‘মনখারাপ যখনই হবে, গঙ্গার ঘাটে চলে আসবি।’ ফোকলা দাঁতের একগাল হাসি নিয়ে বলেছিল জটাবাবা। সে কত্তোদিন আগের কথা! তখনও বাবার হাত ছাড়ার বয়স হয়নি। মনখারাপের কীই বা বুঝি! জটাবাবা অবশ্য বুঝত। শুধু বুঝত না, জট পাকানো দাড়ি থেকে উকুন বাছতে বাছতে নানা প্যাঁচ-পয়জারও বাতলে দিত। সেই সবের টানে কবে যে বাবার হাত ছেড়ে একা একা হাজির হয়ে গিয়েছিলাম গঙ্গার ঘাটে, সেই তারিখ আর মনে পড়ে না। মনে পড়ে শুধু জটাবাবার সেই ফোকলা হাসি।
বাড়ি থেকে একটা অটোর দূরত্বে কুটিঘাট। সেই এতটুকু বয়স থেকে এ নামই জানি। পরে অবশ্য কেউ একটা ভারিক্কি গলায় বলে দিয়েছিল, ‘ওরে ওটা কুঠিঘাট! জানিস না, এখানে একটা ডাচ কুঠি আছে।’ এই ডাচটা কে আবার? খুদে মনে প্রশ্নটা জেগে উঠেই গঙ্গার জলে ঘটি ডোবার মতো ভুস করে ডুবে গিয়েছিল। কারণ, স্বাভাবিক কুঠিটা পোড়ো আর কে না জানে পোড়োবাড়িতেই যত রাজ্যের ভূতের বাস। ওসবের থেকে জটাবাবাই ভালো। তখন অবশ্য অটো চড়ার মতো বড়লোক হইনি। হন্টনই ভরসা। অটো অবশ্য জুটত যেদিন পারিবারিক গন্তব্যস্থল হতো বেলুড়। বেলুড় যাওয়ার ভটভটিতেই এক মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে আলাপ। তিনিই নতুন করে চেনালেন আমার কৈশোরের আকর্ষণ এই ঘাটটিকে। শুনে অবাক হয়েছিলাম, এই যে সাইডে বাসি ফুল-বেলপাতা-শ্রাদ্ধের মালসার পাহাড়ওলা ঘাটটা নাকি গোটা কলকাতার সমস্ত গঙ্গার ঘাটের থেকেও বেশি পুরনো। সেই সপ্তদশ শতাব্দীর। শুনে তো ব্যোমকে গিয়েছি। হতভম্ব হাল দেখে তো পুরো ইতিহাসের ক্লাসই নিয়ে নিলেন সেই মাস্টারমশাই। ডাচ মানে ওলন্দাজ। তারা আসলে হল্যান্ড... না, না নেদারল্যান্ডসের লোক। ব্যবসা করতে সেই সুদূর ইউরোপ থেকে নাকি এসেছিল এই বরানগরে। সেই ব্যবসার কাজেই নাকি বানানো হয় কুঠিঘাট। মানে ওরা নাম দেয়নি, কুঠির ঘাট বলতে বলতে লোকই এই নাম দিয়ে ফেলেছে। এই ঘাট পুরোদমে চালুর নাকি আরও ২০-২৫ বছর পর সুতানুটির ঘাটে পা রেখেছিলেন জব চার্নক। কলকাতা তখনও স্বনামধন্য নয়। আরও কিছু হয়তো বলতেন মাস্টারমশাই, কিন্তু ততক্ষণে বেলুড়ের জেটিতে আলতো ধাক্কা খেয়ে গিয়েছে ভটভটি। আর আমিও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।
পুরোপুরি যে বেঁচেছিলাম, তা নয়। গঙ্গার ঘাট ব্যাপারটা কখন যে আস্তে আস্তে মনের কোণে জায়গা করে নিয়েছে, সেটা বুঝতে কয়েক বছর লেগেছিল। ক্লাস নাইন, পাখনা গজাবার বয়স। স্কুল কাট মেরে এঘাট সেঘাট করা তো বয়সের ধর্ম নাকি! ছোট একটা দলও ছিল। আর সাইকেল। ব্যস, দিব্যি কেটে যেত ফুরফুরে দুপুর। ততদিনে জটাবাবাও নেই। কুঠিঘাটের টানও হারিয়ে গিয়েছে। সুতরাং স্কুল কাট মারলেই গন্তব্য দুটো—প্রামাণিক ঘাট নইলে রতনবাবু। মাঝে আস্ত মহাশ্মশান। প্রামাণিক ঘাটটা আমার আবার একেবারেই পছন্দ নয়। কেমন একটা ঝুপ্পুস অন্ধকার থাকে দিনের বেলাতেও। ঢোকার মুখে শহিদ বেদি। এদিকে বাড়ির দেওয়াল, ওদিকে পোড়ো একটা মন্দিরমতো। মাঝ দিয়ে মোটামুটি প্রশস্ত সিঁড়ি। খোলামেলা ব্যাপারটাই নেই। তবে ইতিহাস আছে। ওখানে একটা দারুণ চায়ের দোকান আছে। দোকানদারের মন গল্পে যতটা আছে, ব্যবসায় তেমন নেই। মজাই লাগত। দোকানের পাশের একটা পুরনো বাড়ির চাতালে বসে শুনতাম, এ রাস্তার দু’ধারে শাণ্ডিল্য গোত্রের দে-প্রামাণিক গন্ধবণিকদের বাস ছিল। এরা নাকি সব বর্ধমানের লোক। সে যাই হোক, ওই বংশের দুর্গাপ্রসাদ ও রামগোপাল দে-প্রামাণিক নাকি ১৮০০ শতকের মাঝামাঝি এই ঘাট তৈরি করেছিলেন। আর সেই ঘাটের উপরে পোড়ো বাড়িটা নাকি প্রেমনাথ মল্লিকের অট্টালিকা। এসব নাকি কোনও বইতে লেখা আছে।
পরে যতদূর জেনেছি, ওই একই সময়ে কাশীপুর শ্মশানঘাট তৈরি হয়। এখানেই দাহ করা হয়েছিল রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে। তাঁর পঞ্চমুণ্ডির আসনটি তো এখনও সযত্নে সংরক্ষিত। নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির শেষকৃত্যও হয়েছে এই ঘাটে। ছোটবেলায় এখানে দিনের বেলাতেও কেমন গা ছমছম করত। এখন অবশ্য তার চেহারাই বদলে গিয়েছে। তবে সেই স্কুলজীবনে সবথেকে প্রিয় ঘাট বলতে আমরা যা বুঝতাম, শ্মশানের দক্ষিণে রতনবাবুর ঘাট। চওড়া ঘাট। গোটা বরানগরের বিসর্জন হয় এই ঘাটে। ঢোকার মুখে থাম-দেউড়ি, পুরো চকমিলান ব্যাপার। পাশেই জেটি, ভটভটি-স্টিমার এখন যেমন চলে, আগে চলত না। স্কুলকাট মারার কালে ওটাই ছিল আমাদের একনম্বর আড্ডাখানা। কিন্তু কে এই রতনবাবু? রাস্তার নামও তাঁর নামে। ওই রাস্তায় এক বন্ধুর বাড়ি যাতায়াত সূত্রে শুনেছি, রতনবাবুর পুরো নাম নাকি রামরতন দত্তরায়। যশোরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নড়াইল জমিদার বংশের সন্তান। ওই রাস্তার ধারেই তাঁদের বিশাল অট্টালিকার এখনও দেখা মেলে। পরে রাধারমণ মিত্রের ‘কলকাতা দর্পণ’ পড়ে জানতে পারি, রতনবাবুর প্রতিষ্ঠা করা এই ঘাটও নাকি ওই ১৮৫০-’৬০ নাগাদ তৈরি।
গোটা স্কুলজীবনটাই এমন ঘাটে ঘাটে কাটিয়ে ফেলার মজা আজকের ইংরেজি মিডিয়ামরা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে কি না সন্দেহ! সাইকেলের সিট যত লম্বা হয়েছে, তত প্যাডেল গড়ানোর পালা বেড়েছে দূরে। রতনবাবু ছেড়ে কাশীপুর চিত্তেশ্বরী মন্দির, গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে গিয়ে সর্বমঙ্গলা ঘাট। সেখানে বসা তেমন যেত না। পাশে বাঁশের সিঁড়ি দিয়ে নামাওঠা করত ঘুষুড়ির ভুটভুটি। সেই নৌকায় যাতায়াত প্রায় প্রাণ হাতে করে যাওয়ার শামিল। এক সময় গোটা এলাকায় ছিল ডাকাতের রাজত্ব। এই ঘাটেরও চল নাকি সেই সময় থেকে। এই এলাকায় পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহের পুত্রবধূ রানি দেবেন্দ্রবালার নামে একটি ঘাট আছে। তার ইতিহাস ক’জন জানেন সন্দেহ!
কলকাতার ইতিহাস নিয়ে যত বই আছে, সেখানে অন্তত শ’দুয়েক গঙ্গার ঘাটের কথা বলা হয়। তার মধ্যে সবথেকে বড় যে তিনটি ঘাটের কথা আমরা সবাই জানি, সেগুলি বাবুঘাট, প্রিন্সেপ ঘাট, উট্রাম ঘাট। সেগুলি অনেক বড় হয়ে যাওয়া। স্বাভাবিক, ওপথে যে সাইকেলে যাওয়া যায় না। তবে ইতিহাস এগুলোরও বড় কম নয়।
জানবাজারের বাবু রাজচন্দ্র দাসকে আমরা তেমন না চিনলেও, তাঁর স্ত্রীর কথা জানে না, এমন বাঙালি পাওয়া ভার! তিনি রাসমণি দেবী। সেই রাজচন্দ্র ১৮৩০ সনে তৈরি করেছিলেন একটি ঘাট, যা আজ বাবুঘাট নামে বিখ্যাত। বিখ্যাত হলেও সবসময় এখানে নোংরা জমে থাকে। তাতে অবশ্য নামডাক কমে না। পুরসভার নথি নাকি বলে রাজচন্দ্র চৌরঙ্গি থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত একটা পাকা রাস্তাও তৈরি করে দিয়েছিলেন। প্রথমে সেটির নাম ছিল বাবু রাজচন্দ্র রোড। পরে যা বদলে হয় অকল্যান্ড রোড। সেই রাস্তারই আজকের পরিচয় রানি রাসমণি রোড। রাজচন্দ্র আরও একটি ঘাট বানিয়ে ছিলেন। হাটখোলার ঘাট। সেটা শোভাবাজারের কাছে।
এই বাবুঘাটের দক্ষিণে উট্রাম ঘাট। এখান থেকে নাকি রেঙ্গুনের জাহাজ ছাড়ত। ইংরেজ সেনাপতি জেনারেল উট্রামের স্মৃতিতে এই নামকরণ। একইভাবে প্রিন্সেপ ঘাটের নাম রাখা জেমস প্রিন্সেপের নামে। ১৮১৯ সালে ২০ বছর বয়সে কলকাতা টাঁকশালের চাকরি পেয়ে কলকাতা এসেছিলেন এই সাহেব। তবে তিনি ইতিহাসে রয়ে যাবেন সম্রাট অশোকের লিপির পাঠোদ্ধারকারী হিসেবেই। কলকাতার আরেক প্রাচীন ঘাটের নাম পুরনো কেল্লার ঘাট। ফেয়ারলি প্লেসের সামনেই। আর আছে এসব ছাড়িয়ে চাঁদপাল ঘাট। ১৭৬০ সনের আশপাশে তৈরি হওয়া এই ঘাটে নাকি ছিল চন্দ্রনাথ পাল নামে এক মুদির দোকান। মাঝিমাল্লারা সেখান থেকেই খাবার-দাবার কিনত। সেই মুদির নামই সাহেবসুবো এবং আম জনতার মুখে মুখে চাঁদপাল হয়ে উঠতে দেরি নেয়নি। অন্তত এমনই বলেন কলকাতা বিশেষজ্ঞরা। সত্যি মিথ্যে জানি না বাপু! আজকাল এখানে ভিড় লেগে থাকে। কিন্তু যাদের গত শতাব্দীর আট-কিংবা নয়ের দশকে জন্ম, তাঁদের কাছে এসব স্বপ্নই ছিল। এসব কথা মনে করলে আজও মনখারাপ গ্রাস করে। সতীদাহ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, বাবু বাঙালি থেকে আজকের টিকটক প্রজন্ম—কত জল গড়িয়ে গিয়েছে এই গঙ্গা দিয়ে। নীরব সাক্ষী জলের স্রোত। তবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে ঘাটের নাম কোনওদিন ভুলতে পারবে না, তার নাম, মল্লিক ঘাট। এর ঠিক পাশেই সম্ভবত এশিয়ার বৃহত্তম ফুলের বাজার। ঘিঞ্জি, কাদা প্যাচপ্যাচে রাস্তার এই ঘাটের অবস্থা নাকি এরকম ছিল না। ১৮৫৫ সালে কলকাতার বাবু নয়নচাঁদ মল্লিকের ছেলে রামমোহন মল্লিক এটি তৈরি করেছিলেন। কোনও এক সময় লাল রংও করা হয়েছিল। সেই রং কবে হারিয়ে প্রায় গুদাম গোটা ঘাটটি।
