বিপুল মজুমদার: ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হিসাবে আজকের সকালটা বিজনের প্রথম সকাল। দুশো চল্লিশ স্কোয়ার ফিটের ছোট্ট এক পরিসরের মধ্যে ক্রমাগত ঘুরপাক খেতে খেতে এর মধ্যেই যেন হাঁপিয়ে উঠেছে বিজন। চার দেওয়াল, দরজা জানলা, ঘরের আসবাব সব একেবারে ঘাড়ের উপরে! সবচেয়ে বেশি বিরক্ত লাগছে সিন্দুকটাকে দেখে। পায়া ভেঙে একদিকে কাত হয়ে রয়েছে জিনিসটা। ওটা না থাকলে পশ্চিমের দেওয়ালটা দিব্যি খালি পাওয়া যেত। বাথরুমে যাতায়াতের জন্য বারবার ঠোক্কর খেতে হতো না। মাঝে মাঝে নিজের উপর খুব রাগ হয় বিজনের। দাদাদিদিদের মতো সেও কেন ধান্দাবাজ হতে পারল না! জন্মসূত্রে পাওয়া ছাদ মাথার উপর থেকে সরে যাবে জেনেও কেন সে চুপ করে থাকল। শুরুতেই কেন সব ভেস্তে দিল না আপত্তি জানিয়ে। সদ্য কেনা ওয়ান বিএইচকে ফ্ল্যাটের একমাত্র জানলাটার সামনে দাঁড়িয়ে সহসা নিজেকে বড্ড অসহায় লাগল বিজনের। পুরনো হলেও পিতৃপুরুষের ভিটেবাড়িটা বিশ্বস্ত একজন সঙ্গীর মতো তার সঙ্গে যেন লেপটে ছিল। বাড়ির গাছগাছালি, পাড়া প্রতিবেশী, এমনকী সামনের সরু গলিটাও তাকে ঘিরে রাখত সর্বক্ষণ। কিন্তু এখানে যে সে পুরো একলা! বড়দা সুজন কেন্দ্রীয় সরকারের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার। তো সেই দাদা যেদিন দিদি চন্দনাকে সঙ্গে নিয়ে এসে বাড়ি বেচার কথাটা উত্থাপন করেছিল সেদিন বেশ ভ্যাবাচ্যাকাই খেয়ে গিয়েছিল বিজন। শুরুটা দাদাই করেছিল, ছেলেকে বেসরকারি কলেজে ডাক্তারি পড়াতে গিয়ে ওর নাকি গলদঘর্ম অবস্থা। চাপ সামলাতে ইমিডিয়েট ওর দশ লাখ টাকার ভীষণ প্রয়োজন!
দিদি চন্দনাও আরেকরকমের গাওনা গাইল, বড় মেয়ের ছেলে হয়েছে। নাতির ভবিষ্যতের জন্য দিদি চায় নাতিকে দশ লাখ টাকা ফিক্সড করে দিতে!
এরপরেই মোদ্দা কথাটায় এল ওরা, বিজন যদি দু’জনকে ওই নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকাটা দিতে পারে তাহলে কোনও সমস্যা নেই। নিজেদের অংশ হাসিমুখে ওরা লিখে দেবে ভাইকে। নইলে বাড়ি বেচে ভাগের টাকা ওরা বুঝে নেবে!
তেত্রিশ বছর বয়সে এসে আজও বিজন থিতুহীন। স্কুল সার্ভিস কমিশনের চাকরিটা দুর্নীতির নাগপাশে বিশ বাঁও জলের নীচে তলিয়ে গেছে। কবে হবে তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। প্রাইভেট টিউশনের গোনাগুনতি টাকায় কোনওমতে দিন গুজরান হয় তার। এই অবস্থায় বিশলাখ টাকা সে কোথায় পাবে! সেকথা স্পষ্ট করে বলতেই ভুরু কুঁচকে ছিল সুজনদা, ‘তাহলে বাড়ি বেচা ছাড়া গতি নেই!’ বিজন হতবাক। বিস্ময় কাটতেই আমতা আমতা করে বলেছিল, ‘তাহলে আমার কী হবে! কোথায় যাব আমি?’
