চিত্রকরকে নিয়োগ করলেন সেই সব জীবজন্তুদের বাস্তবানুগ ছবি আঁকার জন্য। মিসেস ইম্পের ছবির সেই অ্যালবামে জায়গা করে নিয়েছিল একটি হাড়গিলের ছবি, যেটি এঁকেছিলেন শেখ জায়েন-উদ-দিন।
বিশ্রাম নেওয়ার সময় বাড়ির উঁচু ছাদে হাড়গিলেদের নিশ্চল উপস্থিতি বিদেশিদের লেখায় বারবার ফিরে এসেছে। ১৮৩৭ সালে প্রকাশিত নিজের স্মৃতিকথাতেও এমা রবার্টস এই কথা উল্লেখ করেছেন। তার সঙ্গে তিনি আরও জানিয়েছেন যে, হাড়গিলের লেজের নীচের দিকের সাদা পালক গুচ্ছ ইংল্যান্ডে বা ফ্রান্সে মেসসাহেবেদের কাছে ‘ফ্যাসন এক্সেসারি’ হিসেবে ছিল বেশ মূল্যবান। তবে যারা এই পালক বিক্রি করত, তারা বলতে চাইত না যে পালকগুলি পাখির শরীরের ঠিক কোন অংশ থেকে সংগৃহীত।  পাছে সঠিক তথ্য জানলে পরিচ্ছন্নতা প্রিয় মেমসাহেবের কাছে পালকের দাম কমে যায়!  
বর্জ্য খায় বলে অশুচি বিধায় নাগরিকরা বাড়ির ছাদে এসে মাথায় ও ঘাড়ে পালকহীন এই বৃহদাকার পাখিদের বসাটা পছন্দ করতেন না। অন্যদিকে, পুর পরিষেবায় তাদের সহায়তার কারণেই এই পাখি ধরা বা মারা ছিল আইনত নিষিদ্ধ। তবুও বাড়ির ছাদে বসলে চোরাগোপ্তা পাখির পালক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটত, যা হয়তো মেমসাহেবদের পোশাকের শোভা বাড়াত। ডানা ভাঙা এক হাড়গিলে পাখির রাজভবনে গিয়ে নিজের অবস্থা দেখিয়ে নালিশ জানানোর খবর বেশ সরসভাবে প্রকাশিত হয়েছিল  ৯.৬.১৮৫৩ তারিখে ‘সংবাদ প্রভাকরে’র পাতায়।   
আসলে শহরের পুর পরিষেবা শুরুর দিনগুলিতে আবর্জনা অপসারণের অপ্রতুল ব্যবস্থা থেকে এই পাখির বিচরণ ভূমি হয়ে উঠত শহরের নানা জায়গায় পড়ে থাকা জঞ্জালের স্তূপ। মহেন্দ্রনাথ দত্ত তার স্মৃতিকথায় নিমতলা শ্মশানেও শকুনের সঙ্গে হাড়িগিলে পাখি বসে থাকার কথা বলেছেন। সর্বভূক এই পাখির ময়লা খেয়ে জঞ্জাল অপসারণে সহায়তার জন্যই শহরের পুরসংস্থার প্রতীকেও স্থান পায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে দু’টি সাপকে ঠোঁটে ধরে রয়েছে দু’টি হাড়গিলে। সঙ্গে রয়েছে সিংহ, রাজমুকুট ও জাহাজ সহ ব্রিটিশ রাজকীয় চিহ্ন। 
১৮৯৬ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের জন্য এই প্রতীক বা ‘কোর্ট-অব-আর্মস’ সরকারিভাবে জারি করা হলেও সাধারণ মানুষের কাছে তার আগে থেকেই শহরের ঔপনিবেশিক প্রশাসন পরিচালিত কর্পোরেশন ও হাড়গিলে ছিল সমার্থক। ১৮৯৪ সালের মিনার্ভা থিয়েটারে অভিনয়ের জন্য রচিত ‘সভ্যতার পাণ্ডা’ প্রহসনে গিরিশচন্দ্র ঘোষ ‘হাড়গিলে কমিশনার’ নামে এক চরিত্র এঁকেছিলেন। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে কমিশনার জানাচ্ছেন যে, তাঁর ‘হাড়গিলে’ নাম হয়েছে সাহেবদের এঁটো হাড়-গিলে গিলে। আর তাঁর নিবাসস্থল ট্যাক্সের বিলে ও জীবনের উদ্দেশ্য ছিল ভোটে জিতে কমিশনার হয়ে ‘রেয়োতের’ হাড়-মাস খাওয়া।  
হাড়গিলে পাখিকে ইংরেজিতে বলা হয় অ্যাডজুটেন্ট স্টর্ক বা অ্যাডজুটেন্ট বার্ড। ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত সেঞ্চুরি ডিকশনারিতে হাড়গিলে পাখির ছবি সহ এই ইংরেজি নামের উৎপত্তি নির্দেশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে অ্যাডজুটেন্ট বলা হতো সামরিক বাহিনীর নির্দিষ্ট পদের অফিসারদের।  পাখিটির হাঁটার মধ্যে সামরিক কর্মীর চলার ধরনটি লক্ষ করেই হয়তো এদেশে প্রথম এসে ইংরেজরা পাখিটির এই নাম দিয়েছিল।    
জনপদগুলি যত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে জঞ্জাল মুক্ত হয়েছে, ততই হাড়গিলের খাবার ও বাসস্থানে টান পড়েছে। ফলে বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকেই সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া থেকেই তাদের সংখ্যা কমতে থাকে। আজ সারা দুনিয়াতেই তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন। ঘটনার সেই পরম্পরায় বহু জায়গার মতো এই শহরের আকাশ থেকেও একদিন হাড়গিলে পাখিরা একেবারেই মুছে গেল। শহরের পুরনো ইতিহাসের মতো হাড়গিলের অস্তিত্ব রয়ে গেল কিছু প্রাচীন নথি আর এই নিউ মার্কেটের গেটের উপর কর্পোরেশনের পুরনো প্রতীক চিহ্নের মধ্যে। 
6Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

ধর্মকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণে মানসিক তৃপ্তি ও সামাজিক সুনাম। পেশাদার শিল্পীদের শুভ সময়।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৮.২৫ টাকা১১১.৮০ টাকা
ইউরো৯০.৭১ টাকা৯৩.৮৮ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা