ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে রাজস্থানের আলোয়ার জেলার ভানগড়ে তৈরি হয় একটি কেল্লা। যেটি তৈরি করেছিলেন অম্বরের তখনকার রাজা ভগবন্ত দাস। পরবর্তীকালে তাঁর ছোট ছেলে মাধো সিং কেল্লাটির দখল নেন। মতান্তরে মাধো সিং-ই এই দুর্গ তৈরি করিয়েছিলেন। মাধো ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মান সিংয়ের ছোট ভাই। পাশাপাশি তিনি নিজেও আকবরের সভায় দেওয়ান ছিলেন।
কেল্লার মূল দরজা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইতিহাস। দুর্গের মূল প্রবেশদ্বার ছাড়াও আছে লাহোরি গেট, আজমেরি গেট, ফুলবাড়ি গেট ও দিল্লি গেট নামে একাধিক প্রবেশ পথ। ভিতরে রয়েছে গণেশ মন্দির, গোপীনাথ মন্দির, হনুমান মন্দির, সোমেশ্বর মন্দির, কেশব রায় মন্দির, মংলা দেবী মন্দির, নবীন মন্দির। আরও আছে রাজপ্রাসাদ, নৃত্যশিল্পীদের প্রাসাদ, পুরোহিতের বাসভবন এবং বাজার, বাগান। রয়েছে জলাধার। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ‘বউলি’। শোনা যায়, নির্মাণশৈলীর জন্য কেল্লার ভিতরের কোনও শব্দ বাইরে যেতে পারে না। যদিও কেল্লার অনেকাংশেই এখন ধ্বংসস্তূপ। আর বিদ্যুৎবিহীন জমাট অন্ধকারে কেল্লায় ভৌতিক পরিবেশ যেন আরও জাঁকিয়ে বসেছে। অনেকেই নাকি জলাধার সংলগ্ন এলাকা থেকে নূপুরের শব্দ, ফিসফিসানি শুনতে পেয়েছেন। কিন্তু কেল্লার কোনও শব্দ বাইরে শুনতে পাওয়ার কথা নয়। যদিও এসব তর্ক বিতর্কের মধ্যেও ভানগড় নিয়ে কৌতূহল বা শিহরণ এতটুকু কমেনি।
কেল্লার ভৌতিক কর্মকাণ্ডের সূত্রপাত নিয়ে দু’টি কাহিনি লোকমুখে বেশ প্রচলিত। প্রথম কাহিনি অনুযায়ী, মাধো সিং যখন কেল্লা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন তখন তাঁকে নিষেধ করেন সাধু গুরু বালুনাথ। যাঁর আশ্রম ছিল কেল্লা চত্বরেই। তিনি জানান যে, মাধো সিং কেল্লা তৈরি করতেই পারেন, কিন্তু কোনওভাবেই যেন সেই কেল্লার ছায়া, তাঁর আশ্রমের উপর না পড়ে। এই শর্ত লঙ্ঘন হলে এই কেল্লা সহ গোটা রাজপরিবারে নেমে আসবে অন্য ছায়া— বালুনাথের অভিশাপ। ভয়ই হোক বা শ্রদ্ধাবশতই হোক মাধো সিং সাধু বালুনাথকে শর্ত রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যদিও রাজার উত্তরসূরিরা এই শর্ত রক্ষায় ব্যর্থ হয়। দেখা যায় দিনের একটা সময়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও কেল্লার ছায়া পড়ছে আশ্রমের উপর। তারপর যা হওয়ার তাই হল, গুরু বালুনাথের প্রবল আক্রোশে কেল্লা সহ গোটা ভানগড় ধ্বংস ও জনশূন্য হয়ে গেল। আজও ভানগড় এলাকায় দেখা যায় সেখানকার যে অবশিষ্ট মহল বা বাড়ি রয়েছে তাঁদের দেওয়াল থাকলেও কোনওটির ছাদ নেই। স্থানীয়দের মতে, সাধু বালুনাথ চাইতেন না এই এলাকায় কোনও বসতি গড়ে উঠুক, তাই তিনি সমস্ত বাড়ির ছাদ ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। ভানগড়ের অন্য কাহিনির চরিত্র রাজকন্যা রত্নাবতী। অপরূপা রত্নাবতীর মোহে পড়েছিলেন এলাকারই এক তান্ত্রিক সিঙ্ঘিয়া। যেনতেনপ্রকারেণ তিনি রত্নাবতীকে পেতে চেয়েছিলেন। রাজকন্যা তাঁর প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে তান্ত্রিক অন্য উপায় অবলম্বন করেন। তিনি সুগন্ধির সাহায্যে রাজকন্যাকে বশ করার চেষ্টা করেন। তাঁর মতলব ছিল জাদু সুগন্ধির বশীভূত হয়ে তাঁর টানে রাজকন্যা এসে আত্মসমর্পণ করবেন। কিন্তু রাজকন্যা সিঙ্ঘিয়ার কু-মতলব বুঝতে পেরে সেই জাদু সুগন্ধির বোতল পাথরে ছুড়ে মারলে জাদুর প্রভাবে সেই পাথরটি সিঙ্ঘিয়াকে পিষে হত্যা করে। যদিও মৃত্যুকালে সেই তান্ত্রিক রাজকন্যাকে হুঁশিয়ারি দিয়ে যান যে, তিনি এর প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বেন।এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই ভানগড়ের সঙ্গে আজবগড়ের যুদ্ধ শুরু হয়। সিঙ্ঘিয়ার অভিশাপ ফলতে দেরি হয়নি। ভানগড়ের মানুষ সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করলেও শেষমেশ আজবগড়ের সেনাবাহিনীর হাতে পর্যদুস্ত হন। প্রাণ হারান রাজকন্যাও। প্রায় দশ হাজার মানুষের বসতিপূর্ণ ভানগড় যুদ্ধের পর পরিণত হয় পরিত্যক্ত ভূতুড়ে শহরে। জনশ্রুতি, তান্ত্রিকের অভিশাপেই ভানগড়ের এই পরিণতি। ওই কেল্লায় আজও নাকি তান্ত্রিক সহ আরও অনেক অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায়। যারা ভানগড়ের অতন্দ্র প্রহরী। পুনর্জন্মের পর একদিন রাজকুমারী রত্নাবতী ফিরবেনই। তাঁর হাতে ভানগড়ের শাসনভার ফিরিয়ে দিয়ে তবেই তাঁদের মুক্তি। যদিও যুক্তিবাদীদের মতে, দুর্ভিক্ষের প্রকোপেই রাজ্যটির এমন দশা হয়েছিল। এরপর পেরিয়ে গিয়েছে বহু সময়, কিন্তু ভানগড় আছে ভানগড়েই। এখনও ভৌতিক, অলৌকিক শিহরন মিশ্রিত জনশ্রুতিতে কেল্লা চত্বরের হাওয়া ভারী হয়ে থাকে। এখানে ভিড় জমান দেশি বিদেশি বহু পর্যটক। খোদ ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র তরফে জারি করা নির্দেশিকা অনুযায়ী, ভানগড় এলাকায় সূর্যাস্তের পর এবং সূর্যোদয়ের আগে প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। সঙ্গে রয়েছে আরও নানা নির্দেশিকা। যা অমান্য করলে প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। অনেক পর্যটকেরই ভানগড়ে গিয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে শোনা যায়। দেখতে না পেলেও তাঁরা নাকি অশরীরীর উপস্থিতি অনুভব করেছেন। এমনকী, স্থানীয় বাসিন্দারা দিনের আলো থাকতে থাকতেই এই কেল্লার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করেন। যদিও ভানগড় নিয়ে নিষেধাজ্ঞা ও রহস্যময় জনশ্রুতি মানুষের আকর্ষণকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এই কেল্লার অভিশপ্ত তকমাকে আরও মজবুত করে তুলেছে। অবশ্য, অলৌকিক জনশ্রুতি ছাড়াও এখানে রয়েছে আরাবল্লী পর্বত, সরিস্কা ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কেন্দ্র, দুর্গের প্রাচীন স্থাপত্য। ইতিহাস-ঐতিহ্য-মিথ-প্রকৃতির মিশেলে বহুলচর্চিত এই অঞ্চলের আকর্ষণ যে অপ্রতিরোধ্য, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তাই ভানগড় আজও ইতিহাস হয়েও জ্বলন্ত বর্তমান।