দাদা বোধহয় প্লট সাজিয়েই এসেছিল, ‘একলা মানুষ তুই। ভাগের যা টাকা পাবি তাই দিয়ে এক কামরার ফ্ল্যাট একখানা কিনে নিবি। ব্যস, প্রবলেম খতম!’
ঝগড়াঝাঁটি বরাবরই অপছন্দের বিষয় বিজনের। আর করলেই বা পাত্তা দিচ্ছে কে! দাদা দিদিরা যে মরিয়া! বিনা বাক্যব্যয়ে তাই ওদের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল বিজন। কিন্তু বাড়ির অস্থাবর সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারার প্রশ্নে গোল বেঁধে গেল পুরনো সিন্দুকটাকে নিয়ে। সেগুন কাঠের মস্ত সিন্দুকটা আজকের নয়, ঠাকুরদার বাবার আমলের। জিনিসটার সঙ্গে ইতিহাসের একটা যোগসূত্রও রয়েছে। সেসবকে গুরুত্ব না দিয়েই দাদা বলেছিল, ‘যত সব ফালতু আবর্জনা!
বেচে দে কাউকে।’
বিজন রাজি হয়নি। সাবেক পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামে ছিল বিজনদের পূর্বপুরুষের ভিটে। তখন ব্রিটিশ আমল। বিজনের প্রপিতামহ বার্মা থেকে আনা খাঁটি সেগুন কাঠ দিয়ে সিন্দুকটাকে তৈরি করিয়েছিলেন। বিজনের ঠাকুরদা কাঞ্চনের বয়স সবে আঠারো তখন। সেইসময় চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের একখানা পিস্তল লুকিয়ে রাখার দায়িত্ব বর্তায় তাঁর উপরে। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত না হলেও ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর অনুরোধে দায়িত্বটা ঘাড়ে নেন কাঞ্চন। কাপড়ে জড়িয়ে পিস্তলটাকে তিনি লুকিয়ে রাখেন সিন্দুকের মধ্যে। একমাত্র মা কিশোরীবালা ছাড়া বাড়ির আর কেউ জানতেন না সেই গোপন খবর।
কিন্তু ক’দিন বাদে বিপদ এসে হাজির হল দোরগোড়ায়। গোপনসূত্রে খবর পেয়ে পুলিস এসে হানা দিল বাড়িতে! যখন পুলিস এল বাড়িতে কিশোরীবালা আর তাঁর দু’বছরের শিশুকন্যাটি ছাড়া কেউ ছিল না। ছেলেকে বাঁচাতে তাই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন কিশোরীবালা। অস্ত্রটাকে সিন্দুক থেকে বার করে ঢুকিয়ে দিলেন মেয়ের কাঁথার মধ্যে। তারপর কাঁথাসমেত মেয়েকে বুকে জড়িয়ে দরজা খুললেন
আলতো হাতে। বাড়িতে ঢুকে সারা বাড়ি চষে ফেলল পুলিস। ঘেঁটে দেখল সিন্দুকটাকেও। তল্লাশির সময়টায় মেয়েকে স্তন্যপান করানোর অছিলায় ঘোমটা টেনে ঘরের এক কোণে ঠায় বসে ছিলেন কিশোরীবালা। শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েই ফিরে গিয়েছিল ব্রিটিশ পুলিস। সেই ঘটনার পর থেকেই দত্ত পরিবারে আলাদা একটা মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত হয়েছিল সিন্দুকটা। দেশভাগের পর তাই সর্বস্ব ছেড়েছুড়ে চলে এলেও সিন্দুকটাকে সঙ্গে করে আনতে ভোলেননি বিজনের প্রপিতামহ। এদেশে আসবার পর বৃদ্ধ মানুষটা একটা কথা প্রায় বলতেন, এ সিন্দুক লক্ষ্মী! যার কাছে এটি থাকবে
