বঞ্চনা তো ছিলই। এবার শুরু হয়েছে বাংলাকে শুকিয়ে মারার পরিকল্পনা। তাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফেরা রাজ্য সরকারকে অন্ধকারে রেখে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সারতে চাইছে জলচুক্তি। শুধু ফরাক্কা চুক্তি পুনর্নবীকরণই নয়, প্রায় দেড় দশক ধরে আটকে রাখা তিস্তা চুক্তিরও ছক কষছে কেন্দ্রীয় সরকার। তিস্তার জল নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি হলে শুকিয়ে মরবে উত্তরবঙ্গ। অথচ এই উত্তরবঙ্গই প্রতিটি নির্বাচনে চোখবুজে বিজেপিকে সমর্থন জুগিয়ে এসেছে। তা সত্ত্বেও সেখানকার মানুষের কথা না ভেবে নরেন্দ্র মোদি খুশি করতে চাইছেন বাংলাদেশকে। কিন্তু কেন? অনেকে বলছেন, ‘বিশ্বগুরু’ হওয়ার লোভ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইস্যু হবে জল। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আবহাওয়া যে দ্রুত বদলে যাচ্ছে, তা বলে বোঝানোর দরকার নেই। মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পারছে, অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করে দিয়েছে প্রকৃতি। যে রাজস্থান বৃষ্টির জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকত, সেখানে হচ্ছে বন্যা। আবার বরফের মুকুট পরে থাকা কাশ্মীরে চলছে তাপপ্রবাহ। যেখানে বৃষ্টি হচ্ছে, সেখানে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ভেঙে দিচ্ছে অতীতের সমস্ত রেকর্ড। কেরলের ওয়েনাড়ে লাগামছাড়া বৃষ্টি ও বিধ্বংসী ধস তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
এর উল্টোটাও হচ্ছে। বাংলায় বর্ষাকালে তৈরি হচ্ছে খরা পরিস্থিতি। আষাঢ়, শ্রাবণের মাঝামাঝি পর্যন্ত তেমন বৃষ্টি নেই। রোদে, তাপে ফেটে যাচ্ছিল মাটি। বৃষ্টির অভাবে অর্ধেক জমিতেও ধান রোয়া শেষ হয়নি। বৃষ্টি না হওয়ায় ব্যারেজের ছাড়া জলে যখন রোয়ার প্রস্তুতি চলছিল ঠিক তখনই শুরু হল বৃষ্টি। চাষিরা রোয়ার আশায় ছুটলেন খেতমজুরদের সন্ধানে। সবাই রোয়ার কাজ দ্রুত শেষ করতে চান। শুরু হল খেতমজুরদের নিয়ে কাড়াকাড়ি। কিন্তু নিম্নচাপের বৃষ্টি। থামার লক্ষণ নেই। পথ, ঘাট, মাঠ সব ভেসে গেল। যেদিকে চোখ যায় শুধু জল আর জল। বদলে গেল পরিস্থিতি। এবার হয়তো চাষিদের ছোটাছুটি শুরু হবে ধান রোয়ার বদলে, ক্ষতিপূরণের জন্য। কারণ রোয়া জমি, বীজতলা সবই চলে গিয়েছে জলের তলায়।
বৃষ্টিকে ঘিরে অনিশ্চয়তা দিনদিন বেড়েই চলেছে। বিগত কয়েক বছরে বর্ষাকালেও ভারী বৃষ্টির ভরসা সেই নিম্নচাপ। তারজন্য সঙ্কটের মুখে পড়েছে চাষাবাদ। বর্ষাকালেও ধান রোয়ার জন্য চাষিদের তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে বাঁধের জলের দিকে। বাঁধের ছাড়া জলে শুধু কি চাষই বাঁচে? না, নদীর জলের উপর বেঁচে আছে রাজ্যের প্রায় প্রতিটি শহর। নদীর জল পরিস্রুত করেই তা বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করা হয়। তিস্তা শুকিয়ে গেলে বহু মৎস্যজীবী পরিবার পথে বসবে। এহেন অমূল্য সম্পদ রাজনীতির অস্ত্র হলে তারচেয়ে দুর্ভাগ্য আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু সেটাই হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী রাজ্যকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে জলচুক্তি নিয়ে আলোচনা করছেন। তাতেই চটেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে এমন কোনও চুক্তি তিনি মানবেন না।
জলচুক্তি করতে গেলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অনুমতি আবশ্যক। ১৯৯৬ সালে ফরাক্কা চুক্তি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সম্মতিতেই হয়েছিল। প্রতিটি চুক্তিই হয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। ২০২৬ সালে ফরাক্কা চুক্তি রিনিউ হবে। চুক্তির ফলে রাজ্যের ও দেশের লাভক্ষতি পর্যালোচনা করাই প্রথা। বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করে নেওয়া হয় পুনর্নবীকরণের সিদ্ধান্ত। কিন্তু মোদিজি কী করলেন? বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একপ্রস্থ আলোচনা সেরে ফেললেন।
তিস্তা জলচুক্তির বিষয়টা নতুন নয়। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। খসড়াও হয়েছে। তাতে শুখা মরশুমে রাজ্যের চেয়েও বাংলাদেশকে বেশি জল দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই শর্তে নারাজ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। সেকথা হাসিনা নিজেও একাধিকবার বলেছেন। তা সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন প্রায় দেড় দশক ধরে তিস্তা চুক্তিতে ভেটো দিয়ে আসছেন?