মল্লিক ঘাটের পাশেই গোয়েঙ্কা ঘাট। পুরো নাম ‘রামচন্দ্র গোয়েঙ্কা জেনানা বাথিং ঘাট’। রাজস্থানি ব্যবসায়ী রামচন্দ্র গোয়েঙ্কা পরিবারের মেয়েদের জন্য তৈরি করেছিলেন। সেই রাজস্থানী শৈলীর স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ আজ দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ভেঙে পড়বে বলে ভয় হয়। এখান থেকে একটু এগলেই মতিলাল শীল ঘাট। চারটি কারুকাজ করা থাম আজও দেখলে দু’দণ্ড থমকে যান পথিক। কিন্তু নামার সিঁড়িতে নোংরার পাহাড়। ভিতরে এখন ভবঘুরেদের আস্তানা।
কলেজ জীবনের মূল আকর্ষণ ছিল উত্তর কলকাতার ঘাটগুলি। বাগবাজার মায়ের ঘাট থেকে সেই নিমতলা। হেঁটে হেঁটে আড্ডা, বন্ধুত্ব, প্রেম...। জায়গাটা আজও একইরকম থেকে গিয়েছে। তবে লঞ্চের জেটি ছাড়া ঘাটগুলো খানিক পরিত্যক্তই বলা চলে। ঘরহীন, চক্ররেলের লাইনের ধারের বস্তির দামাল ছেলেরা হই হই করে স্নান করে বটে, তবু যেন সেই প্রাণ ফেরে না। শুধু সন্ধেবেলা হলেই ভিড় করে আসেন মানুষ। আবালবৃদ্ধবণিতা। হাওয়া খান, হয়তো অন্য কিছুও।
বাগবাজারে মায়ের ঘাটে এককালে আড্ডা জমত। রাজবল্লভ পাড়া থেকে আসত দুই শাগরেদ। তারপর চা আর এন্তার গুলতানি সন্ধে পর্যন্ত। তারপর নেশাড়ুদের উৎপাতে সরে যেতে হতো চক্ররেল স্টেশনের দিকে। আগে এই ঘাটের নাম ছিল বিচালি ঘাট। এক সন্ন্যাসী বলেছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর সারদা মা আর দক্ষিণেশ্বরে যাননি। পরে তাঁকে কামারপুকুর থেকে নিয়ে আসেন বাগবাজারে শিষ্যরা। তারপর যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন এই ঘাটেই গঙ্গাস্নানে আসতেন। বাগবাজার ঘাট অবশ্য এর থেকে ভালো। এই ঘাটের আসল নাম রাজা রাজবল্লভের ঘাট। চুঁচুড়ার সোমবংশের এই সন্তান, মহারাজা দুর্লভরামের পুত্র এই ঘাট বানিয়েছিলেন। পাশের রাস্তা ধরে আরও অনেক নাম না জানা ঘাট পেরিয়ে থামতে হয় কুমারটুলি ঘাটে। পাশ দিয়ে রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে শোভাবাজার-আহিরীটোলা ঘাট পেরিয়ে নিমতলা। আরও এক মহাশ্মশান। একসময় আনন্দময়ী কালীমন্দিরের কাছে ছিল এই শ্মশানঘাট। তখনও স্ট্র্যান্ড রোড তৈরি হয়নি। সেটা তৈরি হওয়ার পর আজকের নিমতলা তৈরি হয়। ১৮০০ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই শ্মশান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এই যাত্রায় বুড়ি ছোঁয়া হল না আরও কত ঘাটের। সবার ইতিহাস যে জানি, তাও না।
তবু ওই যে জটাবাবা বলেছিল, ‘দেখবি জলের মতোই মনখারাপ বয়ে যাবে এই গঙ্গায়।’ সেটা এখনও ভুলতে পারি না। ঘাটের সিঁড়িতে দু’দণ্ড বসেই যেতে হয়। মনখারাপ থাকুক, না-ই থাকুক!