সে রাজা! পরবর্তীকালে বিজনের ঠাকুরদা কাঞ্চনও সেই একই বুলি আউড়াতেন। বিজনের বাবা অঞ্জন ছিলেন একজন বেহিসেবি মানুষ। টাকাপয়সা ওড়ানো নিয়ে বাপের সঙ্গে হামেশাই তার বিবাদ লেগে থাকত। সিন্দুকটার ব্যাপারে বাপের আদিখ্যেতা দেখে খুব হাসাহাসিও করতেন অঞ্জন। একদিন ছেলের বিদ্রুপে অতিষ্ঠ হয়ে রাগে ফেটে পড়লেন বিজনের ঠাকুরদা। ছেলেকে বললেন, আগামী পয়লা বৈশাখেই পর্দা ফাঁস করব এই সিন্দুক রহস্যের! শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেই পর্দা ফাঁস করা আর হয়ে ওঠেনি। পয়লা বৈশাখের দু’দিন আগেই হার্ট অ্যাটাকে হঠাৎ মারা যান বৃদ্ধ।
এককালে বাড়ির মেয়েদের গয়নাগাটি আর পোশাক আশাকের আশ্রয়স্থল ছিল এই সিন্দুকটা। বর্তমানে মায়ের কিছু শাড়ি আর পুরনো কাগজপত্র ছাড়া তেমন কিছুই আর নেই ওখানে। তো এমন একটা দুঃস্থ আসবাবের ব্যাপারে দাদা-দিদিদের যে কোনও আগ্রহ থাকবে না তা বলাই বাহুল্য। দাদা বলেছিল, ‘হাল ফ্যাশানের ফার্নিচার এনে ফ্ল্যাট সাজিয়েছি। সেখানে এসব মান্ধাতা আমলের জিনিস একেবারেই বেমানান। বেচতে যখন এতই অনীহা তখন ওটাকে বরং তোর কাছেই রাখ।’
দিদিরও একই বক্তব্য, ‘আমার বাপু ‘রাজা’ ‘রানি’ হওয়ার সাধ নেই! তুই একা মানুষ, তুই রাখ।’
অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার আগে ফ্ল্যাটের মাপজোক দেখে বিজন একটা বুদ্ধি ঠাউরেছিল। সিন্দুকটার উপর প্লাইউডের একটা টুকরো পেতে পরে খাওয়ার টেবিল হিসেবে ওটাকে ব্যবহার করবে। কিন্তু ভ্যানচালকদের বোকামির জন্য সেই ভাবনা আর টিকল কই! মালপত্র আনার সময় সিন্দুকটার একটা পায়া কী করে যেন ভেঙে ফেলেছে ভ্যানচালকরা। আর তার দরুন একদিকে হেলে পড়েছে জিনিসটা। গতকাল বিকেলে পরিচিত এক কাঠের মিস্ত্রিকে ফোন করেছিল বিজন। ভদ্রলোক বলেছে আজ আসবে। যদি না আসে তাহলে কাল রাতের মতো আজও তাকে মেঝেতে বসেই খেতে হবে। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দে ঘোর কাটল বিজনের। কাঠের মিস্ত্রি ভেবে দরজা খুলতেই দেখল উল্টোদিকে হাসি হাসি মুখ করে টুসি দাঁড়িয়ে। গত রাতে ফোন করেছিল টুসি। বলেছিল, নতুন ফ্ল্যাট দেখার জন্য একদিন সে আসবে। কিন্তু সেই একদিনটা এত জলদি কেন! গত তিন বছর ধরে এই মেয়েটার কাছ থেকে এন্তার ধার নিয়েছে বিজন। ফেরত দেয়নি কানাকড়িও। টুসিও অবশ্য মুখ ফুটে কখনও কিছু বলেনি। ডায়েরির হিসাব মোতাবেক টাকার অঙ্কটা ছাব্বিশ হাজার ছুঁইছুঁই প্রায়। বাড়ি বেচার খবর পেয়ে তবে কি আজ সেই টাকা ফেরত চাইবে টুসি! ফ্ল্যাট কেনার পরেও ভাগের টাকার সামান্য কিছু অংশ বিজনের হাতে রয়ে গেছে এখনও। কিন্তু সে টাকা তো বেনারস যাওয়ার জন্য বিজন তুলে রেখেছে। অজানা আশঙ্কায় গলাটা তাই ওর কেঁপে উঠল, ‘ও... তুমি!’