ভোট রাজনীতির অঙ্কে উত্তরবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস দুর্বল। বিক্ষিপ্তভাবে তৃণমূল কিছু এলাকায় জিতলেও বেশিরভাগ আসনেই হারে। এবারও উত্তরবঙ্গের আটটি লোকসভা আসনের মধ্যে মাত্র একটিতে জিতেছে তৃণমূল। বিজেপির নীতি মেনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গকে ভাতে মারার কৌশল নিতেই পারতেন। তিস্তা চুক্তিতে সম্মতি দিয়ে উত্তরবঙ্গের মানুষকে তিনি বিজেপির স্টাইলে ‘শিক্ষা’ও দিতে পারতেন। তাতে শেখ হাসিনাও খুশি হতেন। বাংলাদেশে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা যে জ্যোতি বসুকেও ছাপিয়ে যেত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সে রাস্তায় হাঁটলেন না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন, শেখ হাসিনাকে খুশি করার চেয়ে বাংলার মানুষের স্বার্থই তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই বেছে নিলেন সংঘাতের রাস্তা। জানিয়ে দিলেন, ‘তিস্তার জল দেব না।’ উত্তরবঙ্গ তাঁর দলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও তিনি যে উত্তরবঙ্গবাসীর স্বার্থেই লড়াই চালিয়ে যাবেন, তা জানিয়ে দিয়েছেন।
তিস্তার জলচুক্তিতে তাঁর আপত্তি যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, মানবিক কারণে, সেটা মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করেছেন। তাঁর যুক্তি, তিস্তার উপরের অংশে সিকিমে বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করা হয়েছে। তারজন্য শুখা মরশুমে উত্তরবঙ্গে তিস্তা হয়ে যায় প্রায় জলশূন্য। মাঝেমধ্যেই শহরগুলি প্রয়োজনীয় জল পায় না। এই অবস্থায় তিস্তা চুক্তি হলে গরমের সময় উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
সিকিমে বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হওয়ায় উত্তরবঙ্গের সঙ্কটমুক্তির রাস্তাও খোঁজা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ছোট ছোট জলাধার গড়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব। সেইমতো রাজ্য থেকে কেন্দ্রে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। এই অবস্থায় তিস্তা চুক্তি হলে তা হবে গোদের উপর বিষফোঁড়া।
তিস্তা চুক্তি করাতে পারলে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁবে। বাংলাদেশ আরও সুজলা, সুফলা হয়ে উঠবে। ফরাক্কা জল চুক্তির সুফল বাংলাদেশ পাচ্ছে। একটা সময় বাংলাদেশ ধান ও আলুর জন্য ভারতবর্ষের উপর অনেকটাই নির্ভর করত। বাংলায় উৎপাদিত অতিরিক্ত আলু ও ধান বাংলাদেশে চলে যেত। তার সুফল পেতেন বাংলার চাষিরা। কিন্তু ফরাক্কা চুক্তির পর বাংলাদেশ চাষে প্রভূত উন্নতি করেছে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে বাংলাদেশকে চাল ও আলুর জন্য ভারতের মুখাপেক্ষী হতে হয় না। তাই যে কোনও মূল্যে তিস্তা চুক্তি করে জল পাওয়া নিশ্চিত করতে চাইছে বাংলাদেশ।
তিস্তা চুক্তি হলে বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়ে যাবে, কিন্তু উত্তরবঙ্গ? প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর উত্তরবঙ্গ আর সবুজ থাকবে না, হয়ে যাবে ধূসর। তা সত্ত্বেও উত্তরবঙ্গের বিজেপি নেতারা দিল্লির তালে তাল ঠুকছেন। তা করতে গিয়ে বঙ্গ বিজেপির পায়ের তলার মাটি আলগা হচ্ছে। বাংলাকে লাগাতার বঞ্চিত করার খেসারত দিতে হয়েছে তাদেরই। সাংসদ সংখ্যা ১৮ থেকে কমে হয়েছে ১২। এরপর তিস্তা চুক্তি সমর্থন করলে সংখ্যাটা ছয়ে নামলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। কিন্তু তাতে দিল্লি বিজেপির কিছু যায় আসে না। কারণ তাদের একটাই লক্ষ্য, ‘ভগবানের দূতে’র ইমেজ রক্ষা। তাতে বাংলা শুকিয়ে মরলে মরুক। অর্ডিন্যান্স জারি করে একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণে মোদিজি সিদ্ধহস্ত। তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রেও যদি তেমনটাই ঘটে! সেক্ষেত্রে বাংলাকে শুকিয়ে মারার দায় বঙ্গ বিজেপি নেবে তো?
টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসে ইতিমধ্যেই জওহরলাল নেহরুর রেকর্ড তাঁর স্পর্শ করা হয়ে গিয়েছে। তবে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তাতে ছিটকে গিয়েছে ‘বিশ্বগুরু’র শিরোপা। এবার দেড় দশক ধরে আটকে থাকা তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করে সেই লক্ষ্যেই এগতে চাইছেন। কারণ তিনি নিশ্চিত, দেশের মানুষের স্বার্থ বলি দিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সুবিধে করে দেওয়ার মতো ‘মহান’ রাষ্ট্রনায়ক তন্নতন্ন করে খুঁজলেও বিশ্বে দ্বিতীয়টি মিলবে না।