বিজনের মতো টুসিও একজন প্রাইভেট টিউটর। একটি মেয়েকে তারা দু’জনেই পড়ায়। বিজনের সাবজেক্ট বাংলা টুসির ইংরেজি। ছাত্রীটির এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে দু’জনের আলাপ। সেই আলাপ গত তিন বছরে টুসির আগ্রহেই একটু একটু করে পল্লবিত হয়ে বন্ধুত্বের পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। আগামী দিনে সেটা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বিজন জানে না। নিজের ছন্নছাড়া অবস্থার জন্য জানার তেমন ব্যাকুলতা নেই ওর। টুসির বাবা নেই। মা পেনশনার। বিজনের তুলনায় টিউশনের বাজারও অনেক ভালো টুসির। তাই বিপদভঞ্জন বন্ধুটিকে তোয়াজে রাখার জন্য বিজন গলে পড়ল, ‘এসো এসো, ভেতরে এসো।’
আজ টুসিকে একটু অন্যরকম লাগছে। বেশিরভাগ সময় শাড়ি পরলেও আজ পরেছে চুড়িদার। ভেতরে ঢুকেই ভেতরে থাকা সিন্দুকটার দিকে চোখ গেল ওর। জিনিসটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মাথা ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, ‘সত্যি তারিফ করবার মতোই জিনিস বটে। তা বেচারাকে চিকিৎসা না করিয়ে ফেলে রেখেছ কেন?’
টুসিকে কাঠের মিস্ত্রির কথাটা জানিয়ে লাজুক হাসল বিজন, ‘ঘরে চেয়ার পাতার জায়গা নেই। তাই খাটেই তোমাকে বসতে হবে টুসি।’ টুসি বসল না। ঝাঁকি মেরে এদিক সেদিক খানিক দেখার পর বলল, ‘ছাত্রীর বাড়িতে পড়াতে গিয়ে শুনলাম, আগামী মাসে তুমি নাকি বেনারস যাচ্ছ?’ ধারের টাকা যদি চেয়ে বসে সেই ভয়ে টুসিকে কিছু জানায়নি বিজন। কিন্তু ছাত্রী সব বলে দিয়েছে বুঝে বিজন ঢোঁক গিলল, ‘আমার দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন করার ইচ্ছের কথাটা তো তুমি জানো। সুযোগ মিলতেই ভাবলাম যাই প্রথম অভিযানটা সেরেই আসি।’
‘শুনলাম টিকিটও নাকি কেটে ফেলেছ?’
‘হ্যাঁ... ইয়ে মানে... পরশু কেটেছি। ফ্ল্যাট কেনার পর সামান্য যা বেঁচেছিল তাই দিয়ে...।’ কথাটা বলেই আলমারির কাছে পৌঁছে গেল বিজন। আলমারি খুলে বের করে আনল ট্রেনের টিকিটটাকে। তারপর টুসির দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘একলাই যাচ্ছি। সেকেন্ড ক্লাস স্লিপারের কনফার্ম টিকিট। দেখ।’
অন্যমনস্কভাবে টিকিটটা নিতে গিয়ে হাত ফস্কাল টুসি। কাটা ঘুড়ির মতো লাট খেয়ে টিকিটটা গিয়ে পড়ল মেঝেতে। তারপর ফ্যানের হাওয়ার তাড়নায় পরক্ষণেই সেটা সেঁধিয়ে গেল সিন্দুকের নীচে!
মেঝে আর সিন্দুকের মাঝখানে ইঞ্চি দুয়েকের মতো ফাঁক। টিকিটটা অনেক ভেতরে ঢুকে গেছে। পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরে মুখটাকে কাঁচুমাচু করে ফেলল টুসি, ‘ইস, আমার বোকামির জন্যই...!’ ‘ডোন্ট ওরি’ বলে ঘরের ফুলঝাড়ুটাকে নিয়ে এল বিজন। চেষ্টা করল ঝাড়ুটার সাহায্যে টিকিটটাকে টেনে বার করে আনতে। কিন্তু বেয়াদপ টিকিটটা মেঝের সঙ্গে একেবারে যেন চিপকে গেছে। বিজনের এই কর্মকাণ্ডের মধ্যেই কাঠের মিস্ত্রির আগমন ঘটল। দরজা ঠেলে ভদ্রলোককে ঢুকতে দেখেই ব্যাকুল হয়ে বিজন বলে উঠল, ‘ফ্যানের হাওয়ায় আমার রেলের টিকিটটা সিন্দুকের তলে ঢুকে গেছে। কী করা যায়
বলুন তো দাদা?’
মাঝবয়সি মিস্ত্রি ভদ্রলোক আড়চোখে টুসিকে একনজর দেখে বলল, ‘পায়াটাকে সারাতে হলে তো সিন্দুকটাকে ওল্টাতেই হবে। সবাই মিলে হাত লাগালে মনে হয় হয়ে যাবে কাজটা।’ সবাই মিলে মানে কি টুসিকেও ধরেছে লোকটা! বিজন বিব্রত। ওকে ভ্যাবলার মতো তাকাতে দেখে হেসে ফেলল টুসি, ‘ঘাবড়াচ্ছ কেন! বাইরে রোগা হলেও মানসিকতায় আমি কিন্তু দারোগা!’
অবশেষে তিনজনের মিলিত চেষ্টায় কাত করে মেঝেতে শোয়ানো গেল সিন্দুকটাকে। আর পরক্ষণেই যা নজরে পড়ল তাতে চক্ষু চড়কগাছ তিনজনেরই। উপর দিকের মতো সিন্দুকের নীচেও অনেকগুলো খোপ! এবং প্রত্যেকটা খোপই কাঠের ঢাকনা দিয়ে দৃঢ়ভাবে আটকানো। বিজনের নির্দেশে কাঠের মিস্ত্রি লোকটা সেই ঢাকনাগুলির একটাকে খুলতেই বিস্ময়ে চোখ কপালে গিয়ে ঠেকল সকলের। বিজন তো ‘ও মাই গড’ বলে মেঝেতে ধপ করে বসেই পড়ল। পুরো খোপটাই নানা ডিজাইনের সোনার হার আর লকেটে ভর্তি! এরপর আরেকটাকে খোলা হলে সেখানেও দেখা গেল একই দৃশ্য। অসংখ্য সোনার কানের দুলে থিকথিক করছে সেই খোপ! সিন্দুকটার নীচে মোট ছ’খানা খোপ। কাঠের মিস্ত্রি এরপর তৃতীয় খোপটা খুলতে গেলে হাত তুলে ভদ্রলোককে থামাল বিজন। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘থাক, আর খুলে কাজ নেই।’
ভদ্রলোকের চোখেমুখে অপার বিস্ময়, ‘আপনি তো গুপ্তধন পেয়ে গেলেন দাদা! দুটোতে যা মাল রয়েছে, সবকটা খুললে পঞ্চাশ লাখ ছাড়িয়ে যাবে!’
বিস্ময়ে থ টুসিও। মিস্ত্রির কথা শেষ হতেই উল্লাসে ফেটে পড়ল সে, ‘তোমার প্রপিতামহ ঠিকই বলেছিলেন, এ সিন্দুক যার কাছে থাকবে সে রাজা। তুমি এবার সত্যিই রাজা বিজন। উফ, আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে!’
স্নায়বিক উত্তেজনায় হাতের আঙুলগুলো তিরতির করে কাঁপছে বিজনের। বুকের নীচে অবিরাম ধড়াস ধড়াস। টুসির ঝলমলে মুখের দিকে তাকিয়ে সে ভাবল, আর্থিক সম্পদে বলীয়ান হলেই কি রাজা হওয়া যায় নাকি! রাজাকে এক অর্থে যে আমজনতার ভালোবাসার মানুষও হতে হয়। কিন্তু সে, আমজনতা তো দূর, প্রেম প্রত্যাশী একজন মেয়ের ভালোবাসার মানুষ হয়ে উঠতেও পারল না। টাকা ধারের গোপন ধান্দায় মেয়েটিকে অহেতুক দূরে দূরে রেখে দিল!
বিজন তাই দ্রুত মনস্থির করে নিল। টিউশন সম্বল জীবনে সাহস করে এতদিন যে কথাটা বলে উঠতে পারেনি এবার সে সেই কথাটাই বলবে। কাঠের মিস্ত্রি বিদায় নিলেই টুসিকে বলবে, ‘বাবা বিশ্বনাথের পর বাকি এগারোটা জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন করার সময় তুমি কি আমার সঙ্গী হবে টুসি? আমার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে যাবে কি তুমি আমার সঙ্গে?’